কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ ও নারী: যেতে হবে আর কত পথ?
সাবিরা নুপুর।। বিগত সময়ের চেয়ে বর্তমানে বেশি সংখ্যক নারী কর্মক্ষেত্রে রয়েছেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে শুরু করে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন প্রতিটি পর্যায়ে নারী তার বিচক্ষণতা, দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা ও একাগ্রতার ছাপ রাখছেন। কিন্তু আমার আজকের লেখাটি কর্মক্ষেত্রে নারীর অর্জন নিয়ে নয় বরং কর্মক্ষেত্রে কী কী ধরণের সমস্যার মোকবেলা নারীকে করতে হয় সেই বিষয় নিয়ে।
কর্মক্ষেত্র কি নারীবান্ধব? প্রায় ২২ বছর হতে চলল আমি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করছি। এই দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতার আলোকে কর্মক্ষেত্র নারীবান্ধব কতটুকু হতে পেরেছে সে বিষয়ে কিছু শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না।
অনেক সংস্থা নারীকর্মী নিয়োগ দিচ্ছে। এইজন্য সেইসকল সংস্থাকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু তাদের অনেকের আগ্রহ নারীকর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি করার দিকে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রটি নারীবান্ধবকরণে তৎপরতা ততটা চোখে পড়ে না। অনেক সময় আমরা নারীরা চাকুরি হারানোর ভয়ে বা সঙ্কোচের কারনে কোন বিষয় নিয়ে খুব বেশি উচ্চবাচ্য করি না। কর্মক্ষেত্রে নারী হিসেবে আমি যে সমস্যাগুলি দেখেছি বা এখনও আছে সেগুলো লিখছি।
প্রথমেই যে সমস্যাটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে সেটি হচ্ছে টয়লেট। এটি একটি চ্যালেঞ্জ। অনেকসময় নারী সহকর্মীদের জন্য পৃথক কোন টয়লেটের ব্যবস্থা থাকেনা। কোথাও কোথাও পৃথক টয়লেট আছে কিন্তু এমন জায়গায় যেখান থেকে যাওয়া আসাটা বিব্রতকর। বিশেষ করে যেখানে নারীদের জন্য পৃথক টয়লেট নাই সেখানে নারীদের পিরিয়ডকালীন সময়ে নানারকম সমস্যায় পড়তে হয়।
যে সকল নারী গর্ভবতী অথবা নতুন মা হয়েছেন তাদের সমস্যা আবার অন্যরকম। বেশিরভাগ কর্মক্ষেত্রে গর্ভবতী নারীদের জন্য পৃথক কোন ব্যবস্থা থাকে না যেখানে সে কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম নিতে পারে। গর্ভকালীন নারীর জন্য কাজে দীর্ঘসময় ধরে মনোনিবেশ করা কঠিন হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে প্রতিটি অফিসে যদি একটি নির্দিষ্ট কক্ষ থাকে যেখানে গর্ভবতী নারী অফিস সময়ে কিছু বিশ্রাম নিতে পারেন, তাহলে নারী আরো বেশী কাজে অংশগ্রহণ করতে পারতো। আবার দুগ্ধবতী মায়েদের অন্যরকম সমস্যায় পড়তে হয়। শিশুকে দুগ্ধপান করানোর জন্য কোনো ব্যবস্থা না থাকায় অনেক সময় নারীকে সম্ভবনা থাকা সত্বেও চাকুরি হতে ইস্তফা দিতে হয়। এর বাইরে মাতৃত্বকালীন ছুটি (কোথাও তিন মাস/কোথাও ছয় মাস) থেকে কর্মক্ষেত্রে যোগদানের পরই তাকে হয়তো বিভিন্ন কাজে নিজ কর্মস্থানের বাইরে যেতে হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশু এবং শিশুর দেখাশুনার জন্য যিনি যান তার জন্য এমন কোন কোন সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা থাকে না। সেক্ষেত্রে মাকে সবসময় তার শিশুর জন্য চিন্তিত থাকতে হয় অথবা উল্লেখিত কাজ হতে নিজেকে পরিহার করে নিতে হয়। অথবা চাকুরি ছেড়ে দিতে হয়। এর ফলে আমরা নারীরা অনেক সময় ক্যারিয়ারে পিছিয়ে যায়।
যাতায়াত আর একটি বড় সমস্যা। যদিও কিছু প্রতিষ্ঠান নারীকর্মীদের জন্য যাতায়াতের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে নারী কর্মীদের জন্য ট্রান্সপোর্টের তেমন ব্যবস্থা নাই। পর্যাপ্ত ট্রান্সপোর্টের সুবিধা না থাকায় অনেক নারীকে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করে কর্মস্থলে যাতায়াত করতে হয়। আমরা সবাই জানি পাবলিক ট্রান্সপোর্টের অবস্থা। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করে অফিসে আসা তারপর কাজ করা যে নারীরা করছেন তাদেরকে স্যালুট।
গ্লাস সিলিং আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ সমস্যা মনে হয়েছে। গ্লাস সিলিং সমাজে প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে জড়িত। বিশেষ করে নারীরা এর শিকার হয় বেশি। এন্ট্রি লেভেল বা মিড লেভেলে যে সকল নারী কর্মরত আছেন তারা হয়তো ততটা গ্লাস সিলিংয়ের শিকার হন না। কিন্তু যে সকল নারী কোন সংস্থায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন বা ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে আছেন তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই গ্লাস সিলিং এর শিকার হন। গ্লাস সিলিং হচ্ছে তাই যা নারীদের উচ্চপর্যায়ে উঠবার জন্য বাধা তৈরি করে। যে নারীরা এর ভুক্তভোগী তারা এটা ভাল ব্যাখ্যা করতে পারবে। আপনি বুঝতে পারবেন, অনুভব করতে পারবেন যে আপনি সুপরিকল্পিতভাবে উপেক্ষিত হচ্ছেন। কিন্তু প্রমাণ করা কঠিন হবে। সুনিপুনভাবে আপনার কর্মদক্ষতা/প্রজ্ঞা/অভিজ্ঞতা/আত্মবিশ্বাসকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাবে যে মনে হবে আপনি/আমি উল্লেখিত কাজের জন্য উপযুক্ত না। যে পজিশনে কর্মরত আছি সেখান থেকে উপরের পর্যায়ে যাওয়া তখন খুবই দূরহ হয়ে ওঠে।
এই গ্লাস সিলিং এমন পাকাপোক্ত অবস্থান এ আছে যে এটা ভাঙ্গা আর এভারেষ্ট এ ওঠা (আমার জন্য) একই রকম কঠিন। কর্মক্ষেত্রে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার প্রবল উদাহরণ এই গ্লাস সিলিং। পুরুষকর্মকর্তারা এখানে সর্বময় সুবিধা ভোগ ও নিয়ন্ত্রণ করে। কর্মক্ষেত্রে গ্লাস সিলিং ভাঙ্গতে হলে পুরুষ-নারী উভয়ের জন্য অভিভাবককালীন ছুটি প্রদান ও গ্রহণ এর প্রচলন থাকতে হবে। নারী-পুরুষের সমপর্যায়ের বেতন একই রকম প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। নারী কর্মী বেশী নিয়োগ এবং সিদ্ধান্তগ্রহণ পর্যায়ে পদোন্নতি নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে উচ্চ পর্যায়ে সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। জেন্ডার সংবেদনশীল কর্মস্থল তৈরিতে শক্তিশালী নীতিমালা ও এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা জরুরি।
নারী কর্মক্ষেত্রে নানাধরনের হয়রানির শিকার হয়। তার মধ্যে যৌন ও মানসিক হয়রানি সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। আমার বস যদি পুরুষ হয়ে থাকে তাহলে তার সাথে বেশি সময় নিয়ে কথা বলা যাবেনা। তহলেই অফিসে বিভিন্ন ফিসফিসানি শুরু হয়ে যাবে যা একসময় আপনার মানসিক টর্চার-এ পরিণত হবে। পুরুষ সহকর্মীরা বিভিন্ন সুযোগে অশ্লীল কৌতুক বলবে, সেটি হজম করতে হবে। পদোন্নতি হলে শুনতে হবে নারী বলে এবং বসের সাথে ভাল সম্পর্ক বলেই পদোন্নতি হয়েছে। ওরা ভুলে যায় নারীদের একটি মগজ আছে এবং একটি কঠিন প্রতিযোগিতার মধ্যদিয়ে চাকুরি পেয়েছে বা পদন্নোতি হয়েছে। এই সহজ বিষয়টি কেন ”তাদের” বোধগম্য হয়না বুজতে পারি না।
বেশির ভাগ কর্মক্ষেত্রেই যৌন ও মানসিক হয়রানি বন্ধে সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা বা কার্যকরী কমিটি নাই। নীতিমালা থাকলেও সেটি কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে তা প্রশ্নের সম্মুখীন। নারী যদি নরম হয় তাহলে শুনতে হবে আপনি নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তৈরি না। আবার বোল্ড হলে শুনতে হবে আপনি বসি। প্রতিটি পদক্ষেপে নারী কর্মকর্তাদের প্রমাণ করতে হবে নারী হিসেবেও সে ব্যবস্থাপক হিসেবে বা নেতৃত্ব দিতে সক্ষম বা দক্ষ। কর্মক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত এইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে করতে একসময় মানসিক অবসাদ তৈরি হয়, যা নারীকে সামনে এগিয়ে যেতে বাধা সৃষ্টি করে।
সাবিরা নুপুর: উন্নয়নকর্মী