সমাজের নজরদারিতে মেয়েদের বেড়ে ওঠা
কানিজ ফাতেমা শিরিন ।। ভাষাতত্ত্ব পড়তে গিয়ে বিভিন্ন থিওরি পড়েছি। মেনটালিস্ট থিওরি পড়তে গিয়ে জেনেছি, কীভাবে শিশুদের মস্তিষ্কে একটা ডিভাইস কাজ করে তাকে ভাষা শেখাতে। শিশুদের জন্য পৃথিবীর সব কিছুই নতুন। তাই পরিবেশ বিশেষ ভূমিকা রাখে শিশুর আচরনবিধির উপর। জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশনটাও মায়ের পেট থেকেই শুরু হয়। আলট্রাসোনোগ্রাফি করে ছেলে নাকি মেয়ে বাচ্চা তা জানার পর মেয়ে বাচ্চার প্রতি নেতিবাচক অভিব্যক্তি তার উপর তখনই প্রভাব ফেলতে শুরু করে। জন্ম নেওয়ার আগে বা জন্ম নেওয়ার পরপরই সে জানে সে দুর্বল। এতে করে তার দূরদর্শিতা কাজ করে কম। আবার শৈশবে তাকে কিনে দেওয়া হয় হাঁড়ি-পাতিল, পুতুল ইত্যাদি। ফলে তার চিন্তাধারা এসবের মধ্যে আটকে যায়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে ছেলে-মেয়ে উভয়ই শিক্ষিত হচ্ছে ঠিক, কিন্তু অভিভাবকরা মেয়েদেরকে ততোটা ভরসা করতে পারছে না, যতোটুকু তারা ছেলেকে পারছে। এমন অনেক পরিবার রয়েছে, যারা ছেলের জন্য ভালো গৃহশিক্ষক রাখে, কিন্তু মেয়ের পড়ার বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন। ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন থাকে অনেক, আর মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন থাকে বিয়ে দেওয়া।
মেয়েরা নানা প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে বড় হয়। অনেকে সব মাড়িয়ে নিজের পরিচয় গড়ে। পরিচয় গড়তে গিয়েও পড়ে বিপদে। বেশি শিক্ষা মেয়েদের জন্য ভালো না। বেশি পড়লে তারা বেয়াদব বা অবাধ্য হয়ে যাবে। মেয়েদের জন্য আলাদা বই নেই। যে বই পড়ে ছেলেরা হয় সভ্য, সে বই পড়ে মেয়েরা কীভাবে অসভ্য হয় আমার জানা নেই। বরং মেয়েরা তাদের অধিকার বোঝে। তার কোথাও অন্যায় হলে বুঝতে পারে, আর এটাই এই সমাজের বেড়ে ওঠা ছেলেদের পছন্দ না। আবার মেয়েরা যতোই নিজের পরিচয় গড়ুক না কেন, তাকে পরিচিত হতে হবে স্বামীর পরিচয়ে। তার জীবনে যতোই সফলতা থাকুক না কেনো, ভালো প্রতিষ্ঠিত স্বামী না পেলে তাকে সফল বলা যাবে না।
ওয়ার্কিং ওমেনদেরকে আবার সুপার ওমেন বানানোর চেষ্টা। তাদেরকে বেঁধে ফেলা হয় “যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে” প্রবাদ দ্বারা। আর মেয়েরা নিজেকে প্রতিনিয়ত যোগ্য প্রমাণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। যে রান্না পারে, তার চুল বাঁধার জ্ঞান না থাকতেই পারে। আবার এমনও হতে পারে সে চুল ভালো বাঁধতে পারে, কিন্তু রান্না পারে না। এজন্য কি তার বাকি কাজ বা যেটা ভালো পারে সেটা ঢাকা পড়ে যাবে? কিন্তু না, তাদেরকে পার্ফেক্ট হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামতেই হবে। অন্যদিকে মেয়েরা তাদের প্রতি নেতিবাচক আচরণ পেতে পেতে কেউ এখন স্বাভাবিক আচরণ করলে তাকে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার আসনে বসিয়ে ফেলে, ভাবে জগতে এর থেকে ভালো মানুষ আর একটিও নেই। অনেকে আবার নিজ স্বামীকে নিয়ে গর্ব করে বলে যে, তার স্বামী তাকে সবকিছুতে স্বাধীনতা দেয়। নিজেও জানে না সে কতো বড় বোকা! সে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি পরাধীন, যার স্বাধীনতা অন্যের হাতে। জগতের এই সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয়গুলো আমরা বুঝি কম। এর পেছনে প্রধান কারণ আমাদের পরিবেশ এবং নারীদের উপর এর প্রভাব। তবুও আশাবাদী, একদিন মেয়েরা তাদের অধিকার বুঝবে, জানবে তার অধিকার শুধুই তার। যা কিছু তার, তা অন্য কেউ দেওয়ার বা নির্ধারণ করার কেউ না। আর পুরুষরাও বুঝবে পুরুষত্ব জাহির করতে গিয়ে তারা কতোটা অসহায়। কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে গিয়ে বেশিরভাগ সময় বিয়ে করে কমবয়সী, পড়াশুনা কম জানা মেয়েকে। এতে করে কর্তৃত্ব ফলাতে পারে ঠিক, কিন্তু একটা সম্পর্ক কতোটা মিষ্টি ও স্বর্গীয় হতে পারে – সে উপলব্ধি থেকে অনেক দূরে থাকে।
ওয়ার্কিং ওমেনরা আবার তাদের কেরিয়ার স্যাক্রিফাইস করছে সন্তানের জন্য। তাদেরকে প্রমাণ করতে হবে তারা ভালো মা। তাহলে বাবারা কেন এই প্রতিযোগিতায় নামছে না? এই মায়েরা বুঝতে পারছে না তারা নিজেদের সন্তানকে কতোটা পিছিয়ে দিচ্ছে। আজ সে তার বাচ্চার জন্য স্যাক্রিফাইস করলো নিজের পরিশ্রম দিয়ে গড়ে তোলা কেরিয়ার। আগামীকাল তার গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া, বৈজ্ঞানিক হতে চাওয়া মেয়েটা যে পিছিয়ে যাবে সেটা কেন উপলব্ধি করছে না! মেয়ে জানবে, মায়েদের ত্যাগ করতে হয়। এই মা হতে পারতো সাহসী মা, এক কদম এগিয়ে গিয়ে মেয়েকে আরেক কদম বেশি হাঁটার সাহস দিতো।
বাংলাদেশের স্বনামধন্য পত্রিকাগুলো কিছুদিন পরপর ডিভোর্সের হার প্রকাশ করে। সময় নিয়ে একটু কমেন্টবক্স চেক করলে দেখবেন, বেশিরভাগ মানুষ কতোটা নোংরা মানসিকতা রাখে। শিক্ষিত, অশিক্ষিত সবাই শুধু নারীর উচ্চশিক্ষা বা নারীর কাজকেই এর জন্য দায়ী করে। পুরুষদের পরিবর্তন হয়নি, এখনও তারা আগের মতোই আছে। শিক্ষিত নারীরা ভুলকে ভুল বলতে পারে। তাই তারা সহজে তার প্রতি কোনো অন্যায় হলে বুঝে যায়, সে প্রতিবাদ করে। এতে করে সে হয়ে যায় অবাধ্য, আর তার আওয়াজ তোলাটা হয়ে যায় ডিভোর্সের অন্যতম কারণ। আবার সমাজ যখন ডিভোর্সি কোনো মেয়েকে দেখে, তাকে ভেবে বসে অসহায়। অনেকে এর সুযোগ নিতে চায়। সমাজ জানেনা ওর মেরুদণ্ড কতোটা সোজা ও শক্ত, সে নিজেই কতোটা সাহসী এবং একা চলতে পারে। সিঙ্গেল মাদারদের সাফার করতে হয় আরো বেশি। যারা পাশে থাকার জন্য আসে, খেয়াল করলে দেখবেন, এটাকে পাশে থাকা বলেনা, ওরা আসে সহানুভূতি দেখাতে।
কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য নারীরা স্কুটি, বাইক, সাইক্লিং শিখছে। এই নারীরা যখন এগিয়ে যায়, চারপাশের মানুষ হা করে থাকে, মনে হয় যেন তারা অস্বাভাবিক কোনো বিষয় দেখছে। একবার এক ভদ্রমহিলাকে দেখলাম বড় এক মাঠে সাইক্লিং শিখছেন। কিন্তু ভুলবশত একটা দুর্ঘটনা ঘটে। ততক্ষণাৎ জড়ো হওয়া মানুষজন দুর্ঘটনা বা ভুক্তভোগীকে নিয়ে কথা বলেনি। তাদের সবার কথা ছিল, মহিলামানুষ বাসায় থাকবে, সাইকেল নিয়ে বের হলো কেন?
এভাবেই তারা সুযোগ খোঁজে কখন মেয়েদের এগিয়ে যাওয়াটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়। মেয়েদেরকে এভাবেই থাকতে হয় নজরদারিতে। কিন্তু আমাদের পরিবেশটাতো এমন হওয়া উচিৎ, যেখানে কোন কাজ ছেলে করলো, কোনটা মেয়ে করলো তা আলাদা করে দেখার কেউ থাকবে না। সবার চোখ, মন হবে পরিশুদ্ধ। ‘‘ফেমিনিস্ট” শব্দটাকে গালি বলে ব্যবহার করা হবে না।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]