সম্পর্ক ঠিক করতে সন্তান নেওয়া: কতটুকু লাভ, কতটুকু ক্ষতি
তৌকির ইসলাম ।। আজ একটু ভিন্ন একটা বিষয়ে লিখব বলে ভাবছি। ভাবনার পেছনের কারণ হচ্ছে একজনের প্রশ্ন এবং প্রশ্নের মূল জিজ্ঞাস্য হচ্ছে একটি খারাপ সম্পর্ক ভাল করতে সন্তান গ্রহণ উচিত কি না বা এই টাইপ।
এই প্রশ্নটিকে আমি কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে চাই, তা হলো – সম্পর্ক, সন্তান ধারণ এবং সম্পর্কের উন্নতি। সামাজিক কিংবা জৈবিক কারণে হোক, কিংবা মানসিকভাবে হোক, অধিকাংশ মানুষ সঙ্গী চায়। মানুষ এই সঙ্গী কোনো সম্পর্কের মাধ্যমে চায় স্থায়ী করতে। সেই হিসেবে বিয়ে একটি মাধ্যম দুটি মানুষের একে অপরকে সঙ্গী করার। এখন এই সম্পর্কে শুধু মাত্র দুটি মানুষ নন, যুক্ত হয় পরিবারও। বিয়েকে আমি সম্পর্কের মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করছি কারণ ভারত উপমহাদেশে এখনো পরিবার গঠনের উপায় বিয়ে। এখন বর্তমান সময়ে ডিভোর্সের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সম্পর্কে নতুন নতুন টানাপোড়েন দেখা যাচ্ছে। সাথে যুক্ত হচ্ছে পরিবার। সম্পর্কে যখন টানাপোড়েন দেখা দেয় তখন উপমহাদেশের অধিকাংশ পরিবার সমস্যার সহজ সমাধান খুঁজতে যান। এবং সমস্যার সহজ সমাধান হিসেবে তারা দেখেন সন্তান নেওয়া।
এখন এই সন্তান ধারণ ঠিক কতটুকু যৌক্তিক? একটা সম্পর্ক যখন খারাপ সময়ের মধ্যদিয়ে যায়, প্রথমে উচিত সমস্যার উৎস এবং তার সমাধান করা। কেননা সন্তান ধারণ কোন সমাধান নয়। একজন নতুন মানুষকে এই জগতে আনার জন্য চাই দুইজন মানুষের মধ্যে একটি স্থিতিশীল সম্পর্ক। নতুবা সেই সন্তান পরিবারের খুশির কারণ হতে পারে কিন্তু দুইজন মানুষের সম্পর্ক ঠিক করতে পারে না। বরং তখন একটা খারাপ হয়ে যাওয়া সম্পর্কে দুইজন আটকে যায়। সমাজ ও পরিবার ভাবে, মানুষ দুটি সুখে আছে। আসলে সেই সম্পর্কে না থাকে মানুষ দুটো সুখি, না সন্তান। খারাপ হয়ে যাওয়া সম্পর্ক আরো বেশি জটিল হয় পরিবারের অতিরিক্ত জড়িত থাকার জন্য। এবং আমি বাংলাদেশে এমন পরিবার পাইনি যেখানে সম্পর্ক ভালো করার জন্য কেউ বলবে একজন কাপল থেরাপিস্টের কাছে যাওয়ার কথা, দুইজন একসাথে কোয়ালিটি টাইম কাটানোর কথা। কিন্তু বলবে সন্তান নাও।
এখন কথা হলো কেন তারা সন্তান ধারণের কথা বলেন। আমি পরিবারের সদস্যদের বিশেষ করে মেয়ের পরিবারের এমন মনোভাব দেখেছি যে সন্তান ধারণ করলে তো স্বামী আর সেপারেশনে যাবে না সন্তানের দিকে তাকিয়ে আর মেয়েকে বোঝাতে থাকে সন্তান হলেই স্বামীর ভালোবাসা বেড়ে যাবে। ব্যাপারটা কতটুকু প্রভাব ফেলে তা জানি না কিন্তু পরিণতি অনেক ভালো, এমন দেখি নি। মাঝখান দিয়ে নতুন একটা মানুষ আসে। সে আসলে সম্পর্কটা ভালো করতে পারে না। উপরন্তু সম্পর্ক ভালো করার দায়িত্ব তার নয়। তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেটা ঘটে, নতুন মানুষটার কথা ভেবে বাকি দুইজন কম্প্রোমাইজ করতে শুরু করে বিশেষ করে মেয়ের দিকে।
এদিকে এই খারাপ সম্পর্ক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাচ্চার উপর প্রভাব ফেলে। আসলে এই সমাজে ডিভোর্স ব্যাপারটা অনেক কঠিন বানানো হয়েছে। সিঙ্গেল মাদার হওয়াকে করে ফেলা হয়েছে আরো কঠিন। তার উপর সম্পর্কের উন্নতির জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে থাকে না বাস্তবতাপূর্ণ কোনো পদক্ষেপ
সম্পর্কের উন্নতির জন্য দরকার পার্টনারের জন্য থেরাপিস্ট, কোয়ালিটি টাইম কাটানো ইত্যাদি। সম্পর্কে আপস অ্যান্ড ডাউনস থাকবে, কিন্তু তার সমাধানের জন্য সন্তান নয়, নিজেদের চেষ্টা করতে হবে। ডিভোর্স, সেপারেশন, সিঙ্গেল প্যারেন্টহুড – এগুলো সম্পর্কে জ্ঞানের বিকাশ থাকা দরকার। দাম্পত্য সম্পর্ক ভালো রাখতে সুস্থ যৌনতা সম্পর্কেও জ্ঞান রাখা প্রয়োজন। সম্পর্কে পরিবার তৃতীয় পক্ষ। যত কম সম্ভব তাদের জড়ানো উচিত। আপনার সম্পর্কের ভবিষ্যৎ আপনার অনাগত সন্তান নয়, আপনাকেই ঠিক করতে হবে। আর সন্তান হলেই যে একটা খারাপ সম্পর্কে নিজেকে শেষ করতে হবে তা নয়।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]