April 28, 2025
ফিচার ১মুক্তমত

একা ভিনদেশি

খান মুহাম্মদ রুমেল ।।

“মনে হয়, মনুমেন্টের চূড়ায় উঠে

চিৎকার ক’রে

আকাশ ফাটিয়ে বলি;

দেখো, সীমান্তে ওইপাশে আমার ঘর

এইখানে আমি একা, ভীনদেশী।”

কবি দাউদ হায়দার লিখেছিলেন কবিতায়। সীমান্ত পেরিয়ে নিজের দেশে আর ফেরা হয়নি তার। কাঁটাতার, সীমান্তরেখা, ভিসা, পাসপোর্ট – সব ভৌগোলিক ও জাগতিক বিষয় আশয় ছাপিয়ে তিনি এখন নীল আকাশের তারা। শনিবার রাতে জার্মানির বার্লিনের একটি নিরাময় কেন্দ্র থেকে অসীম শূন্যে যাত্রা করেন তিনি। অমরত্বের যাত্রা শুরুর পথে পৃথিবীর খাতায় তার বয়সটা আটকে গেছে ৭৩ এ।

‘কালো সূর্যের কালো জোছনার কালো বন্যায়’ শিরোনামে একটি  কবিতা লেখার ‘অপরাধে’ তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন ১৯৭৩ সালে । ১৯৭৪ এর ২০মে সন্ধ্যায় তাকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং ২১শে মে সকালে বাংলাদেশ বিমানের একটা রেগুলার ফ্লাইটে করে তাকে কলকাতায় পাঠানো হয়। ওই ফ্লাইটে তিনি ছাড়া আর কোনো যাত্রী ছিলেন না। তার কাছে সে সময় ছিল মাত্র ৬০ পয়সা এবং কাঁধে ঝোলানো একটা ছোট ব্যাগে কবিতার বই, দু’জোড়া শার্ট, প্যান্ট, স্লিপার আর টুথব্রাশ। এরপর ১৯৮৭ সালে কলকাতা থেকে জার্মানি চলে যান দাউদ হায়দার। তারপর থেকে সেখানেই ছিলেন তিনি। মাঝে মাঝে আসতেন কলকাতায়। কিন্তু বাংলাদেশে আর কখনো ফেরা হয়নি তার। তিনি বলেছিলেন – আমার কোনো উপায় ছিল না। মৌলবাদীরা আমাকে মেরেই ফেলত। সরকারও হয়ত আমার মৃত্যু কামনা করছিল।

মাঝে মাঝে ভাবি, সাহিত্যিকরা কেন নির্বাসিত হন! নির্বাসনের বেদনা কতটা ভয়াবহ, কেবল নির্বাসিত ব্যক্তি ছাড়া আর কে বুঝতে পারেন! তবে নির্বাসন দিলেই কি কলম থেমে যায়? থামানো যায় মনোহর বাঁশির অমিয় সুর? বিভিন্ন সময় নিজ দেশ থেকে নির্বাসিত হয়েছিলেন — বায়রন, জোলা, হুগো, ওয়াইল্ড, ব্রেখট, লরেন্স, নেরুদা, জয়েস, কুন্ডেরা, জিয়ান কিংবা বাংলাদেশের দাউদ, তসলিমা।  নির্বাসন কি তাদের থামিয়ে দিতে পেরেছে? পারেনি। বরং নির্বাসিত জীবনে তারা বুনেছেন গোলাপের বীজ। ফুটিয়েছেন মনোহর পদ্ম। ফুলে ফুলে শব্দে বাক্যে দোলা দিয়েছেন মানুষের মনে। মানুষ নতুন করে তাদের ভালোবেসেছে, প্রেমে পড়েছে।

জার্মানিতে দাউদ হায়দার পেয়েছিলেন নোবেলজয়ী সাহিত্যিক গুন্ট্যার গ্রাসের আনুকূল্য। যেমন কলকাতায় ছায়া হিসেবে পেয়েছিলেন অন্নদা শঙ্কর রায়কে। হয়তো মনিমুক্তোর মতো এসব  সম্পর্ক তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। জাগিয়ে রেখেছে সৃষ্টিসুখের উল্লাসে। নিস্তারহীন দহন যাত্রায় হেঁটে হেঁটে তিনি কোথা থেকে কোথা গিয়েছেন। সাফল্য ছুঁয়েছেন। শুধু ছুঁতে পারেননি দেশের মাটি। বার্লিনের আকাশের নিচে পদ্যের আল্পনা এঁকেছেন। আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতে চেয়েছেন – এইখানে, আমি একা ভিনদেশী। চেয়েছেন মেঘের মতন ভেসে ভেসে একবার বাংলাদেশ ঘুরে আসতে। দেশান্তরি হওয়ার বেদনা এভাবেই তিনি তুলে ধরেছেন – ‘তোমার কথা’ কবিতায়।

হয় না, এক জীবনে অনেক কিছুই হয় না। প্রতিদিন অনেক ইচ্ছে এবং চাওয়ার সমাধি দিয়ে বাঁচতে হয় মানুষকে। আটপৌঢ়ে মানুষের কথা আলাদা। কিন্তু যারা সৃষ্টিশীল, সৃজনের দহন যাদের তাড়া করে দিবস রজনী, নিদ্রা অনিদ্রায় যারা নতুন স্বপ্নের জাল বোনেন – তাদের ভেতরটা অপ্রাপ্তিতে কতটা দুমড়ে মুচরে যায়, কে রাখে সেই খোঁজ?  আচ্ছা, দাউদ হায়দার তো দেশ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন! তবুও দেশের জন্য কেন এতো মায়া ছিল তার! কেন তিনি মেঘের মতন ভেসে ভেসে একবার ঘুরে আসতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশ? যাদের আপত্তির কারণে দাউদ হায়দারকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল তারা কি বোঝেন, বোঝার চেষ্টা করেন এক কবির মাতৃভূমি হারানোর বেদনা?

আজ থেকে পঞ্চাশ, একশো কিংবা দুইশো বছর পর বর্তমান পৃথিবীর মানুষেরা দাউদ হায়দারের মতোই চলে যাবেন অসীম অনন্তলোকে। পৃথিবীতে – এই বাংলাদেশে আসবে নতুন মানুষ। তারা জানবে এই বাংলাদেশের সন্তান, দাউদ হায়দার নামে এক কবির গোটা জীবনটাই কেটেছে নির্বাসনে। বাংলাদেশের প্রথম দেশান্তরি কবি দাউদ হায়দারকে নিয়ে অবশ্যই তাদের কৌতুহল জাগবে। আগামীর পাঠকেরা খুঁজে খুঁজে পড়বে তার ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’, ‘সম্পন্ন মানুষ নই’, ‘নারকীয় ভূবনের কবিতা’ কিংবা ‘এই শাওনে এই পরবাসে’। তার আত্মজীবনী ‘ইল্লিন ঝিল্লিন’ পড়ে নিশ্চয় তারা স্মরণ করবে দাউদ দায়দারকে। আগামীর বাংলাদেশ অবশ্যই বলবে – দাউদ হায়দার নামে আমাদের এক কবিকে আমরা দেশ থেকে বিতারিত করেছিলাম।

‘আমার পরিচয়’ শিরোনামে কবিতায় দাউদ হায়দার লিখেছেন –

“ভুলে যাও ভিটে মাটি দেশ

তুমি উদ্বাস্তু, আশ্রিত।

তোমার স্বদেশ বলে কিছু নেই

তুমি পরগাছা, তুমি মৃত

তোমার সামাজিকতা, তোমার পারিপার্শ্বিক

তোমার চেহারা তোমার চাল চলন

উদ্বাস্তুর; আমাদের ঘৃণা-করুণায়

তোমার জীবন

এদেশ তোমার নয়

এই ভিটে মাটি জমিন তোমার নয়

তুমি আশ্রিত, উদ্বাস্তু;

এই তোমার মানব পরিচয়”

আসলে দাউদ হায়দার উদ্বাস্তু নন। মাঝে মাঝে মনে হয়, হয়তো আমরাই উন্মূল। নিজেদের কবিকে দেশান্তরি করে ফেলি আমরা!

Leave a Reply