রিভেঞ্জ মাদার: শিশু কন্যার খুনিকে প্রকাশ্যে মেরেছিলেন যে মা
সায়মা সুলতানা ।। ম্যারিয়েন বাচমেয়ার, জার্মানির ‘রিভেঞ্জ মাদার’ হিসেবে বহুল আলোচিত এক নারী, একজন মা যিনি আদালতে বিচার সভার মাঝখানে তার সন্তানের খুনিকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন।
১৯৮১ সালের ৬ই মার্চ। তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি। ম্যারিয়েন বাচমেয়ার এক নারী এক জনাকীর্ণ আদালতে গুলি চালান। তার টার্গেট ছিল ৩৫ বছর বয়সী একজন যৌন অপরাধী যে ম্যারিয়েনের শিশু সন্তানকে হত্যা করেছিল। ম্যারিয়েনের ছোড়া ছয়টি বুলেটে বিদ্ধ হয়ে সেই লোকটি মারা যায়।
এই ঘটনার পর পরই ম্যারিয়েন একজন আলোচিত-সমালোচিত ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। তার পরবর্তী বিচারকার্যগুলোও জার্মান জনসাধারণ গভীরভাবে অনুসরণ করেছিল। এই ঘটনার পর সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নটি উঠেছিল তা হল – সন্তানখুনের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এই ধরনের কাজ কি ন্যায়সঙ্গত?
জার্মান নিউজ আউটলেট এনডিআর এটিকে “যুদ্ধোত্তর জার্মানির ইতিহাসে সবচেয়ে সাড়াজাগানো বিচারের দর্শনীয় ঘটনা” হিসাবে বর্ণনা করেছিল ।
জার্মানির “রিভেঞ্জ মাদার” হিসাবে নামকরণ করার আগে ম্যারিয়েন বাচমেয়ার ছিলেন একজন সংগ্রামী সিঙ্গেল মা, যিনি ১৯৭০ এর দশকে পশ্চিম জার্মানির লুবেক শহরে একটি পাব চালাতেন। তিনি তার তৃতীয় সন্তান এনার সাথে থাকতেন। তার বাকি দুই সন্তানকে দত্তক দিয়েছিলেন।
এনা ছিল হাসি-খুশি প্রাণবন্ত এক শিশু। ৫ই মে, ১৯৮০ এই শিশুটিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
এনডিআর-এর মতে, ঘটনার দিন সাত বছর বয়সী এনা তার মায়ের সাথে কোনো এক বিষয়ে তর্কের পরে স্কুলে যায়নি এবং সে ৩৫ বছর বয়সী প্রতিবেশী ক্লাউস গ্রাবোস্কির সামনে পড়েছিল, যে ছিল এলাকার কসাই এবং শিশুদের যৌন হয়রানি করার রেকর্ড তার আগে থেকেই ছিল।
তদন্তকারীরা পরে জেনেছিলেন, এনাকে প্যান্টিহোজ (লম্বা মোজা জাতীয় কাপড়) দিয়ে শ্বাসরোধ করে মারার আগে গ্রাবোস্কি কয়েক ঘন্টা ধরে তার বাড়িতে রেখেছিলেন। তিনি তাকে যৌন হয়রানি করেছেন কি না তা অজানা রয়ে গেছে। হত্যার পর একটি পিচবোর্ডের বাক্সে শিশুটির মৃতদেহ পাশের একটি খালের পাড়ে ফেলে দিয়েছিল গ্রাবোস্কি।
গ্রাবোস্কির বাগদত্তা পুলিশকে এই বিষয়ে তথ্য দেওয়ার পরে গ্র্যাবোস্কিকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রাবোস্কি হত্যার কথা স্বীকার করলেও সে শিশুটিকে যৌন নির্যাতনের কথা অস্বীকার করে।
খুনি দাবি করে যে – মেয়েটি তাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করার পরে সে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। গ্রাবোস্কির মতে, সাত বছরের শিশু এনা তাকে নাকি সিডিউস করার চেষ্টা করেছিল এবং সে (এনা) যদি তাকে টাকা না দেয় তবে সে তার সাথে শ্লীলতাহানি করেছে; এটি তার মাকে বলার হুমকি দিয়েছিল ।
ম্যারিয়েন বাচমেয়ার এই গল্পটি শুনে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ঘটনার এক বছর পরে যখন গ্রাবোস্কিকে এই হত্যার জন্য বিচারের জন্য আদালতে হাজির করা হয়, তখন ম্যারিয়েন প্রতিশোধপরায়ন হয়ে ওঠেন।
গ্রাবোস্কির বিচারকার্য বাচমেয়ারের জন্য অনেক বেশি হৃদয়বিদারক ছিল, কেননা গ্রাবোস্কির পক্ষের অ্যাটর্নিরা দাবি করছিল যে, গ্রাবোস্কি হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে এসব কাজ করেছিল; কয়েক বছর আগেও নাকি গ্রাবোস্কি স্বেচ্ছায় নির্বাসিত হয়েছিল তার হরমোন থেরাপির জন্য। সেই সময়ে, জার্মানিতে যৌন অপরাধীদের প্রায়ই এভাবে ট্রায়ালের পুনর্বিবেচনা রোধ করার জন্য কাস্ট্রেশন বা নির্বাসনে দেয়া হত, যদিও এটি গ্র্যাবোস্কির ক্ষেত্রে ছিল না।
লুবেক জেলা আদালতে বিচারের তৃতীয় দিনে, ম্যারিয়ান বাচমেয়ার তার ব্যাগ থেকে একটি পয়েন্ট টু টু ক্যালিবার বেরেটা পিস্তল গ্রাবোস্কি এর দিকে তাক করে ধরে আটবার ট্রিগার টেনেছিলেন। ছয়টি গুলি গ্র্যাবোস্কিকে বিদ্ধ করে এবং সে আদালতের মেঝেতে পড়ে মারা যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, বাচমেয়ার গ্রাবোস্কিকে গুলি করার পর তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। বিচারক গুয়েন্থার ক্রোগারের মতে, গ্রাবোস্কিকে পিঠে গুলি করার পরে তিনি শোকাহত মাকে বলতে শুনেছিলেন, “আমি তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলাম!”
বাচমেয়ার একটানা বলে যাচ্ছিল, “সে আমার মেয়েকে হত্যা করেছে… আমি তাকে সামনে থেকে গুলি করতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমি তাকে পিছনে গুলি করেছি… আমি আশা করি সে মারা গেছে।” দুই পুলিশ সদস্যও দাবি করেছেন যে বাচমেয়ার গ্রাবোস্কিকে গুলি করার পর তাকে “শুয়োর” বলে গালি দিতে শুনেছেন।
নির্যাতিতা এনার মা এরপর হত্যার অভিযোগে জন্য বিচারের মুখোমুখি হন।
তার বিচারের সময়, বাচমেয়ার সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে তিনি স্বপ্নে গ্রাবোস্কিকে গুলি করেছিলেন এবং আদালতের কক্ষে তার মেয়েকে সেদিন দেখেছিলেন। একজন ডাক্তার যিনি তাকে পরীক্ষা করেছিলেন বলেছিলেন, বাচমেয়ারের কাছে হাতের লেখার একটি নমুনা চাওয়াতে উত্তরে তিনি লিখেছিলেন: “আমি এটা তোমার জন্য করেছি, এনা।” তারপরে তিনি সাতটি হার্ট চিহ্ন এঁকেছিলেন সেখানে, সেটা সম্ভবত ৭ বছর বয়সী এনার জীবনের প্রতিটি বছরের জন্য।
“আমি শুনেছি তিনি (গ্রাবোস্কি) একটি বিবৃতি দিতে চেয়েছিলেন যে তার সাত বছর বয়সী মেয়ে তাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেছে” – বাচমেয়ার পরে গ্র্যাবোস্কির স্বীকারোক্তির উল্লেখ করে বলেছিলেন। “আমি ভাবলাম ভিক্টিমের সম্পর্কে পরবর্তীতে নানা মিথ্যা আসবে, আর সে আমার সন্তান ছিল।”
ম্যারিয়েন বাচমেয়ার তখন নিজে একটি পাবলিক মেলস্ট্রমের কেন্দ্রে পরিণত হন। তার বিচারকার্য এবং এমন কাজের জন্য সারাবিশ্বের মানুষ বিষয়টিতে নজর রাখতে শুরু করে।
সাপ্তাহিক জার্মান ম্যাগাজিন স্টার্ন তখন ম্যারিয়েন বাচমেয়ার এর ট্রায়াল সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে আর্টিকেল বের করেছিল, সেখানে একজন কর্মজীবী সিঙ্গেল মা হিসাবে বাচমেয়ারের জীবনকে তুলে ধরা হয়, যার জীবনের শুরুটা ছিল বেশ কঠিন। বিচারের সময় আইনি খরচ মেটানোর জন্য বাচমেয়ার তার জীবনের এই গল্পটি প্রায় $১৫৮,০০০ মূল্যে ম্যাগাজিনে বিক্রি করেছিলেন বলে জানা যায়।
পত্রিকাটি পাঠকদের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছিল। মারিয়ান বাচমেয়ার কি একজন ক্ষিপ্ত মা ছিলেন যিনি তার সন্তানের নৃশংস মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, নাকি তার এমন কাজ তাকে ‘ঠান্ডা মাথার একজন খুনি’ বানিয়েছে? অনেকে তার উদ্দেশ্যের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছিল, আবার অনেকে এই কাজের নিন্দাও করেছিল।
মামলার নৈতিক সমস্যা ছাড়াও, গুলি করার বিষয় পূর্বপরিকল্পিত ছিল কিনা এবং এটি হত্যা নাকি নরহত্যা ছিল তা নিয়েও একটি আইনি বিতর্ক ছিল। কয়েক দশক পরে, মামলার একটি তথ্যচিত্রে প্রদর্শিত একজন বন্ধু দাবি করেছিলেন যে, বাচমেয়ার গুলি করার আগে তার পাব সেলারে একটি বন্দুক নিয়ে তাকে লক্ষ্য অনুশীলন করতে দেখেছেন।
আদালত শেষ পর্যন্ত বাচমেয়ারকে পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে এবং ১৯৮৩ সালে তাকে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
অ্যালেনসবাচ ইনস্টিটিউটের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ২৮ শতাংশ জার্মান তার কৃতকর্মের জন্য তার ছয় বছরের সাজাকে উপযুক্ত শাস্তি বলে মনে করেছে। অন্য ২৭ শতাংশ এই শাস্তিকে খুব কঠিন বলে মনে করেছে যখন ২৫% এটিকে খুব হালকা শাস্তি বলে মনে করেছে।
১৯৮৫ সালের জুনে, ম্যারিয়ান বাচমেয়ার তার শাস্তির অর্ধেক সাজা কাটানোর পরে কারাগার থেকে মুক্তি পান। তারপর তিনি নাইজেরিয়ায় চলে আসেন, যেখানে তিনি বিয়ে করেন এবং ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সংসার করেছিলেন। স্বামীকে তালাক দেওয়ার পর বাচমেয়ার সিসিলিতে চলে যান। এরপর তিনি অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত না হন। পরে বর্তমান জার্মানিতে ফিরে আসেন।
জীবনের মূল্যবান অল্প কিছু সময় বাকি থাকায় বাচমেয়ার এনডিআর-এর একজন রিপোর্টার লুকাস মারিয়া বোহমারকে তার জীবনে শেষ সপ্তাহের অবস্থায় ছবি তোলার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তিনি ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৬ সালে ৪৬ বছর বয়সে মারা যান। তাকে তার মেয়ে এনার পাশেই সমাহিত করা হয়।
[বিদেশি অনলাইন পত্রিকা অবলম্বনে]