মানুষের ইতিহাসে যৌনতা উৎপাত না আশীর্বাদ?
সেঁজুতি জাহান জিনাত।। বাংলাদেশের তৌসিফ মাহবুব আর নিহার একটা নাটক দেখছিলাম কিছুদিন আগে । তৌসিফের লক্ষ্মীমন্ত স্ত্রী নিহা। ভালো রাঁধে, শ্বশুর-শাশুড়ির যত্ন করে, পারিবারিক সব ব্যাপারে দারুণ কর্তব্যনিষ্ঠ সে। কিন্তু পরিচালক তাকে যতোটা পুরুষের কাঙ্ক্ষিত আবেদনময়ী করে উপস্থাপন করেছেন, ততোটা লক্ষ্মীমন্ত উপস্থাপন তার মধ্যে আনেননি। নিহা তার শ্বশুর বা শাশুড়ির সঙ্গে এমন আবেদনময়ী ভঙ্গিতে কথা বলছেন যেন মনে হচ্ছিল তিনি স্বামীর সামনে খুবই সেক্সি মুডে আছেন।
আবার দেশি বিদেশি বিখ্যাত সব সিনেমা এবং ড্রামাগুলোর কোনো কোনোটাতে দেখবেন নায়ক বা নায়িকাদের উপস্থাপনে এমন আবেদনময় ভঙ্গি থাকে যে সাধারণ নরনারী হুমড়ি খেয়ে এসব দেখবে। তুলনামূলক ধর্মপ্রাণ ও বয়োজ্যেষ্ঠরা যে দেখতে চাইবেন না এবং মনে মনে দেখতে চেয়ে তওবা কাটবেন তাও কিন্তু ওই চিরন্তন নরনারীর যৌনতা নির্ভর সম্পর্কের আকর্ষণের কারণেই। নায়ক নায়িকাদেরকে হয়তো এমন বেখাপ্পা আবেদনময়ী হয়ে উঠতে হয় ভিউ বাড়ানোর তাগিদে। পরিচালকদের এই মনস্তত্ত্বকে সমাজ ব্যবস্থার আদি গ্রন্থির সঙ্গে পুরোপুরি মিলিয়ে দেখা যায়। যৌনতার ব্যাপার স্যাপার শুধু যে নরনারীর পোশাক, ভঙ্গি, কথা বা শিল্প সাহিত্য মাধ্যমে বিশেষভাবে তুলে ধরা হয় বলেই এগুলো সামনে আসে ব্যাপারটা তা না। মানুষের পদক্ষেপমাত্রই যৌনতার কারবার। শুরু থেকেই। বাংলা সাহিত্যের ‘কা আ তরুবর পঞ্চ বি ডাল চঞ্চল চী এ পইঠো কাল।’-এর রচয়িতা লুইপা থেকে শুরু করে ‘শরীর শরীর তোমার মন নাই কুসুম’- এর লেখক মানিক হয়ে আজকের লেখক মাশরুর আরেফিনের ‘আড়িয়াল খাঁ’র দিকে যদি তাকান মনে হবে যৌনতার প্রাচুর্যে ভরপুর যেন দুনিয়া। পড়তে পড়তে হয়তো মনে হবে ধুর, এতো রগরগা যৌনতানির্ভর বাস্তবতা আবার আছে নাকি দুনিয়ায়?
কিন্তু, নিজের দিকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তাকালেই সব স্পষ্ট হয়ে যাবে।
যৌনতা কোথায় নাই?
যে কারণে মেয়েদের বোরকা পরতে হয় সেটার কারণ খতিয়ে দেখলে যৌনতা সেখানে আছে। শত্রুকে ঘায়েল করতে চাইলে তার যৌন জীবনকে সামনে আনা হয়। অফিস, পাড়া, মহল্লা, ঘর, পুকুর ঘাট, সিঁড়ির গোড়া, চায়ের দোকান ইত্যাদি স্থানগুলোর আড্ডা সবসময় দীর্ঘায়ু লাভ করে তখনই যখন গণপিটুনির ভয়ে পালানো চোরের গণজমায়েতের ভেতর টুক করে ঢুকে পড়ার মতো মানুষের যৌন জীবন নিয়ে আলোচনাও ঢুকে পড়ে।
মানুষের সঙ্গে মানুষের সখ্য অনেক বেশি পোক্ত হয় যতোটা না একই বঞ্চনার শিকার হয়ে তার থেকে অনেক বেশি মানুষের যৌন জীবন নিয়ে আলোচনা সমালোচনার সঙ্গে নিজেদের যাপনের অবদমনজনিত কারণে। মানুষের সঙ্গে মানুষের বিরোধের অবধারিত কারণও অনেক সময় তাদের অসফল যৌনজীবন। এসব নিয়ে প্রচুর ফর্মার বই আছে বাজারে।
৭০ হাজার বছর আগে মানুষ যখন খাদ্যান্বেষণে পৃথিবীময় ঘুরে বেড়াতো, তখন তাদের যৌনসঙ্গী নির্দিষ্ট থাকতো না। জীব জগতের ফান্ডামেন্টাল বৈশিষ্ট্যের কারণে তারা বহুগামী পন্থায় সেক্স করতো। ফলে নারীর পেটের বাচ্চাটা কার সেটা না জেনেই ভ্রাম্যমাণ গোষ্ঠীর পুরুষেরা পোয়াতী নারীদের যত্ন নিত। প্রসবের পর সন্তানের যত্ন সন্তানের মায়ের সঙ্গে সেক্স করা সকল পুরুষই নিত। সস্ত্রীক ক্রিস্টোফার রাইয়ান তাঁদের বিখ্যাত বই ‘সেক্স অ্যাট ডোন’ এ অনেকটা এমনই বলতে চেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে লালনের একটা গানের কথা মনে পড়ে – ‘মায়েরে ভজিলে হয় তার বাবার ঠিকানা।’ অর্থাৎ একমাত্র মা-ই জানেন তার সন্তানের বাবা কে! কার কার ঔরসে বেড়ে ওঠে তার গর্ভের সন্তান। এটা খুবই ইউনিক ব্যাপার। একটা গোষ্ঠীবদ্ধ মানব জাতির মধ্যে ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তানের দায়িত্ব ও যত্ন নিচ্ছে সেই সমাজের সকল পুরুষ। প্রেম ভালোবাসার খণ্ডিত দশার জন্ম দেয় আধুনিক গণতন্ত্র। পুরুষকে ভাবা হয় বহুগামী। ধর্মও তা পারমিট ক’রে নানান পুরুষতান্ত্রিক কানুনের জন্ম দেয়। অথচ মানব ইতিহাসে বহুগামী কি শুধু পুরুষই? কী মনে হয়?
সভ্যতার শুরুটা কীভাবে হয়েছে?
পৃথিবীর বুকে সব দিক থেকে টিকে থাকবার জন্য উৎকৃষ্ট বীজ চাই। উৎকৃষ্ট বীজ মানেই বুদ্ধিমত্তা, সুস্থতা, দীর্ঘায়ু। ফসলের আগাছা সাফাইয়ের মূল উদ্দেশ্যও তো তাই। উৎকৃষ্ট ফসল ঘরে তুলতে হবে, দীর্ঘদিন যেন তা সংরক্ষণ করা যায়। মানুষের বেলাতেও সেই সূত্র বাছাই করা হয়েছে। অর্থাৎ খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা লাভের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ চেয়েছে তার চিহ্নকে উৎকৃষ্ট বীজের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে টিকিয়ে রাখার। শুরু হলো সভ্যতার নামে জীবজগতের আদি বৈশিষ্ট্য থেকে যৌনতার শুদ্ধাচার। বহুগামী যৌন জীবন থেকে নিয়ন্ত্রিত যৌন জীবনের মনে হয় একমাত্র উদ্দেশ্য উৎকৃষ্ট বীজের চিহ্ন পৃথিবীর বুকে টিকিয়ে রাখার স্বপ্ন।
মানব ইতিহাসে খাদ্যের নিশ্চায়ন ঘটেছে। নিয়ন্ত্রণ ঘটেছে বুদ্ধিমান মানুষের চাষবাসও। এতে পৃথিবীতে তথাকথিত এক ‘সভ্যতা’ নেমে এসেছে বটে, কিন্তু মানবের সাইকো-বায়োলজিক্যাল হিস্ট্রি ঘাটলে দেখা যায় মানুষের জিনের ভেতরে বহুগামীতার ডিএনএ রয়ে গেছে। একে ধর্ম এবং সভ্যতার ট্যাগ লাগিয়েও যথেষ্ট সাফসুত করা সম্ভব হয়নি। ফলে বিপুল পরিমাণ অবদমন তাকে গ্রাস করেছে।
এই অবদমন আজ মানুষের একমাত্র শত্রুতে পরিণত হয়েছে।
শুরুতে যে নাটকের কথা বললাম সেটাসহ আজকের পুঁজিবাদী সমাজের বেচাবিক্রির একমাত্র হাতিয়ার হয়ে উঠেছে যৌনতা। আধুনিক গণতান্ত্রমুখী মানবসভ্যতা আর যাই হোক নিয়ান্ডারথাল আমলের সামাজিক জীবনকে কিছুতেই মেনে নেবে না। কিন্তু তাতে কী? শিক্ষা, জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তি কি লক্ষ লক্ষ বছরের অবদমনজনিত জটিলতার চক্রকে অস্বীকার করতে পেরেছে? মনে হয় না। বরং তুলনামূলক অনেক বাড়িয়েছে।
হোমো ইরেক্টাস থেকে শুরু করে আজকের দিনের হোমো স্যাপিয়েন্সকে যদি কাতারে কাতারে সাজিয়ে সামনে মেলে ধরি, তো কী দেখা যাবে? সভ্যতার পোশাক পরলেও আজকের হোমোস্যাপিয়েন্স তুলনামূলক বেশি অনিয়ন্ত্রিত যৌনতার মধ্যে বসবাস করে।
সেটা কী রকম?
একটু খুলেই বলা যাক। ধরুন ৭০/৮০ হাজার বছর আগে ‘মানুষ’ এর আকৃতি প্রকৃতি নিয়ে যেসব প্রাণী পৃথিবীময় ঘুরে বেড়াতো, তাদের সবকিছুই ছিল খোলা। খাবারের পরিমাণ সম্পর্কে যেমন তারা সবাই ওয়াকিবহাল থাকতো, তেমনি ওয়াকিবহাল থাকতো যৌনজীবন সম্পর্কেও। এখন সবাই নির্লিপ্ত, নিরাসক্ত সব ধরনের ‘অপরায়ন’ এর চর্চায় নিমজ্জিত। ফলে অবদমনের বর্জ্যকে তারা নানা রকম বিকারের মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকে। আরও স্পষ্ট করে যদি বলি, পৃথিবীতে ‘ধর্ষণ’ বলে একটা বিশ্রী ব্যাপার খুব বেড়ে গেছে। এর জন্য একটা গোষ্ঠী তথাকথিত ধর্মহীনতাকে দায়ী করছে, একটা গোষ্ঠী দায়ী করছে ধর্মের বেধে দেয়া আরোপিত গণ্ডিকে। মিলান কুন্ডেরার ‘অ্যাডওয়ার্ড এবং ঈশ্বর’ গল্পে অ্যাডওয়ার্ডের মনস্তত্ত্বকে লক্ষ করলে খুব ভালো করে টের পাওয়া যায় ধর্মের শক্তিকে। বাস্তবের মানুষ আর ধর্মযাপনের মানুষের মধ্যে পার্থক্য থাকা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু জোর করে মানুষের মধ্যে ধর্ম আর সভ্যতাকে আরোপ করে অধর্ম আর অসভ্যতা করা কি একটু বেশিই অস্বাভাবিক না? এতে মানুষটার মনের ওপর প্রভাব সম্পর্কে কি কেউ টের পায়? মানুষের মন একেবারে নিয়তির মতো। একে যতোটা পরিচ্ছন্ন রাখা যায়, ততোই মঙ্গল।
পরিশেষে বলতে চাই, মানবেতিহাসে স্বাভাবিক যৌন চিন্তা কোনো উৎপাত হতে পারে না। মানুষের জীবন থেকে যৌনতাকে প্রকাশ্যে অস্বীকার করতে গিয়ে মোটাদাগে ও দীর্ঘমেয়াদে মানবজাতির ক্ষতি করে ফেলা হচ্ছে না তো?
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]