April 7, 2025
ফিচার ১সাক্ষাৎকার

‘‘ফেমিনিস্টদের আরও নম্র, ধৈর্যশীল ও কোমল ভাষায় কথা বলা শিখতে হবে’’

কামলা ভাসিন ছিলেন একজন ভারতীয় উন্নয়নমূলক নারীবাদী কর্মী, কবি, লেখক ও সমাজবিজ্ঞানী। ১৯৭০ সাল থেকে তিনি লিঙ্গ শিক্ষা, মানব উন্নয়ন ও গণমাধ্যম নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি দিল্লিতে থাকতেন।
২০১৮ সালে, ফেমিনিজম ইন ইন্ডিয়া’র সাংবাদিক মিনি সাক্সেনা তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেন। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য সেই সাক্ষাৎকারটি বাংলায় অনুবাদ করে দেওয়া হলো। 

মিনি সাক্সেনা: আপনাকে এই উন্নয়নমূলক নারীবাদী কাজের দিকে কী টেনেছিল? কীভাবে আপনি এই কাজ শুরু করলেন?

কামলা ভাসিন: আমি রাজস্থানের গ্রামে বড় হয়েছি, সরকারি স্কুলে পড়াশোনা করেছি। স্বাধীনতার কিছুদিন পরের সময় ছিল সেটা। পরে আমি জার্মানিতে দুই বছর পড়াশোনা করি। তারপর আমি সিদ্ধান্ত নিই দেশে ফিরে গ্রামে কাজ করব।

তাই ১৯৭০ সালে আমি আমার সরকারি চাকরি ছেড়ে ফিরে আসি। উদয়পুরে ‘সেবা মন্দির’ নামে এক সংস্থায় কাজ শুরু করি। প্রথমে আমার চিন্তা ছিল দারিদ্র্য আর অশিক্ষা নিয়ে। পরে আমি অনেকদিন পানি উন্নয়ন নিয়ে কাজ করি।

১৯৭৪ সালের দিকে একটি সংস্থা আমাকে ভারতের নারীদের নিয়ে একটি কনফারেন্সে আমন্ত্রণ জানায়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ নারী কর্মী সেখানে ছিলেন। আমি সেই কনফারেন্সের লেখাগুলো সম্পাদনা করে একটা বই বানাই। পরে আমি ১৯৮৫ সালে নাইরোবি আর ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে জাতিসংঘ কনফারেন্সে অংশ নিই। আমি “Role of Women in India” নামে বই সম্পাদনা করি।

একজন আমেরিকান নারী সেবা মন্দিরে এসেছিলেন, তিনি আমাকে পছন্দ করেন এবং আমাকে এক বছরের জন্য একটা বিখ্যাত নারীবাদী ম্যাগাজিনের সাবস্ক্রিপশন উপহার দেন। তখনো আমি “ফেমিনিজম” শব্দটাই জানতাম না!

আমি খুব বেশি পড়ার মানুষ নই, কিন্তু ’৮০ সালের দিকে আমি সিমোন দ্য বোভোয়ার-এর নাম শুনি, তার বই একটু পড়ি (যদিও বইটা অনেক বড় আর কঠিন!)। এরপর আমি নারীবাদ নিয়ে আরও ভাবা শুরু করি, লেখাও শুরু করি।

১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ আমাকে তাদের সঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব দেয়। আমার কাজ ছিল প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম অর্গানাইজ করা। কয়েকটা ওয়ার্কশপ করার পর আমি শুধু নারীদের জন্য ওয়ার্কশপ করতে শুরু করি। ১৯৭০ থেকে ২০০২ পর্যন্ত আমি অনেক সংস্থার সাথে কাজ করেছি যারা উন্নয়ন আর দারিদ্র্য নিয়ে কাজ করত। এই কাজের ভেতরেই আমি আমার নারীবাদ নিয়ে এসেছি।

১৯৭৯ সালে আমি প্রথমবার দিল্লিতে থাকতে শুরু করি কারণ আমি তখন জাতিসংঘে কাজ করছিলাম। সে সময় আমি অন্য নারীবাদী কর্মীদের সাথে পরিচিত হই। সেই সময়ই ঘটে মাতুরা ধর্ষণ মামলা আর পণ নিয়ে অনেক নারীর মৃত্যু হচ্ছিল।

আমরা তখন একটা নাটক করেছিলাম, নাম ছিল “ওম স্বাহা”, যা পরে খুব বিখ্যাত হয়। আমি প্রথম দিন থেকেই সেই নাটকে ছিলাম, অভিনয় করতাম। ১৯৭৭ বা ১৯৭৮ সালের দিকে আমি নারীদের নিয়ে গান লেখা শুরু করি। যেমন আমার লেখা “তোড় তোড় কে বন্ধনোঁ কো” গানটা আমি ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশের এক ওয়ার্কশপে লিখেছিলাম।

আমি ১৯৬১ সালে কলেজে আবহা ভাইয়ার সঙ্গে পড়েছিলাম। তখন ও-ও দিল্লিতে ছিল। ও, আমি, গৌরী চৌধুরী, অমৃতা ছাচ্চি, শেবা ছাচ্চি, উর্বশী বুটালিয়া, গীতা সাহগাল (যিনি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালে কাজ করতেন), মায়া রাও (অভিনেত্রী)—আমরা সবাই একসাথে কাজ করতাম। তখনই “সাহেলি” শুরু হয়।

১৯৭৯ বা ১৯৮০ সালের দিকে, আবহা ও বাকিদের সাথে মিলে আমরা ১০ দিনের নারীবাদী ওয়ার্কশপ অর্গানাইজ করা শুরু করি। আমরা অনেকগুলো ওয়ার্কশপ করেছিলাম তখন।

১৯৮৪ সালের দিকে, আমরা সাতজন মিলে “জাগোরি” শুরু করি। যদিও আমি ওখানে ফুলটাইম কাজ করিনি বা কোনো লিডিং রোলে ছিলাম না; আমার বই, গান, পোস্টার ওরা প্রকাশ করেছে। আমি বুঝতে পারি শুধু বই বা লেখা যথেষ্ট না—কাজটা মানুষের মধ্যে পৌঁছাতে গান, পোস্টার, স্লোগান খুব দরকার।

আমার সন্তানদের জন্য যখন গান লিখতাম, সেগুলোও স্বাভাবিকভাবেই নারীবাদী ছড়া হতো। ইউনিসেফ আর জাগোরি পরে সেগুলো প্রকাশ করে।

আমি তখনো জাতিসংঘে কাজ করতাম, তাই অনেকে আমাকে “আসল” নারীবাদী ভাবতো না! কিন্তু আমি যেসব কাজ করি, সেগুলো হৃদয় দিয়ে করি।

মিনি সাক্সেনা: “জাগোরি” শুরু করার সময় কী কী চ্যালেঞ্জ ছিল? তখনকার নারীবাদী আন্দোলনের পরিবেশ আর এখনকার মধ্যে কী পার্থক্য দেখেন?

কামলা ভাসিন: “সাহেলি” তো কাজ করছিলই, কিন্তু আমরা অনেকেই ভাবতাম যে এমন একটা সংগঠন দরকার, যেখানে ফুলটাইম কাজ করা যাবে। তাই আমরা একটা সংগঠন গড়ে তুলি, যেখানে কিছু মানুষ ফুলটাইম কাজ করবে। তখন আমরা ফান্ডিং নেওয়াও শুরু করি, যদিও সেটা নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক ছিল। কিছু নারীবাদী ফান্ডিংয়ের পক্ষে ছিল না। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি, যদি ফুলটাইম কাজ করতে হয়, তাহলে টাকা দরকার।

জাগোরিকে বলা হয় “উইমেন্স রিসোর্স অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার”, মানে এখানে বই প্রকাশ, ওয়ার্কশপ, আর বিভিন্ন NGO বা গ্রুপের সাথে নেটওয়ার্কিং হতো। জাগোরি সব ধরনের ক্যাম্পেইনে অংশ নিত।

শুরুর দশ বছর আবহা এই সংগঠন চালাত। আমরা তখন আবহার সাউথ এক্সটেনশনের দুই কামরার ফ্ল্যাট থেকে কাজ করতাম। অনেক বছর পর আলাদা অফিস হয়। আমরা কিছু ফিনান্সিয়াল সাপোর্ট আর কর্মী পাই। তখন খুব উত্তেজনাপূর্ণ সময় ছিল।

তখন আমরা ভাবতাম আমাদের সংগঠনটা হবে নন-হায়ারার্কিক্যাল, মানে কারো ওপরে কেউ থাকবে না, সবাই সমান। কিন্তু এখন ফান্ডিং, ডোনার, কনসালট্যান্ট—এসব আসার পর ওই আদর্শগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে।

ফান্ডিং এর সঙ্গে সঙ্গে আসে শর্ত—প্রজেক্ট প্রপোজাল, রিপোর্ট, মনিটরিং, ইভ্যালুয়েশন সবকিছু করতে হয়। NGO-র কাজ কিছুটা আমলাতান্ত্রিক হয়ে যায়। “জেন্ডার” শব্দটা আমি ১৯৮৬ বা ৮৭ সালের আগে শুনিইনি!

আমি প্রথমে “জেন্ডার” নিয়ে সন্দিহান ছিলাম। তখন থেকেই “জেন্ডার স্টাডিজ” শুরু হলো, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “জেন্ডার এক্সপার্ট” বের হচ্ছিল। কিন্তু আমাদের মতো মাঠের কর্মীরা তো কোনো থিওরি জানতাম না, শুধু কাজ করতাম। তখন এক ধরনের টানাপোড়েন ছিল—একাডেমিক নারীবাদী বনাম অ্যাকটিভিস্ট নারীবাদী।

এই সময়েই “ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ উইমেন’স স্টাডিজ (IAWS)” তৈরি হয়। আমি শুরু থেকেই ওদের সাথে জড়িত ছিলাম। দু’বছর ওদের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলাম। ওরা একাডেমিক আর অ্যাকটিভিস্ট নারীবাদীদের মধ্যে দারুণ সংযোগ তৈরি করেছিল।

আমি ওদের একটা বড় জাতীয় কনফারেন্স অর্গানাইজ করেছিলাম, যেটা জয়পুরে হয়েছিল। আমি তখন প্রস্তাব দিই, পার্শ্ববর্তী দেশের নারীবাদীদেরও আমন্ত্রণ জানানো হোক। আমরা তখন “সাউথ এশিয়ান ফেমিনিস্ট” সেকশন তৈরি করি IAWS-এ।

মিনি সাক্সেনা: আপনি নিজেকে “সাউথ এশিয়ান ফেমিনিস্ট” হিসেবে পরিচয় দেন। আপনি তো ভারত ছাড়াও বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা—সবখানেই নারীবাদী আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। এই সংহতির ধারণা কিভাবে গড়ে উঠল?

কামলা ভাসিন: ১৯৮০-৯০’র দশকে আমরা বুঝতে পারি, দক্ষিণ এশিয়ার অনেক সমস্যাই এক—চাই সে দারিদ্র্য হোক, পিতৃতন্ত্র, ধর্মীয় মৌলবাদ, কিংবা মিলিটারি শাসন। তখন আমরা ভাবলাম, আলাদা আলাদা কাজ না করে একসাথে কাজ করলেই তো বেশি শক্তি পাওয়া যায়।

আমার মনে আছে, পাকিস্তানের মারভি মাজহার, বাংলাদেশের নারীনেত্রী সেলিনা হোসেন, নেপালের বীনা ঠাকুর, শ্রীলঙ্কার জেফা—সবাই মিলে আমরা এক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করি। আমরা তখন নিজেদের বলতাম “সাউথ এশিয়ান ফেমিনিস্ট নেটওয়ার্ক”।

আমরা একে অপরের দেশে গিয়ে মিটিং করতাম, একসাথে ওয়ার্কশপ করতাম, গান গাইতাম, কবিতা পড়তাম। “হাম ভারত-পাকিস্তান কি নারীয়াঁ এক হ্যায়”—এই ধরনের স্লোগান দিতাম।

এই সংহতির একটা দারুণ দিক ছিল যে আমরা একে অপরের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতাম। যেমন, বাংলাদেশে তখনকার দিনে অনেক নারী লেখক দারুণ কাজ করছিলেন—তাদের লেখা আমাদের অনুপ্রাণিত করত।

এই সংযোগগুলোই পরে “সঙ্গত” নামের প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলে, যেখানে আমি দীর্ঘদিন ধরে জড়িত ছিলাম। আমরা ফেমিনিস্ট থিওরি, গান, কবিতা, অ্যাকটিভিজম—সব কিছু একসাথে মিলিয়ে কাজ করতাম।

আমার তো মনে হয়, পিতৃতন্ত্র যেমন একটা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা, নারীবাদও হওয়া উচিত আন্তর্জাতিক—কিন্তু সেটা উপনিবেশিক কাঠামোর মধ্যে না গিয়ে, নিজেদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে।

মিনি সাক্সেনা: আপনি তো পরে “সঙ্গত” নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ শুরু করেন। কেন আপনার কাছে দক্ষিণ এশীয় নারীবাদী সংযোগটা এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল?

কামলা ভাসিন: দেখো, আমি কখনোই খুব জাতীয়তাবাদী ছিলাম না। ছোটবেলা থেকেই আমার মনে হয়েছে, আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা খুব দরকার।
আমি জন্মেছি পাকিস্তানে। তারপর রাজস্থানের গ্রামে বড় হয়েছি, যেখানে আমাদের পরিবারে সবসময় মুসলিম আর শিখ বন্ধুরা ছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই আমি বুঝেছি—মানুষে মানুষে সংযোগটাই সবচেয়ে জরুরি।

যখন আমি ডেভেলপমেন্টের কাজ শুরু করলাম, তখন দেখলাম মানুষ উন্নয়নের জন্য ইউরোপ-আমেরিকায় পড়তে যাচ্ছে! আমি ভাবলাম, যদি আমরা গ্রামের মানুষের জন্য কাজ করি, তাহলে আমাদের তো পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল—এই দেশগুলোর কাছ থেকে শেখা উচিত। কারণ আমাদের সমস্যাগুলো তো এক!

১৯৭৫ সাল থেকে আমি এই ধরনের সংযোগ তৈরি করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমি চেয়েছিলাম, যারা শান্তি, মানবাধিকার, উন্নয়ন আর নারীবাদের জন্য কাজ করে, তারা যেন একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে, একসাথে শেখে, একসাথে কাজ করে।

সঙ্গত-এর মাধ্যমে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার অনেক নারীবাদীকে একসাথে নিয়ে আসতে পেরেছি। আমাদের কোর্সগুলোতে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা থেকে মেয়েরা এসে অংশ নিত। কেউ কেউ ফিরে গিয়ে আমার বই নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করত—তুর্কি, আরবি, বাংলা, সব ভাষায়।

এই জন্যই আমি সবসময় বলি—শান্তি, মানবাধিকার, নারীবাদ আর উন্নয়ন—এই চারটা জিনিস আলাদা না। এরা একে অপরের সঙ্গে জড়িত। আমরা সবসময় একসাথে এগিয়ে গেছি।

মিনি সাক্সেনা: আপনি প্যাট্রিয়ার্কি (পুরুষতান্ত্রিকতা) আর পুঁজিবাদের মধ্যে কী সম্পর্ক দেখেন?

কামলা ভাসিন: এই ব্যাপারটা অনেক পুরনো। যখন ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা এল, তখন থেকেই পুরুষেরা চাইল—তাদের সম্পত্তি যেন তাদের ছেলেদের কাছেই যায়। কিন্তু সমস্যা হলো—তাদের তো নিশ্চিতভাবে জানা নেই, কার সন্তানটা আসলে তাদের। তখনই শুরু হলো—নারীদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা।
এই নিয়ন্ত্রণটাই পুরুষতন্ত্র। আর এই নিয়ন্ত্রণ যত বেশি, তত বেশি নারীরা কষ্টে পড়ে।

পুঁজিবাদ আর পুরুষতন্ত্র একে অপরের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। কারণ পুঁজিবাদ সস্তা শ্রম চায়, আর নারীরাই সবচেয়ে সস্তা শ্রমিক। ঘরের কাজ, বাচ্চা পালন—সব কিছু বিনা মজুরিতে!

তবে হ্যাঁ, পুঁজিবাদ নারীদের কিছু স্বাধীনতার সুযোগও দিয়েছে। কিছু নারী ঘরের বাইরে এসে কাজ করতে পেরেছে। যদিও বেশিরভাগ নারী এখনো অনানুষ্ঠানিক খাতে (informal sector)-এ কাজ করছে, তবুও এটা একটা শুরু ছিল।

কিন্তু পুঁজিবাদ শুধু কাজ নয়—বাজারও চায়। তারা যুদ্ধকে ব্যবহার করে ব্যবসা বাড়াতে, পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে পর্নোগ্রাফি, ট্রাফিকিং, বিউটি প্রোডাক্ট ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করেছে। আজকে নারীদেহ আর সৌন্দর্য নিয়ে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা চলছে।
ভারতে যখন রাজীব গান্ধী অর্থনীতি খুলে দিলেন, তখন হঠাৎ করেই চার-পাঁচ জন ভারতীয় নারী ‘মিস ওয়ার্ল্ড’, ‘মিস ইউনিভার্স’ হয়ে গেলেন! তার আগে তো কলেজে বিউটি কনটেস্ট করতেই দিত না ফেমিনিস্টরা!

এমনকি খেলনা বাজারেও—মেয়েদের জন্য বার্বি, ছেলেদের জন্য স্পাইডারম্যান! সিনেমা, টিভি সবই পিতৃতান্ত্রিক চিন্তা দিয়ে চলে।

তাই আমি সবসময় বলি—পুঁজিবাদ, পুরুষতন্ত্র, জাতপাত, বর্ণবাদ—সবগুলোর বিরুদ্ধে একসাথে লড়াই করতে হবে। কারণ এগুলো আলাদা নয়। একটার ভিতরে আরেকটা লুকিয়ে আছে।

আজকের ধর্মীয় উৎসবগুলোও পুঁজিবাদের হাতিয়ার হয়ে গেছে। ভারতীয় বিয়ে—দেখো না, কেমন বিশাল ব্যবসায় পরিণত হয়েছে! সবকিছুতেই এই সিস্টেম ঢুকে গেছে।

মিনি সাক্সেনা: আপনি কীভাবে এমন মানুষদের সাথে কথা বলেন বা কাজ করেন, যারা জেন্ডার সমতা বা ন্যায়ের ব্যাপারে বিশ্বাস করে না? আপনি কী ধরনের কাজ করেন?

কামলা ভাসিন: আমি জাতিসংঘ (UN) থেকে ইস্তফা দিয়েছিলাম, কারণ সেখানে একজন sexist (নারীবিদ্বেষী) আর racist (জাতিবিদ্বেষী) বস ছিল। তবে UN-এ কাজ করার সময়ও আমাকে UN না, বরং বিভিন্ন এনজিওর ডোনাররাই বেশি সাহায্য করেছিল। ওরাই বলেছিল, UN ছেড়ে বাইরে থেকে এই কাজ চালিয়ে যেতে।

১৯৭৫ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত, আমার মূল কাজ ছিল কোর্স আর ওয়ার্কশপ করা। আমি প্রতি বছর প্রায় ১৫-২০টা ওয়ার্কশপ করি। এর মধ্যে কিছু বড়, দীর্ঘমেয়াদি কোর্স যেমন সংগঠনের (Sangat) কোর্স, আর কিছু ছোট ছোট ৩-৪ দিনের ওয়ার্কশপ।

এই ওয়ার্কশপগুলোতে আমরা মানুষদের সাথে বসি, তাদের গল্প শুনি, কথা বলি। তারপর আমরা তাদের হাতে তুলে দিই প্যাট্রিয়ার্কি আর জেন্ডার বিশ্লেষণের কিছু টুলস, যাতে তারা নিজের জীবনেই সেগুলো প্রয়োগ করতে পারে।

এইভাবেই একটা নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে।
এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আমাদের বইপত্র, বুকলেট, পোস্টার ছড়িয়ে পড়ে। এই কারণেই আমার বইগুলো ২৫-৩০টা ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
যেমন, সুদান আর তুরস্ক থেকে দুইজন মহিলা আমার কোর্সে অংশ নিয়েছিল। পরে, তারা আমার চারটা বই তুর্কি আর আরবি ভাষায় অনুবাদ করে ফেলেছিল!

আর একটা বড় মাধ্যম হলো—গান। আমার মনে হয় এটা আমার সবচেয়ে বড় অবদান। গান আমাদের শরীর, মন আর আবেগকে একসাথে যুক্ত করে। পোস্টার, স্লোগান, ব্যানার—সবই আমরা ব্যবহার করি।

এইভাবে মানুষের সঙ্গে আমরা কানেক্ট করতে পেরেছি। আমার মনে হয়েছে, গান আর স্লোগান খুব কাজের জিনিস।

মিনি সাক্সেনা: One Billion Rising ক্যাম্পেইনটা আপনার কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?

কামলা ভাসিন: এই ক্যাম্পেইনটা অসাধারণ! আমরা ১৯৭০ সালের শেষ দিক থেকেই নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে কাজ করছি। কিন্তু OBR কিছু একটা আলাদা করেছিল। এর স্লোগান ছিল: Strike! Dance! Rise! এই ‘ডান্স’ শব্দটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল—পুরো বিশ্বকে একটা মেসেজ দিল: আমরা শুধু ভিকটিম না, আমরা সারভাইভার, আর আমরা গান গেয়ে, নাচ করে, জোরে বলবো—আমরা লড়ছি! আমার মনে হয়, এই ব্যাপারটাই তরুণদের খুব টানল।
সম্ভবত OBR-এর আগে, আমরা যেভাবে কাজ করছিলাম, সেটা তরুণদের খুব একটা ছুঁতে পারছিল না। OBR আমাদের কলেজগুলোতে পৌঁছাতে সাহায্য করেছিল। যেমন দিল্লিতে, প্রায় ৪০টা সংগঠন এই ক্যাম্পেইনে অংশ নিয়েছিল। তারা নিজেদের এলাকার কাজ নিজেরাই করত। Sangat-এর নেটওয়ার্ক থাকার কারণে আমরা এটাকে প্রায় সব দেশে ছড়িয়ে দিতে পেরেছি। আগেও ক্যাম্পেইন ছিল—যেমন ‘১৬ দিনের ক্যাম্পেইন’, ৮ মার্চ, ইত্যাদি।
কিন্তু OBR-এর একটা আনন্দের রঙ আছে। ওরা এটা ১৪ ফেব্রুয়ারির সাথে মিলিয়ে করেছিল, আর বলেছিল,
‘না বলো সহিংসতাকে, হ্যাঁ বলো ভালোবাসাকে।’ আমাদের স্লোগান ছিল: “ভালোবাসার শক্তি চাই, ক্ষমতার ভালোবাসা না।”

১৯৮৩ সালে, আমরা ৭ সপ্তাহের একটা কোর্স করেছিলাম। তাতে ১০ দিন শুধু নাটক, গান আর পোস্টার তৈরির জন্য রাখা হয়েছিল। মানে আমার কাজের মধ্যে সবসময় শিল্প আর সৃষ্টিশীলতা ছিল। আবেগ সবসময় ছিল।

মিনি সাক্সেনা: যারা জেন্ডার ইনসাফ বা সমতায় বিশ্বাস করে না, তাদের সঙ্গে কথা বলার সেরা উপায় কী?

কামলা ভাসিন: আমার মনে হয়, সত্যিকারের সংলাপ ছাড়া আর কোনো পথ নেই। মানুষের বাস্তব জীবনের গল্প তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। প্রথমেই তাদের বোঝাতে হবে— ফেমিনিজম মানেই পুরুষ বিদ্বেষ না, সংস্কৃতি-বিরোধিতা না, ধর্ম-বিরোধিতা না। ফেমিনিজম শুধু অসাম্য আর অবিচারের বিরুদ্ধে। যদি কোনো ধর্মে অন্যায় থাকে, তাহলে সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা আমাদের কাজ। সংস্কৃতিতে যদি বৈষম্য থাকে, সেটার বিরুদ্ধেও কথা বলবো।
আমরা পরিবারকে ধ্বংস করতে চাই না, বরং চাই পরিবারটা সমতার ভিত্তিতে গড়ে উঠুক। আরেকটা বিষয়, আমাদের সংবিধান নিজেই বলে—সব নাগরিকের সমান অধিকার আছে। তাহলে আমরাও সেই নীতিই অনুসরণ করছি। তাদের বোঝাতে হবে— যদি পরিবারে জেন্ডার সমতা থাকে, তাহলে পরিবার আরও শক্তিশালী হবে। বিয়ে হবে আরও সুন্দর। ভাইয়েরা হবে আরও মুক্ত।

অনেকেই ভাবে, জেন্ডার সমতা মানেই ছেলেদের বাড়ির কাজ করতে হবে, ছোট ভাইবোন দেখাশোনা করতে হবে—
কিন্তু তারা ভাবে না যে, তখন তারা গান গাইতে পারবে, কবিতা লিখতে পারবে, নাচতে পারবে, চাইলেই পুরুষত্বের রোল থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। সারাজীবন শুধু কাজ আর দায়িত্ব না।

আমাদের ফেমিনিস্টদেরও আরও নম্র, ধৈর্যশীল, আর কোমল ভাষায় কথা বলা শিখতে হবে। আমি তো নিজেই বলি, এত বছর কাজ করার পরেও আমি পুরোপুরি ফেমিনিস্ট হতে পেরেছি কি না, জানি না!
ফেমিনিজম একটা জার্নি। আর যদি আমরা ফেমিনিজমকে জাত, শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ—সব কিছুর সাথে যুক্ত করি, তাহলে তো কখনও পুরোপুরি মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। আমার জীবদ্দশায় তো না!

কখনো কখনো মনে হয়, আমরা অনেকদূর এগিয়েছি। আজকাল প্রায় প্রতিটা কলেজে জেন্ডার সেল আছে। কিন্তু আবার দেখি— তিনটে জিনিস আমাদের পিছনে ঠেলে দেয়:

ক্যাপিটালিস্ট প্যাট্রিয়ার্কি (লোভনির্ভর অর্থনীতি)
রাইট-উইং রাজনীতি (যেটা এই ক্যাপিটালিজমেরই বন্ধু)
ধর্মীয় মৌলবাদ (সেটাও এই গোষ্ঠীরই অংশ)

এই সব মিলিয়ে আমাদের ভাগ করে ফেলছে, প্রতিনিয়ত। সবাই একটা কথা মেনে নিয়েছে: “এটা ছাড়া কোনো উপায় নেই।” তাই কেউ লড়াই করে না।

মিনি সাক্সেনা: তরুণ ফেমিনিস্টদের জন্য আপনার বার্তা কী?

কামলা ভাসিন: আমি বার্তা দিতে পছন্দ করি না! এই পুরো কথাবার্তা আসলে একটা বার্তা। তবে, আমি বলব— বন্ধু হও, একে অপরকে ভালোবাসো। ফেমিনিজম এমন একটা যাত্রা, যেখানে সবসময় শিখতে হয়। আর তোমাদের কাজটা হবে, আরও বেশি সহানুভূতির সাথে, আরও বিনয়ীভাবে এই পথটা চলা। তোমরা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছ, খুব দ্রুত। আজকাল, প্রতিটি কলেজে জেন্ডার সেল গড়ে উঠেছে, যা এক বড় পরিবর্তন। তবে জানো, সঠিক পথ আর সঠিক কাজের জন্য কোনো শেষ নেই, সবসময় নতুন চ্যালেঞ্জ আসবেই।

আজকের দুনিয়ায় ফেমিনিজম একটা আবেগের ব্যাপার—তবে শুধু আবেগ নয়, এটা একটা বিজ্ঞানের বিষয়ও। জ্ঞান, কৌশল, এবং পরিশ্রমের ব্যাপার। তোমরা যত বেশি সিলেবাসের বাইরে কাজ করবে, আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হবে তোমাদের সংগঠন এবং চিন্তা। এই যাত্রা কখনও শেষ হবে না, তবে তোমরা যেভাবে সামনে এগোচ্ছ, সেখানেই নতুন দিক খুঁজে পাবে। তবে সবসময় মনে রেখো, ফেমিনিজমের মূল কথা হল সমতা— সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে কাজ করা। সবশেষে, নিজের আত্মবিশ্বাস, শক্তি, আর ভালোবাসা নিয়ে পথ চলতে হবে।

 

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply