December 23, 2024
কলামফিচার ২

ঘরোয়া পাত্রী চাই

ঝুমা বন্দ্যোপাধ্যায় ।। ইনস্টাগ্রামে ফটো শেয়ার করে একদা এক অভিনেত্রী লিখেছিলেন, ‘‘সুশীল, ঘরের কাজে নিপুণ ও সংস্কারি মেয়ের জন্য কোনো বিয়ের প্রস্তাব আছে?’’ এরকম আরেকটি: ‘‘এম ডি পাঠরতা, সুশ্রী এবং ঘরোয়া পাত্রীর জন্য উচ্চপ্রতিষ্ঠিত পাত্র চাই।’’

খবরের কাগজে পাত্র-পাত্রীর এই বিজ্ঞাপনটি দেখিয়ে আমার এক সহকর্মী জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘হ্যাঁ রে, এমডি মানে তো মেয়ে ভবিষ্যতের ডাক্তার?’’ আমি বললাম, ‘‘আসলে ডাক্তার মোক্তার অথবা শিক্ষিত চাকুরিরতা মেয়ে মানেই হল সে বেপরোয়া অর্থাৎ ঘরোয়ার বিপরীত। তাই বিশেষভাবে শব্দটির প্রয়োগ করে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে যে পাত্রী ডাক্তারি পড়লেও ঘরোয়া।’’ আমার সহকর্মী বান্ধবী এবার তেড়ে ফুঁড়ে চেঁচিয়ে উঠল, “ঘরেই যদি বসে থাকবে তাহলে এত যুদ্ধ করে ডাক্তারি পড়ার দরকার কী? আমরা কি ঘরের কাজ করি না?”

আমরা করি বটে তবে আমাদের দেশের অধিকাংশ মায়েরা তাদের পুত্র সন্তানদের ঘরের কাজ করতে দেন না। যেমন ভাবে, কন্যা সন্তানদের তারা ঘরোয়া হওয়ার তাগিদে বাইরের কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন। সময়ের প্রেক্ষিতে এই শ্রমবিন্যাসকে চ্যালেঞ্জ করে মেয়েরা যত বেশি বাইরের জগৎকে আপন করতে চাইছে, ভিতরের মুক্তিটা তার চেয়েও বেশি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সারাজীবন তাই আমাদের মেয়েদের সাধনা চলে নিজের সঙ্গে নিজের অবহেলার। ঘরের সমস্ত কাজ গুছিয়ে তবেই মেয়েটি পারে একটু গলা সাধতে, কবিতা লিখতে, অথবা নিজস্ব কোনো শখ পূর্ণ করতে। কবিতা লেখার বিষয়েই বলি। আমার এক বান্ধবী ফেসবুকে প্রেমের কবিতা লিখে ঘর থেকে প্রায় বিতাড়িত হতে বসেছিল। কত মেয়ে যে ঘরোয়া হতে গিয়ে নাচ, গান, চাকরি ছেড়েছে তার ইয়ত্তা নেই। ঘরে ঘরে এমন ঘটনা এখনও বহমান। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘ঊনিশে এপ্রিল’ সিনেমাতে উচ্চবিত্ত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও এই একই অবস্থা দেখি। তাই বলে কি ঘরোয়া হওয়া অপরাধ? মোটেও না। ঘরটাকে সুন্দর গোছালো আরামদায়ক করে রাখার নৈপুণ্য কিংবা অধিকার প্রত্যেক গৃহবাসীর। ঘরের কাজ যতটা মেয়েরা করে অধিকাংশ পুরুষেরা ততটা করে না। বাইরের কাজ করেও ঘরের কাজ না সামলালে মেয়েটি নিজেকে বড়োই অপরাধী ভাবে কিন্তু সেখানে পুরুষের কোনো অপরাধ হয় না বা হতে দেওয়া হয় না। তাছাড়া উচ্চশিক্ষিত ঘরোয়া হলে উভয়পক্ষের স্ট্যাটাস ভালো দেখায়।

আগেকার দিনে বেশি লেখাপড়া শিখলে মেয়েদের পাত্র পাওয়া মুশকিল হত। শিক্ষিত মানেই ধরে নেওয়া হত মেয়েটি ঘরোয়া নয়। এখন যুগ পাল্টেছে, সঙ্গে এই ধারণাটিরও বিবর্তন হয়েছে। শুধু পাত্রী নয়, বহু বিদেশে প্রতিষ্ঠিত পাত্রেরই দাবি থাকে এমনতর ঘরোয়া পাত্রীর। জগদীশচন্দ্র বসুর স্ত্রী অবলা বসুর কথায়, ‘‘বাঙালি মেয়েদের খারাপ আর্থিক অবস্থার কারণ তাঁদের হাঁটতে না শেখা।” সেই সঙ্গে প্রাসঙ্গিকভাবে জুড়ে দেওয়া যায় হাঁটতে শেখা মেয়ে মানেই ঘরোয়া নয়, সে বেয়াড়া। শুধু তাই নয়, মেয়ে যতই শিক্ষিত বা সুউপায়ী হোক না কেন তাকে ভালো বউ হিসেবে তকমা পেতে হলে যাবতীয় কুসংস্কার যথাযথভাবে পালন করাই শ্রেয়। সে পড়বে এক, পালন করবে আরেক, এই দ্বিচারিতা নিয়েই বিজ্ঞানী হবে, শিক্ষিকা হবে, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবে, সর্বোপরি দশভূজা হবে, যা তার বেয়াড়াপনাকে অনেকখানি স্তিমিত করবে। আবার বিপরীতে এই দশভূজ পুরুষদের মেনে নিতেও আমাদের মায়েদের খুব কষ্ট হয়, বিশেষত আর্থিক মূল্যহীন বউকে।

সামাজিক বিন্যাসে নারীবাদী তত্ত্ব নারীদেরকে যেভাবে ক্ষমতায়িত করার চেষ্টা করে সেখানে নারী বিচ্ছিন্ন এবং স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নারী একলা। তার প্রেরণা বলতে আঘাত। এই নিজের মত বাঁচার প্রক্রিয়া তাকে ঘরছাড়া করে, সমাজছাড়া করে, দেশছাড়া করে। বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে মেয়েদের শিক্ষার হার যথেষ্ট ভালো কিন্তু তাদের আর্থিক ক্ষমতায়ন যতটা কাঙ্ক্ষিত ছিল, ততটা নয়। আমাদের সিনেমা, সিরিয়ালগুলিও এই ঘরোয়া কাহিনী বিক্রি করে – যা শাশুড়ি বউয়ের ঝগড়া থেকে কিছুতেই বেরোতে পারে না এবং স্বামীরা উভয়ের মধ্যেকার দেওয়ালের ভূমিকায় অভিনয় করে। স্বামী বাইরের কাজ করবে, স্ত্রী সন্তান প্রতিপালনসহ ঘরের কাজ করবে – এই নিয়মটি সামাজিকভাবে যথেষ্ট সুপ্রতিষ্ঠিত কিন্ত বেশিরভাগ নারীকেই ঘরে এই বিদ্রুপের শিকার হতে হয়, “তোমার তো সংসার চালাবার ক্ষমতা নেই।” আমাদের সমাজে সাহিত্যে সিনেমা সিরিয়ালে বিপাকে না পড়া পর্যন্ত মেয়েদের ক্ষমতার টের পাওয়া যায় না। তখন সে বেয়াড়া, বেশ্যা, ভ্রষ্টা যাকে খবরের কাগজে পাত্রী হিসাবে বিজ্ঞাপিত করা সমাজবিরুদ্ধ।

ঘরোয়া বউদের আমার খুবই ভালো লাগে। কত যত্ন দিয়ে সে পরিবারকে সুন্দর রাখে। বহু প্রবাসী বাঙালি বউয়ের ঘর সংসারকেন্দ্রিক ব্লগ তো ভীষণ জনপ্রিয়। আমার সেই তেড়েফুঁড়ে ওঠা বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তুমিও তো ওই ঘরোয়া বউয়ের ব্লগ দ্যাখো।” সে বলল, “সিরিয়ালের ক্যাঁচালের চেয়ে বউটির তৃপ্তির হাসি দেখতে ভালো লাগে। ওর বর ওকে ঘরেও কত সাহায্য করে।” হয়তো সেও খুব শিক্ষিতা অথবা চাকরি ছেড়েই স্বামীর সঙ্গে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে কিন্ত কোথাও নিশ্চয় একটা সমঝোতা আছে। আসলে ঘুরে ফিরে সেই আর্থিক ক্ষমতাধারীর কাছে মেয়েরাই বারবার নতি স্বীকার করে, নতি স্বীকারকেই বিজ্ঞাপিত করে এক ঘর ছেড়ে অন্য ঘর আপন করে, কিন্তু নিজের ক্ষমতায় একটি ঘর বানাতে গিয়েও পিছিয়ে আসে কারণ সেই ঘরে পুরুষ সঙ্গীটির প্রবেশ সমাজে পুরুষটিকেও হেয় করে। এবং পরিশেষে এই আমরাই আবার ঘরোয়া পুরুষদেরও বিদ্রুপ করি, যেন ঘরোয়া হওয়া কেবল নারীদেরই শোভা পায়। দেওয়ালে তাই আজও লেপ্টে থাকে, সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে। গুছিয়ে সংসার করার মোহ পুরুষদেরও আছে কিন্তু মেয়েদের তা মোহগ্রস্ত করে রাখে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

One thought on “ঘরোয়া পাত্রী চাই

  • বেদুইন শিশির

    সমকালীন নয় কেবল। সেই যে কবে হতে প্রচলন হওয়া বিষয়টি আজকের কথিত সভ্যতায়ও গতিপথ একটুও বদলায়নি। বরং নারীকে আগের চাইতে আরও বেশী যুদ্ধ করতে হচ্ছে। সমাজ সংস্কার হচ্ছে ঠিকই তবে তা’ সঠিক লক্ষ্য পূরণের পথে না হয়ে নতুন নতুন সমস্যাকে টেনে আনার সংস্কার। যেমন : নারী তুমি লেখপড়া শিখেছো ভালো কথা কিন্তু ঘরে-বাইরে দুইদিকের কাজ-কর্ম সামলাও এবার। পুরুষের বেলায় ঘরে কাজ নয় !! যেমনটি গল্পে উঠে এসেছে। খুব চমৎকার ছোটগল্প। অনেক ভালো লাগলো।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *