November 21, 2024
কলামফিচার ২

নিম্নবর্গত্ব আসলে লিঙ্গের, শুধু অর্থের নয়

মেহেদী হাসান ।। শারমিন শামসের একটা গল্প পড়েছিলাম কয়েক বছর আগে। আজ আর নামটাও মনে নেই। কিন্তু কাহিনী কাঠামো মনে গেঁথে আছে। এক নারী তার দু’কন্যা সন্তানকে নিয়ে ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ভাইটি তিনজন অনাথাকে আশ্রয় দেয় ঠিকই কিন্তু বড় মেয়েটিকে তার যৌনসঙ্গী করে বিনিময়ে। শারমিন শামসের স্নায়ুছেঁড়া বর্ণনায় মেয়েটার জবানিতে সে বেদনা উঠে আসে। একেবারে মরবিড একটা গল্প। পাঠক হিসেবে আমাদের বিবমিষা ছেয়ে যায়। মেয়েটার মাকে দেখি এ বিষয়ে চুপ থাকতে। দিব্যি ভাইয়ের বাড়িতে খায় দায় ঘুমায় আর ছোটমেয়েটার একটা বিয়ে দিয়ে তার সুখ নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। বড় মেয়েটা বলা যায় পরিত্যক্ত হয়। মাকে খুব নিষ্ঠুর মনে হয় গল্পটাতে। আমি গল্পটাকে এভাবে ভাবি নি। আমার মনে হয়েছে নিজের জন্য, অন্য মেয়েটির জন্য মা-টা বড় মেয়েকে উৎসর্গ করেছে। এটা এক ধরনের প্রতিরোধ বলা যায়। সারভাইভাল রেসিস্টেন্সই বলি একে। বলা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠের জীবন নিশ্চিত করতে অর্থাৎ দুজনকে বাঁচাতে একজনকে উৎসর্গ করা আর কি! এছাড়া আর কী করা যেত? প্রতিবাদ করলে তিনজনের আশ্রয় যেত। এর চেয়ে একজনের পরিবর্তে দুই জন অন্তত বাঁচলো। তবে তিনজনের একজন ছেলে হলে গল্পটা অন্যভাবে লিখতে হতো। এমন পরিণতি টানা যেত না। ফলে তিনজনকে একসাথে না মেরে একজনকে মেরে দুজনকে বাঁচানো আর কি!

এককালে রণজিৎ গুহ একটা প্রবন্ধ লিখেছেন, ‘চন্দ্রাজ ডেথ’ – চন্দ্রার মৃত্যু। উনিশ শতকের ঘটনা। চন্দ্রা বাগদির মেয়ে। জাতপাতে বিভক্ত সমাজে একেবারে তলানিতে অবস্থান। চন্দ্রার স্বামী মারা যাবার পরও সে শ্বশুর বাড়িতে থেকে যায়। এক সময় চন্দ্রার সঙ্গে তার ননদের স্বামীর শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক চলে। তারপর সমস্যা দেখা দেয় চন্দ্রা গর্ভবতী হয়ে পড়লে। চন্দ্রার সমাজ-অস্বীকৃত প্রেমের দায় জৈব কারণে চন্দ্রার ওপরই বর্তায়। চন্দ্রার প্রেমিক নন্দাই মগারাম একদিন চন্দ্রার মা ভগবতিকে দুটো বিকল্প প্রস্তাব দেয়, ১. চন্দ্রার গর্ভপাত করাতে হবে। নতুবা ২. চন্দ্রাকে ‘ভেক’ ধরিয়ে দেওয়া হবে। দুটো প্রস্তাবই খারাপ চন্দ্রার জন্য। বাগদিদের জন্য ভেক ধরিয়ে দেওয়ার অর্থ হলো, আখড়ায় বহু পুরুষের উন্মত্ত লালসার মধ্যে মেয়েটিকে ছেড়ে দেওয়া। চন্দ্রা নামের মেয়েটি মগারাম চাষার লালসার শিকার ছিল, ভেকে দিলে একসাথে অনেকগুলো মগারাম অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। বাগদিদের মধ্যে এ প্রথা ধর্মীয়ভাবে স্বীকৃত। রণজিৎ গুহ দেখিয়েছেন, কীভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে এরা অসহায় নারীকে নির্যাতন করে। চন্দ্রার মা, বোন আর মাসতুতো বোন চন্দ্রাকে বাঁচাতে প্রথম বিকল্প গ্রহণ করে। এছাড়া ওদের আর উপায় ছিল না। কবিরাজের গর্ভপাতের অসুধ খেয়ে চন্দ্রা মারা যায়। চন্দ্রাকে নির্মম ভেকের হাত থেকে বাঁচাতে নারীরা যে সংহতি প্রকাশ করে এটাকে রণজিৎ গুহ নিম্নবর্গের তলানির নারীদের প্রতিরোধ হিসেবে দেখেছেন। এরা স্বীকারোক্তিতে সবাই চন্দ্রাকে বাঁচানোর চেষ্টার কথা বলেছে। চন্দ্রা মারা যাবে এটা ওরা ভাবতে পারে নি। একটি প্রবল গলিয়াথের বিরুদ্ধে লড়াই করা যে কত কঠিন সেটা ওরা জানতো। সে অভিজ্ঞতা তাদের এ সংহতি এনে দিয়েছে। ফুকোর বিখ্যাত উক্তি, যেখানে প্রবল শক্তি প্রয়োগ হয়, সেখানে কোনো না কেনো উপায়ে প্রতিরোধও গড়ে ওঠে। মমতাজের জনপ্রিয় একটা গানে শুনেছিলাম এমন, আমি কোর্টে মামলা করবো আমার হৃদয় ভাঙার জন্য, ক্রসফায়ারে তোমারে মারবো হৃদয় ভাঙার জন্য। ক্ষমতা কোথায় লুকিয়ে আছে তা জানে নিম্নবর্গের মানুষ। কারণ ক্ষমতার সঙ্গে তাকে যুঝতে হয়। শারমিন শামসের গল্পের মা-মেয়ে যুঝেছে, চন্দ্রার নারী আত্মীয়রা যুঝেছে।

দুই.

ভিকারুননিসা নূন স্কুলে কেবল মেয়েরা পড়ে। বাংলাদেশের মেয়েদের জন্য বানানো সম্ভবত সবচেয়ে ভালো স্কুল এটি। কেবল মেয়েরা পড়ে বলেই এখানে একটা না একটা সমস্যা হয়ই হয়। না হয় এখানে যেসব মেয়েরা পড়ে তারা আর্থিক বা সামাজিকভাবে অনেক সুরক্ষিত। কেবল লৈঙ্গিক পরিচয় তাদের নিম্নবর্গত্ব নিশ্চিত করেছে। এখানে ছাত্রী সুইসাইড করে শিক্ষককে ফাসিয়ে দেয়, শিক্ষক নাবালিকার সঙ্গে অনৈতিক শারীরিক সম্পর্ক করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়, শিক্ষক কর্তৃক যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয় ষষ্ঠ শ্রেণির বাচ্চাদের। বিপুল ব্যয়ে এখানে অভিভাবক প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়, সেসব প্রতিনিধিদের প্রভাব থেকে বাঁচতে অধ্যক্ষকে বালিশের নীচে পিস্তল রেখে ঘুমাতে হয়। অনেকটা গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের উপন্যাসের সব ঘটনা জাদুর মতো ঘটতে থাকে। আমার ধারণা বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ঘটনা ঘটে কমবেশি।  মাদ্রাসাগুলোতেও ঘটে। সোনাগাজীর এক ঘটনা জাতীয় সংবাদের গুরুত্ব পায়। কিন্তু কালেভদ্রে সোনাগাজী গুরুত্ব পায়। তাই বলে প্রতিরোধ হয় না এমন নয়। তলানির নিম্নবর্গের প্রতিরোধ আমাদের চোখে পড়ে না,  তবে কিছু না কিছু হয় ঠিকই।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রচার হয় বেশি। কারণ এর শ্রেণিগুরুত্ব অনেক বেশি। ষষ্ঠ শ্রেণির যে মেয়েটা বড় হয়ে অভিযোগ করেছে শিক্ষক কর্তৃক নির্যাতিত হবার, সে মেয়েটার অভিযোগের প্রাথমিক তদন্তের সত্যতা পাওয়া যায় নি প্রথম দিকে। যখন মেয়েরা রাস্তায় নামতে শুরু করলো, প্রাক্তনীরা মুখ খুলতে শুরু করলো, অভিভাবকরা প্লেকার্ড বহন করতে করতে শ্লোগান দিতে লাগলো তখন পরিবর্তন ঘটতে লাগলো কর্তৃপক্ষীয় ভাষ্যের। এ থেকে বোঝা যায় পারস্পরিক সংহতির শক্তি কীভাবে পাহাড় নড়িয়ে দেয়।

হুমায়ুন আহমেদের একটা উপন্যাস আছে মেয়েটা যখন স্বামীর বন্ধু কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয় তখন চিৎকার করতে পারে না।  কোর্টে প্রশ্ন করা হয় ধর্ষণকালে চিৎকার করে নি কেন? ষষ্ঠ শ্রেণির মেয়েটা সে সময় চিৎকার করে নি কেন? অনেক সময় চিৎকার করা যায় না।  ষষ্ঠ শ্রেণির শিশু লজ্জায় চিৎকার করতে পারে নি। হুমায়ূন আহমেদের পুষ্প নামের মেয়েটিও পারে নি একই কারণে। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত অপ্রত্যাশিত মুহূর্তে চিৎকার আসে না। ‘ডলস হাউসে’ নোরা যখন বের হয়ে আসে তখন চিৎকার সেও করে না। দরজার কবাটটা সজোরে বাতাসের তোড়ে শব্দ করে ওঠে। অথচ সে শব্দ গোটা ইউরোপ কাঁপিয়ে আমাদের বাংলাদেশেও এসে পৌঁছায়। তাই ধরন যাই হোক, প্রতিরোধ জারি রাখা জরুরি। সেটার উপায় পদ্ধতি যার যার সংস্কৃতি, শ্রেণি আর বর্গের সক্ষমতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। টিকে থাকতে এর বিকল্প তো নেই! কবিতা সিংহ যে অভিশাপ দেন, তাতে লিঙ্গই প্রধান হয়ে ওঠে : আর কোনো ভয় নেই কোনো ভয়/ যত গর্ভবতী ভাঙো শোক/ নিশ্চিন্ত হোক সর্বলোক/ হলুদ বসন্ত পাখি ডাকুক নির্ভীক স্বরে হোক/  গেরস্তের ঘরে ঘরে / খোকা হোক, খোকা হোক, শুধু খোকা হোক!

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *