November 2, 2024
সাহিত্যগল্পফিচার ৩

লাশের রঙ

অনসূয়া যূথিকা।।  কর্পুর আর আগরের গন্ধে  থমথমে  পরিবেশ চারতলা বাড়িটার বাগানের একপাশে লাশের গোসল দেয়া চলছে। আত্মীয় স্বজনের আহাজারিতে বাতাস থমথমে, বড় গেট এখনো বন্ধ তাই পাশের সুইং ডোর ঠেলে ঢুকলো এক নারী। বোরকা পরা না, সাধারণ ঘরে পরা আটপৌরে এক বারোহাতি কাপড় জড়ানো মধ্যবয়সের এক নারী। সে জানে না তার নিয়তি কী নিষ্ঠুরতম খেলা খেলছে তার সাথে। জানে না কেন এই আয়োজন চলছে, কে মারা গেছেন এই বাড়িতে। জানে না সবাই কার লাশ শেষবারের মতো পৃথিবীর জলের ছোঁয়া নিচ্ছে!

আমি তারে মোর্শেদা আপা বলতাম। জ্ঞান হওয়া অব্দি তারে আমার  ফুপুদের সঙ্গেই দেখছি যদিও তার বুলি আমাদের মতো না। স্পস্টই ময়মনসিংহের টান কথায়। রান্নার হাত চমৎকার, বলে না দিলে তার সঙ্গে আমাদের  প্রভেদ করাটা কঠিন৷ সেটা এই বাড়ির লোকেদের বদান্যতায় না, তার নিজের গোছানো স্বভাবের কারণে।

এ বাড়ির সব কুঁচোকাঁচা সামলানোর দায় বা দায়িত্ব বরাবরই ছিল আপার ঘাড়ে৷ সবাইকে স্নান করানো, পোশাক পরানো, খাওয়ানো এবং নানান কিস্যা বলে ঘুম পাড়ানো ইস্তক সব কয়জনের দায় আপার৷ আমাদের স্কুলের বই খাতা কি ড্রেস বা টিফিন সবের ভারই ছিল আপার উপরে। কিন্তু সব ফেলে তাকে যেতে হলো অবশেষে।

আমার পাঁচ নাম্বার ফুপুর বাচ্চা হলো হাসপাতালে। ছুটি ফুরালে বাচ্চা নিয়ে নিজের বাড়ি যাবার সময় যেন চোখে আক্ষরিক অর্থেই সর্ষে ফুল দেখলেন ফুপু।তখন সকলের সিদ্ধান্তের সম্মান রাখতে মোর্শেদা আপা তার সঙ্গে চললেন পুঁচকেটাকে সামলাতে। সে না হলে ফুপু সামলাতে পারবেনা বলে। নাচতে নাচতে সে নিজেই চললো আমাদের ছেড়ে। কোথাকার জল কোথায় যে গড়ায় কে তা জানে৷ ছিল কোথায় এলো কোথায় আর গেলোই বা কোথায়!  একেকটা সিদ্ধান্তের কারণে জীবন কেমন অন্য রকম হয়ে যায়।

ফুপুর গ্ল্যাক্সো কোম্পানীর চাকরি, সারাদিন তার সংসার আগলায় আমাদের আপা। কখনো বাড়ির কারো সঙ্গে আমরাও যাই বেড়াতে। বোনেরা সব এক রকমের জামা পরে।

আমাদের বাড়ির সব তুতো বোন, এমনকি  ফুপুদের সবার জন্য এক রকম ছিটের কাপড় আনা হতো, বানাতেন সেজো ফুপু বা আম্মা।কখনো বাবা বা চাচা কেটে দিতেন সেটা নেহাতই কোন বিশেষ উপলক্ষে। যাহোক, বাড়ির সবার জামা একরকমেরই, কারো ফ্রক তো কারো কামিজ।তাই মোর্শেদা আপা আর আমি বা আর কোন বোন বা ফুপুদের কারো জামা দেখে বোঝার জো নাই যে মোরশেদা আপার সঙ্গে আমাদের রক্ত সম্পর্ক নাই, যা আছে তা হলো আত্মার সম্পর্ক।

আমরা তো বটেই এলাকার লোকেও ভুলে গেছে সব ঘটনা। এক বর্ষার শেষ রাতে মোর্শেদা আপা কেমন করে আমাদের বাড়ি এলেন। সৎ মায়ের অত্যাচার সইতে না পেরে সেই গফরগাঁও থেকে চট্টগ্রাম এলেন আপা।কি মনে করে বটতলী না নেমে পাহাড়তলি স্টেসনে নামলেন কে জানে! থাকার জায়গা আর কাজ খুঁজছে বছর বারোর একটা মেয়ে, অবাক হবার মতো ঘটনাই বটে!

দেখতে শুনতে মন্দ না কিন্তু অচেনা একটা উঠতি বয়সের মেয়েকে সেই আমলেও সব বাড়িতে রাখা মুশকিল ছিল। বহু দ্বার ঘুরে শেষে এসে ঠাঁই নিলো আমাদের বাড়িতে, তাও নেহাতই আমার দাদির কারণে। বাড়িতে তখন এক বোবা নারী কাজের জন্য ছিল, সেও সেরকম সহায় সম্বলহীন নিরুপায় নারী বলে। মোর্শেদা আপাকেও দাদি সেইজন্য রাখলেন বাড়িতে। সোমত্থ মেয়ে কোথায় কার কুনজরে পড়ে নষ্ট হবে ভেবে।

তো সেই বছর বারোর মোর্শেদা টিকে গেলো আমাদেরই একজন হয়ে। কাজ চালানো গোছের লেখাপড়া সে জানে, বাংলা পড়তে পারে বানান করে করে। জানে কোরান শরিফ পড়তে, নামাজ কালাম রোযার নিয়মও জানে।

আশির দশকে তার মতো মেয়ে ভদ্র ঘরেও বড় কম ছিলোনা, যারা নেহাত তার মত লেখাপড়াই জানতো। এর বেশি লেখাপড়া জানার দরকার আছে বলে মুরুব্বিরা মনে করতেন না।

আপা দেখতে ভালো, কাজে কর্মে নিপুণ।

এহেন মোর্শেদা আপা কে দেখে পছন্দ না হবার কথা না। কিন্তু বিয়ে দিতে হলে চেহারার সঙ্গে বাপের টাকার জোর লাগে। আর লাগে বংশের পরিচয়, খান্দানের সুলুক সন্ধান। শরীফ ঘরে বিয়ে দিতে গেলে মোর্শেদা আপার পরিচয় গোপন করা যায়না।

শরীফ খান্দানে না হলেও আমরা মোটামুটি ভালো ঘরে তার বিয়ে দিতে পারবো এটা সবাই মানতাম। দাদির একরকম প্ল্যান ছিল আমাদের কোন একটা দোকানের ভালো কোন কর্মচারি দেখে তারে পাত্রস্থ করা হবে। ঘরের মেয়ে ঘরে থাকবে, ধর্মের কাজ করাও হবে। বিয়েতে যা খরচ হবে সেটাও দাদি দেবেন, হাজার হোক মোর্শেদা এ বাড়িতে আসা পর্যন্ত কাজ তো নেহাত কম করে নাই। মাস হিসাব করে তারে টাকা তো দেয় নাই কেউ।

কিন্তু ঘটনা যা ঘটলো তা একেবারেই অপ্রত্যাশিত।

ফুপু আগে কিছুই জানান নাই আমাদের। একেবারে বাড়ি এসে  দাওয়াত দিলেন মোর্শেদা আপার বউভাতের!তাও রীতিমতো দামি কার্ড ছাপিয়ে! সেই কার্ডের কি রমরমা কি চেহারা কি চেকনাই! সবার হতবাক চেহারার সামনে জানালেন বর ফুপুদের উল্টো দিকের বাড়ির মালিকের একমাত্র ছেলে। আর তারা সব জেনেই আপাকে তাদের বাড়ির বউ করে নিলেন। দাদিকে জানালেন দেনাপাওনা বলে কিছু নাই, সব খরচ ওদের বাড়ির। মোর্শেদাকে তারা সাজিয়ে নেবে, আমাদের কিছু করতে হবেনা। কিন্তু দাদি মানলেন না, সেই সন্ধেতেই বাবা কাকারা ছুটলেন বিয়ের সদাই কিনতে। বৌভাতের দিনই মোর্শেদার জন্য যা যা দেবার ইচ্ছা আছে দাদির, তা যাবে তার কাছে। সে যে এতিম না সবাই দেখুক।

ছোটচাচ্চু যাবেন সব গহনাপাতি, কাপড় চোপড় নিয়ে বৌভাতের সময় কথা ছিল।

ফুপুর আদরের ভাইঝি বলে তার সঙ্গে মোর্শেদা আপার বউভাতে গিয়েছিলাম।

লাল বেনারসি পরা, এক গা গহনা পরা আপা বসে আছেন রাজেন্দ্রাণী সেজে। দারুণ সুন্দর প্রজাপতি হার আপার গলায়। তাকে এতো সুন্দর লাগছিল, সত্যি সত্যি যেনো কোন রাণিকে দেখছি। আমাকে দেখেই কোলে টানলেন। সবাই চিনলো আমাকে আপার বোন বলে। ও বাড়িতে সবাই জানে মোর্শেদা আপা আমাদের একরকম জ্যাঠাতো বোন, বাবা মা নাই তাই আমরা তারে এনে রেখেছিলাম বাড়িতে।

জানতো কেবল তার বর, আমাদের দুলাভাই। তাকে আমার ফুপু সব সত্যি জানিয়েছেন। যখন আক্তার ভাই মোর্শেদা আপাকে দেখেন তিনি বোঝেন নাই আপা আমাদের রক্তের কেউ না। কিন্তু এতো ভালো লেগে গেল তাকে যে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। ফুপুর সাথে কথা বলতে গেলেন বিয়ের প্রসঙ্গে, সব কথা তখনই জানলেন কিন্তু সব জেনেও তিনি সরে গেলেন না, ফুপুর বহু বোঝানোতেও না।

এই বিয়েতে আদতে আমাদের পরিবারের কোন হাতই নাই, ফুপুরও না।

তার বরই তাকে দেখে জীবনসঙ্গিনী করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, নিজের মা বাবা আর পরিবারকে বুঝিয়েছিল। তার একটাই কথা, যাকে পছন্দ করলাম তাকেই বিয়ে করব। সে কোন পরিবারের, কোন জাতের সেটা জানা দরকার না।

সুখেই কাটছিলো বেশ অনেকদিন, ভালো করে বেঁচে থাকার সব রকমের আয়োজন ছিল। কিন্তু ওদের ঘরে কোন বাচ্চা এলো না।

বিয়ের পরে যখন জানা গেলো আপার বাচ্চা হবেনা তখন তাকে সবচে বড় সাপোর্ট দিয়েছিলেন আমাদের সেই দুলাভাই। শ্বশুরবাড়ি থেকে আপাকে কথা কিছু কম শুনতে হয় নাই কিন্তু তার স্বামী ছিলেন বরাবরই তার পাশে। তার এক কথা, বাচ্চা বানানোর মেশিনকে বিয়ে করি নাই। হলে ভালো না হলে আরো ভালো। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে, কাজেই দ্বিতীয় বিয়ের কথা তার সামনে তোলারই কারো সাহস হয় নাই।

কিন্তু পরিবারে আপার অবস্হান সময়ের সাথে সাথে বদলাতে লাগলো। সন্তানহীনা নারীর জন্য সমাজ নির্ধারিত সব রকমের অসম্মান অপমান জমা হতে লাগলো। একটা সময় এমন হলো যে এক সাথে যৌথ পরিবারে আর বসবাস করা সম্ভব হচ্ছিল না। আক্তার ভাই আপাকে নিয়ে আলাদা সংসার পাতলেন। দুলাভাই আপার নামে জমিজমা কিনে দিলেন যেন তার অবর্তমানে আপার কষ্ট না হয়।

আপা নিজের পরিবারে, সৎ মার কাছে আর কখনো ফিরে যাননি। কোন যোগাযোগ করেননি। তার পরিবার বলতে ছিলাম আমরাই আর তিনি তা বারবার তার কাজ দিয়ে প্রমাণ করেছেন। একদিন যে পরিবার তারে আশ্রয় দিয়েছিল, সম্মান দিয়েছিল সেই পরিবারই তার আসল পরিবার। অবস্হার পরিবর্তনে আপা আমাদের পর করেন নাই।

কিন্তু সংসার বরাবর সমান তালে চলে না, একরকম থাকে না। হঠাৎ করে আক্তার ভাই মারা গেলেন, আপারও জীবন বদলে গেলো। এক বন্ধুর গায়ে হলুদের নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেন আক্তার ভাই, রাতে ফেরার কথা ছিল না। পরদিন বিয়ে দুপুরে কিন্তু শহরের বাইরে বলে রাত হবার কথা। সেদিনও ফিরলেন না দেখে আপার রাগের সঙ্গে একটু অভিমানও হয়েছিল। কিন্তু তারপরের দিনও যখন এলেন না, সকাল গড়াতে তখন আপার চিন্তা হল। সেলফোনের যুগ সেটা না, বাসার ল্যান্ডফোনে ফোন করে তারে জানানো যেত ভাবলেন। ফের এটাও মনে হলো হয়তো বউভাতের কারণে আটকে গেছেন, বন্ধুরা ছাড়ছেনা তাকে।

বহু ভেবে এটাই সত্য মানলেন আপা, নিজের স্বামীকে বিশ্বাস করা আর সব স্ত্রীর মতো কর্তব্য মনে করেন তিনি। তবু অজানা আশঙ্কায় মনটা অস্হির হয়ে থাকলো। শেষে উপায় না পেয়ে পার করলেন আরো একটা দিন। বৃহস্পতি, শুক্রবার, শনিবারের পরে রবিবারের সকালে আর নিজেকে স্হির রাখতে পারলেন না তিনি। ছুটলেন শ্বশুরবাড়ির দিকে, হয়তো এলাকার কারো সাথে দেখা হয়ে থাকবে বিয়ে বা বৌভাতে। কিংবা চাচাতো দেওরেরা কেউ গেছে সেখানে, খবর একটা পাওয়া যাবে। কিন্তু জানতো না মোর্শেদা, তারই স্বামীর লাশ বাগানো গোসল দেয় লোকেরা। শ্বশুরমশাই মৃতের সৎকার করতে সব ব্যবস্হা করেছেন কেবল তার স্ত্রীকে খবর দেয়া জরুরি মনে করেন নাই।

আমাদের বাড়িতে খবর পৌঁছালো মৃত্যুর দ্বিতীয় দিন, আপাই খবর দিলেন। প্রথামত রান্না করা খাবারের বড় বড় ডেগ গেল ভ্যানে চড়ে, হাজার হোক তকরা এলাকার নামী লোক। মৃতের বাড়িতে সম্মানের ত্রুটি না হয়, সেই খেয়াল করেই খাবার দেয়া হলো। দেশি মোরগ, গরুর গোশত, মাছ, সবজি, ভর্তা ভাজি, ফল, দই কিছু যেনো বাদ না পড়ে। কিলো পাঁচেক ভালো দোকানের মিষ্টি গেলো সাথে।

সাদা শাড়ি পরা আপাকে দেখলাম বহুক্ষণ পরে, রান্নাঘরের তদারকি করতে। কতো মানুষ কতো রকমের ফরমায়েশ। আপা সেসব চুপচাপ মেনে চলছেন, মুখে হাসি নাই। গায়ের ঝকঝকে রঙ বদলে যেনো লাশের মতো রঙ হয়েছে তার। কথা বলবারও ফুরসত ছিলো না কারো সাথে। আপার শ্বশুর চারদিনের মাছ ফতেহার দাওয়াত দিলেন। সেই মতো আবার মিটিং বসল বাড়ি ফিরে। বড় তাজা মাছ দিতে হবে ঐ বাড়িতে, কোন রকমে কোন ত্রুটি করা যাবে না।

চারদিনের মাছ ফাতেহা মানে কুলখানি, দুপুরে আত্মীয় পরিজন সাদা ভাত খাবে মাছের সাথে। একেক আত্মীয় বাড়ি থেকে একেক রকম মাছ এসেছে। বিকেল পর্যন্ত এসব সামলে মোর্শেদা আপা ক্লান্ত কিন্তু তার ছুটি মিললো না। খাবারের আয়োজন সেরে তার শ্বশুর এবং বাড়ির সব মুরুব্বিরা মিলে বসলো আমাদের বাড়ির লোকের সাথে। যতো রকমের কুকথা সম্ভব তারা তুললেন আপার নামে। তখনই জানলাম, আক্তার ভাই সেই বন্ধুর হলুদের রাতেই স্ট্রোক করেছিলেন। সেখান থেকে কোনক্রমে তাকে একটা হাসপাতালে নেওয়া হয়, মারাও যান সেখানে। বন্ধুরা উপয়ান্তর না দেখে তার বাড়িতে লাশ আনে কিন্তু বউকে খবর জানাতে ভুলে যায়।

মোর্শেদার শ্বশুর স্পষ্ট জানান, আপনাদের মেয়ে আপনারা নিয়ে যান এখন। চারদিনের খাওয়া তো আমরা করে দিলাম। বাকি যা যা করবার তাও করবো কিন্তু এই বউকে ঘরে রাখা আর সম্ভব না। এর কারণেই ছেলেকে হারালাম আমরা, এবার আপনারা সামলান।

সেই রাতেই এক কাপড়ে আপা আবার পথে নামলেন, ফের তার ঠিকানা হলো আমাদের বাড়িতে। ততদিনে দাদি গত হয়েছেন। বাড়ির ছোটরা বড় হয়েছে, কারো কারো বিয়ের জন্য পাত্র দেখা চলছে কেউ করছে পড়াশোনা। এদের মধ্যে মধ্যবয়সী এক মোর্শেদা কখন এতটা বেমানান হয়ে গেল সে নিজেও জানেনা। এবার তার ঠাঁই হলো রান্নাঘরের টানা বারান্দার একদিকে, রান্নার কাঠ রাখার ফাঁকা চৌকিতে। বাড়িতে গ্যাস আছে এখন, খড়ির চুলা আর লাগেনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *