ভালো সঙ্গী নির্বাচনে নারীও চাহিদা রাখতে শিখুক
নাবিলা সোনার ।। শুরুতেই একটা ডিসক্লেইমার দিতে চাই যে, এখানে সমাজের যেসব চিত্র তুলে ধরা হবে যেগুলো সচরাচর দেখা যায়। ব্যতিক্রম উদাহরণ এই লেখার আলোচ্য বিষয় নয়।
আমি যখন বড় হচ্ছিলাম সেই সময়টায় দেখা যেত শৈশব থেকেই মেয়ে বাচ্চাদের বলা হত, “শ্বশুরবাড়িতে যেতে হবে না?” বা “শ্বশুরবাড়িতে গেলে কী করবা?” বা “কাজ শেখ। শ্বশুরবাড়িতে গেলে কিন্তু কাজ করতে হবে।” “চেহারা, হাত-পা সুন্দর রাখো। ভালো জামাই পেতে হবে না?” ‘‘এত জিদ থাকলে শশুরবাড়িতে কিন্তু মার খেতে হবে” ইত্যাদি।
পুতুলের বিয়ে খেলা দিয়ে মেয়েদের জীবন শুরু হয়। তাই পরবর্তীতে যতই পড়াশোনা, কেরিয়ার গবেষণা ইত্যাদির দিকে একটা মেয়ে ঝুঁকে পড়ুক না কেন বা অন্য যেকোনো দিকে যতই সফলতা অর্জন করুক না কেন, সে যদি সমাজের নিয়মে ঠিকঠাক সময়ে বিয়ে করতে না পারে, তাহলে অবচেতনেই মনে হতে থাকে মানুষ হিসেবে সে হয়ত বা অসফল; তার সাথে সাথে তার চারপাশের মানুষেরও তাকে সেটা মনে করানোর বিষয় তো আছেই। ফলে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েরা ‘‘বিয়ে তো করতেই হবে’’ বলে বাছ-বিচার ছাড়া একটা কাউকে বিয়ে করে বসে। হয়তো সে জানেও না সেই মানুষটার আসলে কতটুকু তার জীবনসঙ্গী হবার ক্ষমতা রাখে। শুরু হয় তারপর মেয়েটার প্রাত্যাহিক জীবনের অনেক কিছু জলাঞ্জলি দেবার পালা – চাকরি, পড়াশোনা থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধব অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের মানুষজনকেও, যাদের নিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে এসেছে, যা তার অস্তিত্ব তৈরি করেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বিয়ের পর মেয়েদের অগ্রাধিকারের অংশ হয় তার সঙ্গী এবং সঙ্গীর পরিবার।
অন্যদিকে আমাদের দেশের ছেলেদের অবস্থা একটু দেখেন। বলছি না যে আমাদের বাবা-ভাইয়েরা, স্বামীরা সংসারের জন্য কোনো স্যাক্রিফাইস করেন না। কিন্তু কখনো কোনো ছেলেকে তার শৈশবে কাউকে বলতে শুনেছেন যে ‘‘আচ্ছা তোমার তো একসময় বিয়ে হবে, তখন বউটার যত্ন কিভাবে নেবা?” বা “একটা মেয়ে যখন তোমার বাড়িতে আসবে সবাইকে ছেড়ে, তার বাবা-মায়ের তো মন খারাপ হবে। তখন তাদের জন্য কী করতে পারো?” বা “এতো রাগ তোমার? তোমার সঙ্গীন তো তোমার সাথে চলতে খুব কষ্ট হবে।”
কথাগুলো শুনতেও কত বেখাপ্পা লাগছে না? অথচ কত অবলীলায় একটা শৈশব না পেরানো মেয়ে বাচ্চাকে স্বামী-শ্বশুরবাড়ি নিয়ে জ্ঞান দেওয়া হয়। সেটা কারো কাছে কখনো বেখাপ্পা লাগেনা। তো দেখতেই পাচ্ছেন যে, আমাদের সমাজে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে সাধারনত কী শুনতে শুনতে বড় হচ্ছে সেটা পরবর্তীতে একটা বিস্তর ফারাক তৈরি করে দেয় তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে। নারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেকোনো কিছুর বিনিময়ে হোক, যে পরিবারে আসলো সেই পরিবারের সাথে, তার সঙ্গীর সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব নিজেই নিজের কাঁধে তুলে নেয় বা তাদের তুলে দেওয়া হয়। অপরদিকে পুরুষেরা বুঝতেই পারে না বা জানেই না যে তার জীবনে যে নারী আসলো তার কী দরকার, কীভাবে যত্ন নেওয়া দরকার, তার সাথে সত্যিকার অর্থে কীভাবে চলতে হবে।
আরো খেয়াল করে দেখবেন, মেয়েদের যত্ন নেওয়া শেখানো তো দূরের কথা, অনেক ছোট বয়স থেকেই একটা ছেলে দেখে তার আশেপাশের মেয়েদের সাথে কীভাবে আচরণ করা হয়। একেবারে পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে, মেয়েরা কীভাবে আচরণ করবে, কীভাবে হাসবে, কীভাবে কথা বলতে কী করবে, কী করবেনা সেসব নিয়ে কীভাবে মিলিটারী শাসনের উপর রাখা হয়। ফলে ছেলেদের এই চিন্তা মাথায় নিয়ে বড় হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে যে, একধরনের পোশাক-আশাক বা আচরণ করলেই একটা মেয়েকে ভালো মেয়ে বলা যায়। যাদের এই খোপে ফেলা যাচ্ছে না তারা খারাপ তো বটেই, তাদের নিয়ন্ত্রণ করাও তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
এই নারী-পুরুষের ডাইনামিক হয়তো বিংশ শতাব্দীতেও টিকিয়ে রাখা যাচ্ছিল। কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতে যখন নারীরা নিজেদের উন্নয়নে সচেষ্ট ও জ্ঞানার্জন থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজে পারদর্শী হচ্ছে, যখন তাদের আর সেরকমভাবে কারো উপর নির্ভর করতে হচ্ছে না, তখন আর এই ডাইনামিক কতটুকু কাজ করছে সেটা ভেবে দেখার দরকার আছে। আমার নিজস্ব নিরীক্ষন হল, আমাদের সমাজের পুরুষেরা এখনো সেভাবে এই হার না মেনে নেওয়া, প্রখর, বিভিন্ন কাজে দক্ষতাসম্পন্ন, আত্মমর্যাদাশীল, আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ একবিংশ শতাব্দীর নারীদের সাথে পথ চলার জন্য প্রস্তুতই হয়নি। যার ফলে সমাজে বিচ্ছেদের পরিমান বেড়ে যাচ্ছে। কলহ তৈরি হচ্ছে।
কেউ মানুক আর না মানুক, নারীদের উন্নতির যে সিঁড়ি তৈরি হয়েছে, এটাকে অবরুদ্ধ করে দিতে পারার সম্ভবনা কম। আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যক নারী একেবারে বুদ্ধি-বোধশক্তিহীন না হলে আগের সেই পুরনো অবস্থায় ফিরে যেতে চাইবে না। অনেকে বলতেই পারেন, এই কথাগুলো হয়তো বা আমি পশ্চিমা বিশ্ব থেকে নিয়ে এসেছি। বাঙালি সমাজ ব্যবস্থা রক্ষা করার হয়তো একটা তাগিদ অনুভূত হতে পারে অনেকের। কিন্তু আমার মনে হয়, বাঙালিদের মত উদার জাতি খুব কমই আছে অন্য দেশিয় সংস্কৃতি পালন করার ক্ষেত্রে, যেটা খুব প্রবলভাবেই চোখে পড়ে এখনকার পোশাক-আশাক বা বাচ্চাদের নামকরণের ক্ষেত্রে। সে অন্য আলোচনা। বলতে চাইছি, আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মজার ব্যাপার হল, যে সংস্কৃতি নারীদের ক্ষমতাহীন করে দিয়ে বস্তাবন্দী করে রাখতে উদ্বুদ্ধ করে সেই সংস্কৃতির প্রতি সমাজের একটা ঝোঁক লক্ষ্য করা যায়, যেকোনো অজুহাতে হোক না কেন। আর যেই আলোচনা নারীদের অধিকার বা মুক্তির কথা বলে, সেগুলো পশ্চিমা-উগ্র সংস্কৃতি। এরকম যুক্তিহীন দোহাই দিয়ে একটা ভয়ংকর চক্র প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলতে থাকে।
এই টক্সিক সামাজিক নির্মাণ হয়তো বা ভেঙ্গে দেওয়া বা নিয়ন্ত্রণ করার কিছু উপায় আছে। ছোট থেকেই একটা বাচ্চাকে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সদয় বা সহনশীল হতে শেখানো, সম্পর্কে থাকা প্রতিটা মানুষের কীভাবে যত্ন নেওয়া প্রয়োজন সেটা ছেলে-মেয়ে উভয়কেই শেখানো খুব জরুরি।
আর সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে যদি মেয়েরা কিছু বেসিক বিষয়ে অটল থাকে যে, যেমন, “আমি আমার নিজের অস্তিত্ব, ব্যক্তিত্ব, আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে কারো সাথে থাকবো না। আমি সেই মানুষকেই সঙ্গী হিসেবে চাই যার সাথে থাকার জন্য আমি এই জিনিসগুলো কম্প্রোমাইজ করবো না।” এরকম কাউকে না পেলে একা থাকার যে একটা অনিশ্চিত ভয়, যেটার পুরোটাই প্রায় সমাজের শেখানো ভয়, সেটার সাথে একটু বোঝাপড়ায় আসা। আমাদের সমাজে একটা বহুল প্রচলিত কথা আছে যে, “নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো।’’ আমার কথা হল, হয়ত কানা মামা ভালো, কিন্তু সেই কানা মামা যদি নিজের কেন চোখ নাই আর আমার চোখ আছে বলে ক্ষুব্ধ হয়ে আমার চোখটি গেলে দিতে চায়, সেই মামার চেয়ে নাই মামা ঢের ভালো।
সবশেষে বলতে চাই, যে জিনিসের চাহিদা বেশি সেটার যোগানও বেশি হয়। এতোদিন তো ছেলেদের সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে চাহিদা ছিল তথাকথিত ভালো মেয়ে, যে সংসারের সব কাজ সামলাবে, পুরুষের পরিবারের কথায় উঠবে বসবে, ইদানিংকালে সংসার তো সামলাবেই তার সাথে অর্থও উপার্জন করে পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্বও নেবে – এমন মেয়ে। এখন না হয়, নারীরাও সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সমাজে এই চাহিদা তৈরি করুক যে সঙ্গীটি হবে বন্ধুসুলভ, দয়ালু, দায়িত্ববান, যত্নবান, যে তার নেতিবাচক আবেগ খুব ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, এবং সত্যিকার অর্থেই মেয়েটির সঙ্গী হয়ে উঠতে পারে। তাহলে হয়তো বা ছেলেরাও তাদের এতদিনের গড়ে ওঠা টক্সিক মাস্কুলিন ইগো সরিয়ে রেখে একটু দয়াবান মানুষ হয়ে উঠবে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]