November 2, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

দশভূজা রূপের গ্ল্যামারের ফাঁদে

জয়া শর্মা ।। ‘সমুদ্রের নীলাভ জলে মাথায় ঝুড়ি নিয়ে তাতে স্ত্রী এবং সন্তানকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন মহান পিতা!’ – এমন একটা ছবি একসময় ফেসবুকে বাবার গুরুত্ব বোঝাতে বেশ শেয়ার হয়। একটা গোবরসর্বস্ব শ্রেণি দু:খ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন, শক্ত কঠিন বাবা সারাদিন কত কষ্ট করে টাকা উপার্জন করেও আন্ডাররেটেড এবং সন্তান লালন-পালন ও সমস্ত ঘরের কাজ একহাতে করে যাওয়া মা ওভাররেটেড! অর্থ উপার্জনকারী বাবার গুরুত্ব নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু এভাবে একটা জেনারেশনকে মিসগাইড করে বাবার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে ২৪ ঘন্টা শ্রম দিয়ে যাওয়া গৃহিণীদের জীবনকে বিষিয়ে তোলবার নতুন এক আয়োজনের গুরুত্ব আসলে কতটুকু! বলছি এমন সব গৃহিণীর কথা, যাদের অনেকে হয়তো সন্তান লালনের জন্য বাধ্য হয়ে চাকরি ছেড়েছেন, নয়তো পুরুষতন্ত্রের বাধ্যবাধকতায় চাকরির অনুমতি না পেয়ে চার দেয়ালে বন্দী হয়েছেন! (মনে রাখা জরুরি, এদেশে নারীরা মানুষ হলেও সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেনের মত তাদের সবকিছুতেই আবার পুরুষতন্ত্রের অনুমতি লাগে, যার নাম ভূমিকায় থাকেন ‘বাবা’, ‘ভাই’ কিংবা ‘পার্টনার’ – যার আভিধানিক সমার্থক শব্দ আবার ‘স্বামী’!)

প্রকৃতপক্ষে এমন সব ছবি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভয়ের প্রতিচ্ছবি। নারীদের ঘরে বন্দী করে রেখে আনরিকগনাইজড ঘরের কাজে অমানুষিকভাবে খাটিয়ে নিয়ে, অর্থ উপার্জনের খোঁচা দেয়া যে মানায় না – তা ভালই জানে এই পুরুষতন্ত্র। সময়ের ব্যবধানে পাশার দান উল্টে মেয়েরাই যখন উপার্জনকারীর ভূমিকায়, তখন নিজেদের একমাত্র রোল নিয়ে ভয়ানক সংশয়ে পড়ে গেছে পুরুষ। আগে যেখানে শুধুমাত্র উপার্জনের ছুতোয় সন্তান লালন-পালন ও ঘরের কাজ থেকে রেহাই পাওয়া যেত, সেই বাহানাতেও শেষ পেরেক ঠুকে দিল দিগ্বিজয়ী নারী। তাই তারা নারীদের বিরুদ্ধে নতুন হাতিয়ার নিয়ে পথে নেমেছে, যার মূলমন্ত্র :  “আমি নারী, আমি সব পারি!”

নারীদের উপর সমস্ত কাজ চাপিয়ে দিতেই তাদের। দশভূজা’ রূপকে অযথা গ্লোরিফাই করে এ সমাজ। অনেক নারীও এই ফাঁদে পা দিয়ে গ্রামসির হেজেমনি তত্ত্বকে সঠিক প্রমাণ করে “আমি নারী, আমি সব পারি” প্রমাণের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়ে যান। কেউ যদি এই লড়াইয়ে সামিল না হতে চান তবে তারা হন পুরুষতন্ত্রের সমালোচনার শিকার। নারীদের এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন তারা নিজেদেরই প্রতিপক্ষ; যখন কিনা নারীরাই নারীদের সহমর্মি হওয়ার কথা। এসবের মাঝে নারীরা ভুলে যান, তারাও মানুষ, তাদের সব পারতে হবে কথা নেই।

সারাদিনের ক্লান্তি শেষে দুদণ্ড চোখ বুজে বিশ্রাম নিতে মন চাইতে পারে আপনার, এতে নিজেকে অপরাধী ভাবার কিছু নেই। সারাদিন অফিস সামলে ক্লান্ত শরীরে বাসায় এসে যদি এক গ্লাস জল এগিয়ে দেওয়ার লোক না থাকে, অন্তত একজন হেল্পিং হ্যান্ড হায়ার করুন। এতে ঘরে আপনার উপর কাজের প্রেসার যেমন কমবে, একজন মানুষের কর্মসংস্থানও হবে। প্রয়োজনে নিজের পার্টনারের সাথে ঘরের কাজ শেয়ার করে নিন। মনে রাখুন, ঘরের কাজ এবং সন্তানের দায়িত্ব দুটোই আপনাদের দুজনের। সন্তানদের ভালোবাসা মানে নিজেকে অবহেলা করা নয়। প্রাণ খুলে ভালোবাসুন নিজেকে, তবে ভালোবাসতে পারবেন পরিবারকে। মন খুলে বাচুন; নারী বা পুরুষ হয়ে নয়, মানুষ হয়ে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *