December 23, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

“কে এই মেয়ে? সেক্সি বলে দেব, চুপ হয়ে যাবে!”

ফাহমিদা আফরিন প্রিয়া।। আমি ফাহমিদা আফরিন প্রিয়া। বয়স ১৬। এরই মধ্যে এই সমাজ আমাকে দেখিয়েছে তার বর্বরতম রূপ। তাই নিয়ে আজ লিখছি আমার দেখা বা আমার সাথে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা।

১. তখনও স্কুলে ভর্তি হইনি। মা চাকরি করেন গ্রামীণ কল্যাণে। মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট পদে। আমি বেশ ছোট। মা রোজ আমাকে তার সাথে অফিসে নিয়ে যেতেন। সকাল থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত মায়ের সাথেই থাকতাম সেখানকার ডে কেয়ার সেন্টারে। তো একদিন সেই অফিসের এক ম্যানেজার, নাম মনির, আমার শরীরের স্পর্শকাতর অংশে হাত দেয় আমাকে একা পেয়ে, আর মাকে বলতে নিষেধ করে।আমি তারপর মাকে গিয়ে সব বলে দেই।

অফিসে complain করা হয় এবং তাকে শাস্তি দেওয়া হয়। অনেকেই হয়তো লজ্জা পাবে বলতে। আমি পাচ্ছি না। কারণ লজ্জা কী আদৌ আমার পাওয়ার কথা? যেই সমাজব্যবস্থা আমাকে শিশু অবস্থায় নিরাপত্তা দিতে পারেনি লজ্জা সেই সমাজ পাবে। বাবা-মাকে বলবো আপনার সন্তানের কথা শুনুন মনোযোগ দিয়ে। অবহেলা করবেন না। তার বন্ধু হয়ে উঠুন যাতে সব শেয়ার করতে পারে আপনার সাথে। তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। আপনার সন্তানকে প্রতিবাদী করে গড়ে তুলুন। তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করুন। আমি বলব আমার মা তার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে পেরেছেন।

২.আমি এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছি এবার। বাসার সামনে একটা জায়গা আছে,অনেক গাছ ছিল সেখানে। আপাতত কেটে খালি করা হয়েছে বাড়ি করার জন্য। সেখানে সকাল থেকে শুরু করে রাত ২ টা পর্যন্ত ব্যাডমিন্টন খেলা, চেচামেচি আর আওয়াজ। না যায় পড়াশোনা করা, না যায় ঘুমানো। আশেপাশে সব বিল্ডিংয়ে পরীক্ষার্থী। খেলার মাঠ থাকা সত্ত্বেও এবং ওদেরকে অনেকবার না করা সত্ত্বেও ওরা এখানে খেলে। ঘরে একটু পরপর অকথ্য ভাষায় গালাগালির আওয়াজ আসে নিচ থেকে। এক পর্যায়ে বাড়িওয়ালা খেলার বাঁশ খুলে নিয়ে এলেন। তাও লাভ হলোনা।

৪ দিন আগের ঘটনা। তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে প্রায়। তাও ওরা যাচ্ছিল না। আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই এক ছেলে তার এক বন্ধুর সাথে বলে উঠলো, “দেখি কী বলে মেয়েটা। যতক্ষন কিছু না বলে যাব না।”

তার বন্ধু বললো, “মেয়ে মানুষ! কিছু বলতে পারবি?” তার উত্তর ছিল,”মেয়ে মানুষ বলেই তো আরো বেশি বলবো।”

তো আমি সুন্দর করে গিয়ে ওদের সামনেই কাঁচি দিয়ে খেলার নেটটা কুচি কুচি করে কেটে দিলাম। ওরা আর কিছু না বলেই চলে গেল।

মেয়ে বলেই আমি আরো বেশি সাহসী।

ওরা শুধু বিকেলে খেললে আমি কিছুই বলতাম না। আর মেয়ে বলে আমাকে কিছু বলে অপমান করার কথা না বললে কাটতাম না।

সাহসী হন। মেয়ে তো কী হয়েছে? আমি নেট কেটে দিয়ে আসার কিছুক্ষণ পরই আরেকদল খেলতে এলো। ওদের বয়স সম্ভবত ১১-১২ হবে বা আরো ছোট। আমি বললাম-“তোমরা এত রাতে এখানে খেলছ কেন, আওয়াজ করছো কেন?”

এক পিচ্চি বলল, “আয় চলে যাই।” তার পাশে থেকে আরেকটা বাচ্চা বলে উঠলো, “যাবো না। খেলব। কে এই মেয়ে? সেক্সি বলে দেব। চুপ হয়ে যাবে।”

আমি অবাক হয়ে গেলাম ১১-১২ বা তারও কম বয়সী বাচ্চার ভাবনা দেখে! ওকে এই সমাজই এই কথা শিখিয়েছে যে মেয়েদের সেক্সি বললেই হয়। ওদের চুপ করিয়ে দেয়া যায়। তো আমি বললাম, তুমি স্কুলে পড় না? এই পচা ভাবনা কেন তোমার? স্কুলে এসব শেখায়?

সে উত্তর দিল,”মুটকি। সেক্সি।তোর ****।” বলে চলে গেল।

এই বাচ্চা ছেলেকে আমি কী বলব খুঁজে পেলাম না। এই সমাজ শিশুদের মগজে ও বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে। এই সমাজই ধর্ষক বানাচ্ছে পুরুষকে এমনকি শিশুদের। ওরা যা দেখে তাই শেখে।

প্লিজ নিজে সচেতন হন। নাহলে ধর্ষণ আরো বাড়বে। আপনাদের দেখেই শিশুরা শিখছে।

৩.আমাকে আমার মা শিখিয়েছেন ছেলেরা কিছু বললে মাথা নিচু করে চলে আসবে। কিন্তু আমি তা কখনোই করি না। বরং প্রতিবাদ করে আসি। ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন। আমার এক ক্লাসমেইটকে আমাদের ক্লাসেরই আরেক ছেলে বলেছে,”তোমার ওইগুলা এত ছোট কেন?” এরকম আরো নানা কথা!

তো আমার বন্ধু আমাকে এসে এই কথা বলাতে আমি সেই ছেলেকে সবার সামনে গালে থাপ্পড় দিয়েছি যত জোরে পারা যায়। তারপর কান ধরে উঠ- বস করিয়ে ওকে টিচার এর কাছে নিয়ে গিয়ে complain করেছি।

আপনার ছেলে শিশুকে মেয়েদেরকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে আর রেস্পেক্ট করতে শিখান। মেয়ে শিশুকে প্রতিবাদ করতে শিখান।

আরো অনেক কিছুই দেখি রোজ। এই সমাজ, এই পুরুষতন্ত্র শিশুদেরকে ভাগ করে দিচ্ছে ছেলে শিশু -মেয়ে শিশু হিসেবে। প্লিজ এটা করবেন না। তাকে শেখান সবাই শিশু, সবাই মানুষ।

ধর্ষণ হয় কেন? খুব সোজা।আপনারা নিজেরা যেমন ঠিক তেমনভাবে শিশুদের ৎকে গড়ে তুলছেন।হাজার হাজার ধর্ষক তৈরি করছেন আপনার দেওয়া কুশিক্ষা, আপনার জীবনব্যবস্থা, আপনার কুসংস্কার, আচার-আচরণ এর মাধ্যমে। তাই একদিকে আপনার ছেলে শিশু গড়ে উঠেছে ধর্ষকামী মানসিকতা নিয়ে আর মেয়ে শিশুটি হচ্ছে ধর্ষিত বা ভিকটিম।

আজকে দুপুরেও মোল্লা সাহেব মাইক দিয়ে নারীবিদ্বেষ ছড়াচ্ছিলেন। আপনার শিশু সন্তান তা শুনেছে, শিখেছে, নিজের মাঝে আত্মস্থ করেছে।

এসব নারীবিদ্বেষ বন্ধ হোক। আমাদের শিশুদেরকে একটি সুস্থ সুন্দর সমাজ উপহার দিন। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে এই পচা দুর্গন্ধ দিয়ে ভরা জঘন্য সমাজে। তাই ভীষণভাবে চাই একটি সাম্যবাদী বা নারীবাদী সমাজ।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখা লেখকের নিজস্ব মতামত]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *