May 31, 2025
ফিচার ১মুক্তমত

কন্যারা বিষকন্যা হবে কবে?

ফুয়াদ হাসান ।। সাদাত হোসেন মান্টোর ‘খোল দো’ গল্পটার কথা মনে পড়ছে। সেখানেও বোধহয় বাপ-ছেলে মিলে এমনটি করার নমুনা পাওয়া যায় না। কী এক ‘দুঃসময়ে মুখোমুখি’ আমরা! নিজেকেই নিজে বিশ্বাস করতে পারি না। মনোলগে বাচ্চুর মতো আমিও নিজেকে বলতে থাকি,’তুই যা, চলে যা’ এখান থেকে! কী হবে এখানে থেকে! এভাবে কী পালিয়ে থাকা যায়। সভ্যতার এমন বর্বরতার দিনে মনে হবে কী আদিমকাল, মধ্যযুগীয় জীবনও এর চেয়ে ঢের ভালো ছিল।

মান্টোরই ‘ঠাণ্ডা গোশতে’র মতো শিশুটির শরীর হিম হয়ে যাওয়ার পরও ঠাণ্ডা হয়েছিল কি নরপশুদের হৃদয়! অন্য কোনো গল্পে যখন করুণ আর্তনাদের মতো উচ্চারিত হয়, ‘আস্তে-আস্তে এসো, আমার মেয়েটা মারা যাবে’ তখন যেন এক মুহূর্তের জন্য পাঠক একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এখানে সে সুযোগ নেই, এটা গল্প নয় কঠিন বাস্তবতা। বাস্তবতা আরও কঠিন, ভীষণ রকমের করুণ। দেশভাগের বিভীষিকা নিয়ে লেখা রচনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিত যে ভাগ হয়নি এখনও তা ভাঙাচোরা দেশগুলোর দিকে তাকালেই স্পষ্টতর হয়। তা না হলে প্রতিদিন এমনও অজস্র নারীর আর্তনাদ হাহাকারে পরিণত হওয়ার গল্প অজানায় হারিয়ে যায় কেন! এখনও ফি বছর বিচার চেয়ে রাজপথে নামতে হয় নির্যাতিতাদের।

বাস্তবতা তো আর গল্প না, সে যে আরও কঠিন তাই তো সেখানে থামানোর কেউ নেই, কোন মুক্তি নেই। গল্প থেকে বাস্তব আরও করুণ, নিষ্ঠুরতম। অথচ, আমরা বাস্তবের ট্র্যাজেডির চেয়ে শিল্প-সাহিত্যের ট্র্যাজেডিকেই বেশি মনে রাখি। যে পাপের জন্য জোকাস্টার, অ্যান্তিগোনে বা সীতা দায়ী ছিল না অথচ তাদেরকেই সে সবের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিল। সাহিত্য হোক বা বাস্তবে, একালেও সব পাপের মূল্য দিতে হয় নারীকেই। এখন ভাবছি, যে মরে যায় সে তো আসলে বেঁচেই যায়।

রাস্তায়, আড্ডায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবাই এর প্রতিকারের মুখরোচক কাহিনী বানাবে, নেতা-ধর্মগুরুরা এইপাপ থেকে বেরিয়ে আসার নানা টোটকা আওড়াবে নতুন করে; সমাজপতিরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে ভুক্তভোগীদের দিকে।

টিভি টকশোতে নারী অধিকার, মানবাধিকারের বুলি আওড়ানো শুনে আমরাও ঘুমাতে যাবো আবার, অতঃপর ভুলে যাবো কিংবা অপেক্ষা করবো, নিজের সাথে, নিজের পরিবারের সঙ্গে একইরূপ কোন ঘটনা ঘটার আগমুহূর্ত পর্যন্ত। কিন্তু এসব থেকে বাঁচায় উপায় কী করে বের করবে এ আধুনিক মানবসমাজ। নাকি সকল অভাব-অভিযোগের মতো এসব মেনে নিবে, স্বাভাবিক হয়ে যাবে সবকিছু। এমন বিকৃত রুচির জন্য কেউ হয়তো স্রেফ কালকেই দোষ দিবে, কোন কলিকালে, আইয়ামে জাহেলিয়ায় এসে দাঁড়ালাম আমরা।

কিন্তু কোনো কালেই বা এমন সহিংসতার কমতি ছিল, বলতে পারি আমরা! মানুষ চিরকালই হিংস্র এবং মাংসাশী। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র বা ধর্মের বেড়া কতটুকই বা তাকে আটকে রাখতে পেরেছে। ফিরিয়ে আনতে পেরেছে এসব চিরায়ত অপরাধপ্রবণতা থেকে।

দেশে ধর্ষণের হার বেড়ে যাওয়া নিয়ে আক্ষেপ করে হুমায়ুন আজাদ একবার দেশে পতিতালয় বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু যেখানে বাবা কন্যাকে, শ্বশুর পুত্রবধূকে বা ….; সেখানে কী হবে! সে সমাজটাই তো একটা পতিত সমাজে পরিণত হয়ে আছে। সেখান থেকে বাঁচায় উপায় কী? কেবল আইনের শাসন কি পারবে এসব থেকে মুক্তি দিতে, নাকি নারীরাই সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়াবে এসবের! তখন তো আবার সিমন দ্য বোভোয়ার আক্ষেপ করে বলা কথাটাই সত্যি হবে, ‘যখন নারীরা নারীদের মত আচরণ করে, তখন তাদেরকে অধম বলা হয়। যখন নারীরা মানুষের মতো আচরণ করে তখন তাদেরকে ‘পুরুষের মতো’ বলে অভিযুক্ত করা হয়।’

তবে কি আমাদের কন্যাদের এখন মিথ্রিডাটিজম বা বিষকন্যা হওয়া জরুরি! চাণক্যের পরামর্শে সেই মৌর্যযুগের গুপ্তঘাতক নয়, নিজেকে বাঁচাতে, আত্মরক্ষার জন্যে এ ছাড় আর কোনো গতি দেখি না। এখন প্রতিটি নারীই তো আসলে মিথ্রিডামিজম হওয়া জরুরি। তা না হলে একের পর এক এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

আমাদের কন্যারা বিষকন্যা হবে নাকি অপেক্ষা করবে এমন আরও একটি ঘটনার জন্য!

Leave a Reply