মলেস্ট করে পুরুষ, সাবধান হতে বলে নারীকে
প্রিয়া দেব ।। যৌন নিপীড়ন কথাটা এদেশের প্রেক্ষাপটে প্রচন্ড স্পর্শকাতর একটা শব্দ। যৌন নিপীড়নের মতো অপরাধের শিকার হওয়ার পর যখন একজন নারী সেই অপরাধ নিয়ে কথা বলতে আসেন তখন এ দেশের মানুষের হিপোক্রেসিটা দেখার মতো হয়।
ধরুন একটা মেয়ে, যে কিনা খুব হাসিখুশি, সে সবার সাথে হেসে কথা বলে, ছেলে বন্ধুদের সাথে সহজে মিশে যায়, সহজভাবে আড্ডা দিতে জানে। সেই মেয়েটি যৌন নিপীড়নের শিকার হলো, সাথে সাথে পুরা সমাজ ব্যবস্থা উঠে পড়ে লাগবে মেয়েটিকে ভিকটিম ব্লেমিং করতে। যেন ওই বেশি হাসাটাই মেয়ের দোষ, ছেলেদের সাথে ট্যুরে যাওয়া ও আড্ডা দেওয়াটা মেয়ের দোষ। এইগুলোকে কিন্তু আগে দোষ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছেনা, বিবেচনা করা হচ্ছে তখনেই যখন মেয়েটির সাথে হওয়া অন্যায় নিয়ে মেয়েটি মুখ খুলছে। কোনো মেয়ের ছেলে ফ্রেন্ড আছে এবং সেই ছেলে ফ্রেন্ডটিকে সে যথেষ্ট বিশ্বাস করে – এই ব্যাপারটি মোটেও ওই মেয়েটির অনুমতি ছাড়া তার গায়ে হাত দেওয়ার লাইসেন্স না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ মুহুর্তে ভীষণ আলোচিত ঘটনাটা যদি লক্ষ্য করি, তাহলে দেখি একটি ছেলে তার মেয়ে বন্ধুটিকে ঘুমন্ত অবস্থায় মলেস্ট করেছে, অনুমতি ছাড়া স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দিয়েছে। মেয়েটি যখন এ নিয়ে কথা বলা শুরু করেছে তখন ওই ছেলেটির বন্ধুরা ছেলেটিকে ডিফেন্ড করা শুরু করেছে। এরা মেয়েটির সমস্যা যা খুঁজে বের করেছে তা হলো – মেয়েটি ফ্রেন্ডলি, সহজে ছেলেদের সাথে মিশে যায়, রাতে আড্ডা দিতে চায় ছেলেদের সাথে এবং মেয়েটি তার ছেলে বন্ধুকে অনেক বিশ্বাস করে এবং বন্ধুটির সাথেই অতিরিক্ত সময় কাটায়। এবং মেয়েটি অপরিচিত মানুষদের সাথে কেন ট্যুরে চলে আসলো এটাও ওই বন্ধুদের মাথাব্যাথার বিশাল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই সব ব্যবহার দিয়ে তারা বোঝাতে চাচ্ছে মেয়েটি যেহেতু এমন সেহেতু মেয়েটি হ্যারাসমেন্টের শিকার হবেই। এই জিনিসটা যে কী পরিমাণ ভয়ংকর এটা ভাবতেই একটা মেয়ে হিসেবে আমি কেঁপে উঠছি। এই ছেলেগুলো যখন নিজেদের মধ্যে এই মেয়েটিকে নিয়ে কথা বলছিল তখনো প্রচন্ড নোংরা সব বাক্য মেয়েটির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছিল। এই শব্দচয়ন হচ্ছিলো শুধুমাত্র মেয়েটি নিজের মতো ব্যবহার করছিল বলে; মেয়েটি ফ্রি, ছেলেদের সাথে আলাপে সংকোচ বোধ করেনা, আর পাঁচটা ভালো মেয়ের মতো সে রাত ১০টা বাজতেই ঘরের ভেতর ঢুকতে চায়না এটাই এই মেয়ের সমস্যা।
মজার ব্যপার হচ্ছে ঘটনাটি সামনে আসার পর আমাদের আশেপাশের বুদ্ধিমান সমাজ সচেতন মানুষেরাই দাবি করছেন মেয়েটি স্পেস দিয়েছে তার শরীরে হাত দেওয়ার জন্য। কিন্তু মেয়েটি যদি স্পেসই দিতো তাহলে ছেলেটা মেয়েটিকে এভাবে ঘুমের মধ্যে মলেস্ট করতে গেল কেন? তখন তো মেয়েটার কনসেন্ট নিয়েই মেয়েটিকে স্পর্শ করা যেতো! এই সাধারণ ব্যাপারটি মানতে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারাজই বা কেন?
এইসব ঘটনাতে যা হয় তা হলো বড় করে ভিকটিম ব্লেমিং এবং মেয়েদের উদ্দেশ্যে কিছু জ্ঞান, যাতে করে মেয়েরা পুরুষদের সাথে সাবধানে চলাফেরা করে। কথাবার্তার ধরণ দেখলে মনে হবে যেন মেয়েটির প্রতি হওয়া অন্যায়ের দায়টা একমাত্র মেয়েরই, কারণ পুরুষমাত্রই নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিবেচনা করতে পারে। এই দেশে ধর্ষণের ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন বলে একটা নির্লজ্জ আইন আছে, যে আইন বলে একটা মেয়েকে ধর্ষণ করার পর কোনোভাবে যদি তাকে চরিত্রহীন প্রমাণ করা সম্ভব হয় তবে ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা যাবেনা। এ কারণেই ধর্ষণ এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া ভিকটিমকে আমাদের দেশে প্রথমেই চরিত্রের পরীক্ষা দিতে হয়। এই পরীক্ষাতে এ সমাজের শিক্ষিত অশিক্ষিত, সম্মতিজ্ঞান আছে কিংবা নেই, মেজর মাইনরসহ সবাই মিলে অংশগ্রহণ করে।
সবার লক্ষ্য একটাই, যেভাবেই হোক মেয়েটিকে চরিত্রহীন প্রমাণ করা। এক্ষেত্রে এদের চেষ্টাটি দেখার মতো।
মেয়ের পোশাক, চালচলন, কথা বলার স্টাইল সব এখানে বিশ্লেষণ করা হয়, দিনশেষে উদ্দেশ্য একটাই – ওই নারীটিকে চরিত্রহীন প্রমাণ করা আর পুরো নারীজাতির উদ্দেশ্যে জ্ঞানদান করে এটা বোঝানো যে যতো যাই হোক সাবধান হতে হবে নারীটিকেই, এবং নারীর এই সমস্যার পেছনে দায় একমাত্র নারীটিরই।
এদেশের নারী পুরুষ নির্বিশেষে এই যে ভয়ংকর এক ভিকটিম ব্লেমিংয়ের চর্চা করে, এটা থেকে বের হতে হবে। পুরুষের অন্যায়ের দায় পুরুষকেই নিতে হবে, এখানে কোনো “কিন্তু” উচ্চারণকে গ্রহণ করা যাবে না। সরাসরি বাতিল করতে হবে এইসব ‘কিন্তু’ উচ্চারণ করা হিপোক্রেট মানুষদের কথাকে।
যৌন নিপীড়নের দায় একমাত্র নিপীড়কের, এইখানে কোনো প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। এইখানে সচেতন হয়ে হবে পুরুষকে। নারীকে নিয়ে তাদের এইসব নোংরা চিন্তা বর্জন করতে হবে। স্বাধীনচেতা নারী মানেই সহজলভ্য এমন চিন্তা পুরোপুরি সরাতে হবে মাথা থেকে। নিজের দোষটা বুঝতে হবে। আর কতোদিন এইভাবে শুধু নারীকেই সাবধান হতে বলা হবে বলুন তো?
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত লেখা লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]