নারীর বন্ধু কে?
নাবিলা সোনার ।। সম্প্রতি বেশ কিছু ঘটনা থেকে একটা বিষয় নিয়ে চিন্তা করছিলাম। সেটা হল, মেয়েদের বন্ধু থাকা আর বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর ব্যাপারটা অন্যান্য অনেক আনফেয়ার বিষয়গুলোর মধ্যেই একটা। বিশেষ করে একটা বয়সের পরে, বিশেষ করে যখন সম্পর্কের স্ট্যাটাসে একটা পরিবর্তন আসে। আর আমাদের সমাজটাই হয়ত এমন ভাবে তৈরি যে নারীদের পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্ব থাকার চেয়ে প্রতিযোগিতার একটা মনোভাব হয়ত কাজ করে বেশি। ফলে, একজন নারী যেখানেই যাক না কেন, সে ঠিক সেরকম বন্ধুও পেয়ে ওঠে না যতজন প্রতিযোগী সে পায়।
সে অবশ্য অন্য দীর্ঘ আলোচনা। এখানে বলতে চাইছিলাম, এই যে নারীদের যে এই বন্ধুত্ব উদযাপনের ব্যাপারটা, এটা তো এক দিক থেকে নারীর বরের পরিবার তো বটেই, নারীর পরিবারসহ সে নিজেই চিন্তা করতে বসে, থাক দরকার নাই বন্ধুদের। কোনো ট্যুরের আয়োজন করা হলে দেখা যায়, বিবাহিত নারীটিকে ছাড়া অন্য সবাইকে হয়ত ইনক্লুড করা হচ্ছে। কারণ, হয়ত সাথে তার বরকেও দাওয়াত দিতে হবে আর ছেলে-মেয়ে থাকলে তো তাকেও অবশ্যই। আর সবচেয়ে বড় কথা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, নারীটিকে সাথে নেওয়া হলেও সে সেখানে বর বাচ্চা রেখে সেই ট্যুরে আনন্দ করতে যেতে চায়না। কারণ যে নারীরা এটা করে, তারা ট্যাগ পায় বখে যাওয়া নারী হিসেবে। কিন্তু একজন পুরুষকে কি এত কৈফিয়ত দিতে হয় তার বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর জন্য? বা বন্ধুদের সাথে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার জন্য?
আচ্ছা, আমাদের যে সমাজ সেখানে না হয় দূরপাল্লার ভ্রমণের প্রসংগ বাদ দিলাম। কিন্তু সাধারণ যে বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে কাটানোর একটা সময় লাগে নিজেকে হাল্কা করার জন্য, পাশে কেউ সত্যিই আছে এটা নিশ্চিত করার জন্য, বা কিছুই না! শুধু প্রতিদিনের একঘেয়ে জীবন থেকে একটুখানি বিরতি নেওয়ার জন্যে। এমন অনেক কথা, ঘটনা আমাদের জীবনে প্রতিনিয়ত ঘটে, যেটা আমরা ঠিক পরবারের মানুষদের কাছে বলতে পারিনা। যা শুধু এমন কাউকেই বলা যায় যারা কোনো জাজমেন্ট ছাড়া আমাদের কথা শুনবে এবং তাদেরকে খুব কাছের এবং আপন মনে হবে। হ্যাঁ, এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো যে বন্ধু চেনাও জরুরি।
একজন নারী, সে যাদের সাথে বড় হল, যাদের সাহচর্যে তার সত্তা গড়ে উঠলো, একটা সম্পর্কে যাওয়ার পর সে যদি এইসব মানুষের কাছ থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলে বা পরিস্থিতির চাপে তাকে নিজেকে আলাদা করে ফেলতে হয়, তখন তার আসলে থাকেটা কী? একটা নতুন সম্পর্ক, নতুন মানুষ এবং তার পরিবার ও বন্ধু-বান্ধব যারা তাকে একজন একক ব্যক্তি হিসেবে দেখার চেয়ে বেশি “অমুকের বউ”, “তমুকের মিসেস” এই পরিচয়য়েই দেখবে! কিন্তু যখন সেই নারী কোনো বিপদে পড়বে সেই নতুন সম্পর্কের কোনো ব্যক্তির কারণে, তখন কি সেই মানুষগুলোকে সত্যিই তার পাশে পাবে? উল্টো সে মানুষগুলো সেই নারীরই হাজারো দোষ বের করে অসম্মানিত করবে। এতে করে অবশ্যই তো লাভ হয় এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের। নারীকে যেভাবে পারা যা, যতভাবে পারা যায়, অসহায় করে রাখতে পারলেই তাদের দমিয়ে রাখা যাবে।
মনে আছে, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে দেখাতো, শিকারী পশুরা যে প্রাণীটিকে শিকার করতে চায়, তাকে আগে দল থেকে আলাদা করে, তারপর তাকে আক্রমন করে। আমাদের সমাজে বিয়ের পর নারীদের বিভিন্ন ছলে বলে কৌশলে তাদের যে একটা সাপোর্ট সিস্টেম থাকে, সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা হয়। অনেকটা কি মিল পাওয়া যায়? আর সব চাইতে এখানে দুঃখের ব্যাপার তখন ঘটে, যখন নারী নিজেই তার নিজস্ব সবাইকে ছেড়েছুড়ে দিয়ে সেই অচেনা একটা পরিবার-পরিস্থিতিতে গিয়ে নিজেই নিজেকে আলাদা ফেলে!
তাই এটা খুব জরুরি নারীর জন্যে যে তাদের এমন কিছু মানুষকে কাছে রাখা এবং সেই সম্পর্কগুলোর যত্ন নেওয়া, যারা তার সত্যিকার অর্থেই শুভাকাঙ্ক্ষী। এরকম মানুষগুলোকে চেনা সবার আগে জরুরি। তাদের সাথে সময় কাটানো জরুরি। কোনো বিপদ আসলে যেন কাউকে পাশে পাওয়া যায়। যুদ্ধে গেলেও কিন্তু তলোয়ারের সাথে ঢাল লাগে। ঢাল ছাড়া বের হলে তো মরার সম্ভাবনাও বেশি থাকে, তাই না?
আর এরকম শুভাকাঙ্ক্ষী, বন্ধু-বান্ধব পাশে রাখার সাথে সাথে আমাদের নিজেদেরও চেষ্টা থাকা উচিত যেন আমরা নিজেরাও অন্য কারো সেই বন্ধু, সেই শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠতে পারি।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]