পরিবার প্রথা ও নারীর নিয়তি
তানজিদা ইসরাত জাহান ঋতু ।। উন্নত দেশগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে পরিবার প্রথার ভাঙন ঘটছে। এই ভাঙনের সংস্কৃতি শিল্পোন্নত দেশগুলোতে শুরু হয়েছে মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই। ধীরে ধীরে এটির হাওয়া একসময় হয়তো উপমহাদেশের সমাজেও এসে লাগবে। বিষয়টিকে নানাদিক থেকে নেতিবাচকভাবে দেখছেন অনেকে। তবে উদ্ভুত নানা অসুবিধা সত্ত্বেও এর কিছু ইতিবাচক দিকও দেখা যায়।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা পরিবার প্রথার এ নিয়মে ভাঙন তুলনামূলক বেশি নারীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সামাজিক প্রথার যূপকাষ্ঠে বলি নারীদের জন্য পরিবার বরাবরই এক অন্ধকার অধ্যায়। পুরুষতন্ত্রের চাহিদানুযায়ী সে সংজ্ঞায়িত করেছে আদর্শ নারী, মা বা স্ত্রীকে, নানা বিধিনিষেধ চাপিয়ে তাকে সমাজের চোখে আদর্শ নারী হবার প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিয়ে গণ্ডি নির্ধারণ করেছে তার নিজ গৃহের সীমানায়, বেঁধে রেখেছে তাকে পরিবারের শেকলে।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে কৃষির বিকাশ ও সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণা সৃষ্টির সঙ্গেই পরিবার প্রথার উদ্ভব। যে প্রথায় বরাবর পুরুষই কেবল পালন করে এসেছে নীতিনির্ধারকের ভূমিকা। গবাদি পশু, ফসলি জমির মতই নারী পালন করে এসেছে পরিবারের কর্তা পুরুষের অস্থাবর সম্পত্তির ভূমিকা। নারীদের গণ্ডি সীমাবদ্ধ করার জন্য পুরুষেরা তাদের লুকিয়ে রেখেছেন অন্তঃপুরে, সে প্রভাব জোরদার করতে তাদের উপর আরোপ করা হয়েছে নানাবিধ ধর্মীয় ও সামাজিক বিধি বিধান, উদ্ভব ঘটেছে পর্দা প্রথার। কোনো নারী প্ৰচলিত সে পারিবারিক গণ্ডির বাইরে এক পা রাখতে চাইলেই পুরুষ তাকে আখ্যায়িত করেছে কূলটা বলে, ভ্রষ্টা বলে। তাকে দেখা হয়েছে সমাজের পক্ষে অশনি সংকেত হিসেবে, করা হয়েছে সমাজচ্যূত, কখনও বা প্রাণনাশ, বা অবাধ্যতার দায়ে তার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে রাজদণ্ড। অধিকাংশ নারী নিজেকে পরিবারের কর্তা পুরুষটির দাসী বা হাতের পুতুল ভাবতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেছে, নিজের সমস্ত নিয়তি সমর্পিত করেছে গৃহকর্মে সুগৃহিনী হয়ে, পুরুষের বেধে দেয়া স্ট্যান্ডার্ডে আদর্শ নারী হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে। তাদের বিশ্বাস করানো হয়েছে গৃহই নারীর একমাত্র ও আদর্শ স্থান, গৃহকর্মে সুনিপুণা হওয়া তার কর্তব্য, স্বামী ও সন্তান প্রতিপালনেই তার জন্মের সর্বোচ্চ সার্থকতা।
তবে সব নারী পুরুষের ফাঁকা বুলিতে সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি, তারা বেরিয়ে আসতে চেয়েছে, বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে বহুকাল থেকে প্রচারিত পুরুষতন্ত্রের তৈরি প্রহসনগুলোর বিরুদ্ধে, করে নিয়েছে মুক্তির পথ। এর প্রথম ধাপ ছিল নারীদের শিক্ষা অর্জন, ধীরে ধীরে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ, এর পরে এক সময় নারীরা পালন করতে থাকলো পুরুষের সমান সমান ভূমিকা সকল ক্ষেত্রে, বিস্তৃত জগতের সকল সেক্টরে। এরপরও নারীর শেষ রক্ষা হয়নি; নিজের পরিবার, সন্তান, রান্নাঘর ঠিকভাবে সামলে সংসারের দায়দায়িত্ব মাথায় নিয়ে তবেই সে পা রাখতে পারবে তার রোজকার কর্মক্ষেত্রে। সন্তান প্রতিপালন, সাংসারিক দায়িত্ব নির্বাহে সামান্য ত্রুটি ঘটলেই কথা শুনতে হয় নিজের স্বামী ও আত্মীয়-স্বজনের কাছে। হুমকির মুখে পড়ে তার বহির্যাত্রা, পেশা জীবন। বহু প্রতিভাময়ীর সমস্ত স্বপ্ন ও সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটে এখানেই, সন্তান ও পরিবার প্রতিপালনে, সমাজের চোখে আদর্শ স্ত্রী, মা সাজতে গিয়ে! এছাড়া বিয়ের বাজারে ভদ্র, ঘরোয়া ও গৃহকর্মে সুনিপুণা মেয়ের চাহিদা তো রয়েছেই, রয়েছে প্রচলিত বিবাহব্যবস্থায় পরিবারের সঙ্গে পরিবারের সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বে কন্যার দোষ-গুণ যাচাই করতে যাওয়ার কনে-দেখার প্রথা। যেখানে কুরবানীর হাঁটে গরুর গুণগত মান যাচাইয়ের মতনই বহুবিধ ক্রাইটেরিয়া বিবেচনায় নির্ধারিত হয় কনের দরদাম। নারীদের এখনও দেখা হয় সমাজের কাছে পরিবারের সম্মান অসম্মানের মানদণ্ড হিসেবে। যে পরিবারের নারীরা যত বেশি ভদ্র, যত বেশি ঘরোয়া, যত বেশি মুখ বুঁজে স্বামী, পিতা, শ্বশুরবাড়ির কথা শুনে গৃহকর্মে সুনিপুণা হয়ে সংসার করে যেতে পারে, সমাজে সে নারীর মূল্য তত বেশি। বিয়ের বাজারে সেরকম পাত্রীর চাহিদা আকাশচুম্বী। কোনো নারী এর বাত্যয় ঘটালেই সে হয়ে উঠবে পরিবারের অসম্মানের কারণ।
নারীই যেন নিজ পরিবারের সম্মান-অসম্মান নির্দেশের একমাত্র মাপকাঠি নির্ধারক! সে একটু বিগড়ে গেলেই, তাকে সামলানো একটু কঠিন হলেই কালি লাগবে পরিবারের গালে! সমাজ ছিঃ ছিঃ করবে,তাকে ও তার পরিবারকে করবে একঘরে! সে পাবে ভ্রষ্টা স্ত্রীলোকের তকমা। পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেমে পারিবারিক সম্মান রক্ষার দায় রুদ্ধ করছে তার মুক্ত জীবন যাপনের পথ, বাধাগ্রস্ত করছে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখছে তাকে পারিবারিক শেকলে।
পরিবার প্রথার ভাঙন তাকে অব্যাহতি দেবে সেসকল দায়দায়িত্ব হতে, স্ফুরণ ঘটাবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের, সে হবে মুক্ত মানুষ। ক্ষয় হবে প্রথাচারিতার, বিনাশ ঘটতে শুরু করবে এতদিনকার পুঞ্জীভূত প্রচলিত ধ্যান-ধারণার। প্রথাগত পরিবারের সঙ্গেই বিদায় নেবে প্রচলিত সমাজব্যবস্থার নানান রীতিনীতি, বিশ্বাস, যা নারীর জন্য এতদিন প্রতিবন্ধক রূপে ছিল!
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]