February 23, 2025
ফিচার ২ফিটনেস ও সুস্থতা

নারীর স্বাস্থ্য ও সংকট: জানতে ও বুঝতে হবে

তানজিয়া রহমান ।। সুস্বাস্থ্য মানে শুধু শারীরিক সুস্থতা নয়। মানসিক, সামাজিক সুস্থতাও জরুরি।। নারীদের স্বাস্থ্য পুরুষদের স্বাস্থ্য থেকে বেশ আলাদা। পুরুষদের স্বাস্থ্যের তুলনায় মহিলাদের প্রজনন ও যৌন স্বাস্থ্যের একটি স্বতন্ত্র পার্থক্য রয়েছে। তাছাড়াও তাদের আরও দীর্ঘস্থায়ী অ-প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যাও দেখা যায়। যেমন- কার্ডিওভাসকুলার, রক্তস্বল্পতা, ক্যান্সার, বিষন্নতা, ডিমেনশিয়া, ডায়াবেটিস এবং অস্টিওপোরোসিস।

কার্ডিওভাসকুলার হচ্ছে হৃৎপিণ্ড বা রক্তনালীর সাথে জড়িত যেকোনো রোগ। যেমন- হার্ট ফেইলিউর, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, হঠাৎ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট।

রক্তস্বল্পতা নিম্ন আয়ের দেশের নারীদের বেশি দেখা যায়। এসব দেশে আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব দেশে পরিবারে সদস্য সংখ্যা বেশি থাকে। যেহেতু আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি তাই পরিবারের সকলের পরিমিত খাদ্য নিশ্চিত হয় না। এক্ষেত্রে মহিলারা সন্তান এবং পুরুষের খাদ্য আগে নিশ্চিত করে। অধিক সন্তান জন্ম দেয়া এবং খাদ্যের অভাবের ফলে মহিলাদের মধ্যে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।

ক্যান্সার পুরুষদের তুলনায় নারীদের বেশি হয়। বিশেষ করে জরায়ু ক্যান্সার, ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার এবং ফুসফুসে ক্যান্সার। নারীদের বাল্যবিবাহ, অপ্রাপ্ত বয়সে যৌনমিলন, অপ্রাপ্ত বয়সে গর্ভধারণ, অনিরাপদ গর্ভাবস্থা এবং সন্তান প্রসব, পিরিয়ডকালীন পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত না হওয়া এসব কারণে জরায়ু ক্যান্সার এবং ডিম্বাশয়ে ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাছাড়া বিভিন্ন উপসর্গ পরিলক্ষিত হওয়ার পরেও চিকিৎসকের কাছে না যাওয়া। সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু না করার ফলে ক্যান্সার এমন স্তরে পৌঁছায় যেখান থেকে সুস্থ হওয়ার সম্ভবনা খুব কমই থাকে। তাছাড়া ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালানোও সহজ হয় না।

বিষন্নতা মৃত্যুও ঘটাতে পারে। বিষন্নতার ফলে দুঃখ, হতাশা, নিরাশা, চিন্তা ভাবনা ও মনোযোগে অসুবিধা, ক্ষুধা ও ঘুমের বেশ-কম, আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। শৈশবে প্রতিকূলতা যেমন শোক, অবহেলা, মানসিক নির্যাতন, শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, ভাইবোনদের প্রতি পিতা- মাতার অসম আচরণ, পিতা- মাতার মধ্যে ঝগড়া, সুসম্পর্কের অভাব যৌবনে বিষণ্নতায় অবদান রাখতে পারে। বিশেষ করে শৈশবকালীন শারীরিক বা যৌন নির্যাতন বেঁচে থাকা ব্যক্তির সারা জীবন ধরে বিষন্নতার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনার সাথে উল্লেখযোগ্যভাবে জড়িত। তাছাড়া বিবাহ, সন্তানের জন্ম, মেনোপজ, আর্থিক অসুবিধা, বেকারত্ব, বিভিন্ন চাপ (যেমন কাজ, শিক্ষা, পরিবার, জীবনযাত্রার অবস্থা, বিবাহ ইত্যাদি), বিভিন্ন রোগ (ক্যান্সার, এইচআইভি, ডায়াবেটিস, ইত্যাদি), প্রিয়জন হারানো, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, বিচ্ছেদ এসব কারণেও বিষন্নতা দেখা যায়।

আমাদের আশেপাশেই ডিমেনশিয়া রোগী দেখা যায়। ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির চিন্তা করার এবং মনে রাখার ক্ষমতা হ্রাস, মানসিক সমস্যা, ভাষার সমস্যা, অনুপ্রেরণা হ্রাস, জ্ঞানীয় ক্ষমতার সাধারণ হ্রাস পরিলক্ষিত হয়।

ডায়াবেটিস নারী পুরুষ সকলের হলেও নারীদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস দেখা দেয়। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সন্তান প্রসব পর্যন্ত স্থায়ী হয়। যদিও এটি ক্ষণস্থায়ী, তবে চিকিৎসা না করা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ভ্রূণ বা মায়ের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে।

অস্টিওপোরোসিস পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে সাধারণত বেশি দেখা যায়। উন্নত বিশ্বে, রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতির উপর নির্ভর করে, ২% থেকে ৮% পুরুষ এবং ৯% থেকে ৩৮% মহিলা আক্রান্ত হয়। উন্নয়নশীল বিশ্বে রোগের হার অস্পষ্ট। ২০১০ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রায় ২২ মিলিয়ন মহিলা এবং ৫.৫ মিলিয়ন পুরুষের অস্টিওপোরোসিস হয়েছিল। ভিটামিন ডি এর অভাব, অপুষ্টি এসব কারনে অস্টিওপোরোসিস হতে পারে।

তাছাড়া মহিলাদের স্বাস্থ্যের অনেক সমস্যা তাদের প্রজনন স্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত, যার মধ্যে রয়েছে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য, যৌনাঙ্গের স্বাস্থ্য, স্তনের স্বাস্থ্য, পিরিয়ড এবং মেনোপজসহ হরমোনাল স্বাস্থ্য মহিলাদের স্বাস্থ্যের একটি বিস্তৃত ধারণা।

ঋতুস্রাব নারী অঙ্গের একটি নিয়মিত চক্র। প্রথম শুরু হয় ৯ থেকে ১৬ বছর বয়সের মধ্যে। এটা সাধারণত ভৌগোলিক আবহাওয়া, শারীরিক শক্তির উপর নির্ভর করে হয়ে থাকে। তারপর থেকে প্রতিমাসে নিয়মিতভাবে হয়। এই চক্র আটাশ দিন পর পর বা তার কিঞ্চিৎ আগে বা পরেও হতে পারে। এই সময় ব্যাপক শারিরীক পরিবর্তন ঘটে। পিরিয়ড চলাকালীন সময়ের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা খুবই জরুরি। অপরিষ্কার অন্তর্বাস, পুরোনো কাপড় কোনোভাবেই ব্যবহার করা উচিত না। নির্দিষ্ট সময় পর পর প্যাড পরিবর্তন করা উচিত। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পিরিয়ড একটি ট্যাবু। এইসব দেশের মেয়েরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দীর্ঘ সময় ধরে অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করে। এর ফলে এইসব অঞ্চলে জরায়ু সম্পর্কিত নানা রোগের হারও বেশি। আবার যেহেতু পিরিয়ড এখনো ট্যাবু, তাই এসব অঞ্চলের মেয়েদের পিরিয়ডজনিত যেকোনো সমস্যাও বেশি। যেমন অনিয়মিত পিরিয়ড, প্রচন্ড ব্যাথা, অধিক রক্তস্রাব। কিন্তু এসব সমস্যা নিয়ে তারা চিকিৎসকের কাছে যায় না। এদের বেশিরভাগই মনে করে বিয়ে এবং সন্তান হলে এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

যেসব মেয়েকে শিশু অবস্থায় বিয়ে দেয়া হয় তাদের প্রায়ই গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে এবং প্রসবের ফলে স্বাস্থ্যের উপর প্রতিকূল প্রভাব পড়ে। গর্ভধারণের ফলে একটি অল্পবয়সী নারীর জীবনে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মাতৃমৃত্যুর হার অনেক বেশি, যা সন্তান জন্ম দেয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যে ঘটে। অল্প বয়সে গর্ভধারণ, চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে না থাকা, চিকিৎসাকে পরামর্শ না মানা, গৃহে সন্তান প্রসব, রক্তক্ষরণ, বাধাপ্রাপ্ত প্রসব এসব মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ। তাছাড়া অনুন্নত রাস্তাঘাট, পরিবহন সেবার ঘাটতি, অদক্ষ চিকিৎসাকর্মী, স্বাস্থ্য সেবার ঘাটতি, চিকিৎসার সরঞ্জামের অভাবও ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

মেনোপোজ মহিলাদের জীবনের একটি বিশেষ অধ্যায়। সাধারণত ৪৩ থেকে শুরু করে ৫৩ বৎসরের মধ্যে নারীর মেনোপোজ হয়ে যায়। মেনোপোজ শুরুর সঙ্গে-সঙ্গে মহিলাদের জীবনে শারীরিক ও মানসিক নানা ধরনের পরিবর্তন দেখা দেয়। অনিয়মিত পিরিয়ড এ সময় শুরু হয়। কখনো একটু বেশি রক্তস্রাব, কখনো কম রক্তস্রাব যেতে পারে। অনেকদিন ধরে অল্প ফোঁটা ফোঁটা রক্ত যেতে পারে। কমপক্ষে সাধারণত ছয় মাস একটানা রক্তস্রাব বন্ধ থাকলে ধরে নেয়া যায় যে মেনোপজ হয়ে গেছে। এই সময় হঠাৎ করেই মাথা গরম বা হট ফ্লাস, বুক ধড়ফড়, অতিরিক্ত ঘুমানো, অনিদ্রা, প্রস্রাবে সমস্যা, ওজন বেড়ে যাওয়া, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া বা মুড চেঞ্জ ইত্যাদি হতে পারে। লাইফস্টাইল দ্বারা এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর নারীরা পরিবারের বোঝা হিসেবে গণ্য হয় বেশিরভাগ সময়। নারীদের মৌলিক চাহিদা সুনিশ্চিত হয় না। তারা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা কোনোটাই ঠিক মতো পায় না। মহিলাদের স্বাস্থ্য তাদের সামাজিক অবস্থার দ্বারাও প্রভাবিত হয়। যেমন – দারিদ্র্য, কর্মসংস্থান, পারিবারিক দায়িত্ব এই দিকগুলিও রয়েছে। নারীরা ঐতিহ্যগতভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান এবং ক্ষমতার দিক থেকে সুবিধাবঞ্চিত হয়, যার ফলে স্বাস্থ্যসেবাসহ জীবনের প্রয়োজনীয়তাগুলিতে তাদের প্রবেশাধিকার হ্রাস পায়। স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে লিঙ্গ ব্যবধান আরও তীব্র হয় উন্নয়নশীল দেশগুলিতে যেখানে নারীরা তুলনামূলকভাবে বেশি সুবিধাবঞ্চিত। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে মহিলাদের খাদ্য, ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থের অভাব হয়, যার ফলে এইসব দেশের মহিলাদের পুষ্টির ঘাটতি চরম মাত্রায় পৌঁছায়।

Leave a Reply