December 23, 2024
ফিচার ৩সাক্ষাৎকার

‘‘নারীবিদ্বেষ যে দেশে জনপ্রিয়, সে দেশে নারীবাদ জনপ্রিয় হবে না”

তসলিমা নাসরিনের পরিচয় নতুন করে দেবার কিছু নেই। তবু অল্প কথায় বললে বলা যায়, আশির দশকে সাহিত্য জগতে পা রাখেন সেসময় পেশায় চিকিৎসক তসলিমা নাসরিন। তার কবিতার মাধ্যমে কবি হিসেবে সুনাম কুড়ান। একসময় নারীবাদী কলাম লিখে চারিদিকে সাড়া ফেলেন। বিভিন্ন স্থানে বক্তব্য রাখেন লিঙ্গ বৈষম্য, ধর্মীয় গোঁড়ামি আর সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির বিরুদ্ধে। ধর্মান্ধতা ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে তার উচ্চকণ্ঠ বাঙালি নারী ও পুরুষকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। কিন্তু এসব কারণে একসময় দেশের ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন তিনি ও ক্রমাগত হত্যার হুমকি পেতে থাকেন। ১৯৯৪ সালে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। বাস করতে শুরু করেন সুইডেন, জার্মানি বা কখনো যুক্তরাষ্ট্রে । এখন ভারতে থাকছেন। তসলিমা নাসরিন নারীবাদী কলাম ছাড়াও লিখেছেন গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ; প্রকাশিত হয়েছে অসংখ্য বই। লিখেছেন সাত পর্বে আত্মজীবনী। তার বই বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বক্তৃতা  করে চলেছেন নানা দেশে নানা স্থানে। লেখালেখি ও কাজের জন্য পেয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও স্বীকৃতি, পৃথিবীজুড়ে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। এর মধ্যে রয়েছে আনন্দ সাহিত্য পুরস্কার, ফ্রান্স সরকারের দেয়া মানবাধিকার পুরস্কার, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের দেয়া শাখারভ পুরস্কার ইত্যাদি।

ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের জন্য প্রখ্যাত নারীবাদী লেখক তসলিমা নাসরিনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তার দীর্ঘদিনের বন্ধু নারীবাদী অ্যাক্টিভিস্ট নাহিদ সুলতানা। তাদের দুজনের বন্ধুত্ব সেই ১৯৯০ সাল থেকে।

ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হল।

 

 

নাহিদ সুলতানা: বস, আপনি কেমন আছেন?

তসলিমা নাসরিন: ভালো।

নাহিদ: আপনার কাছে আমার প্রথম প্রশ্ন, আপনি কেন নিজেকে একজন নারীবাদী মনে করেন?

তসলিমা: যেহেতু নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করি।

নাহিদ: বাংলাদেশের নারীর এখনকার অবস্থা মূল্যায়ন করবেন কীভাবে?

তসলিমা: বাংলাদেশের নারীদের আমি তো কাছ থেকে দেখি না আজ ২৫ বছর। দূর থেকে খুব বেশি কিছু বলা যায় না। তবে যা শুনেছি, যা পড়েছি, তাতে মনে হয় নারীরা ধর্মান্ধতা দ্বারা  আগের চেয়ে বেশি  আক্রান্ত। তবে পাশাপাশি একাডমিক শিক্ষা অর্জন এবং স্বনির্ভরতাও বেড়েছে নারীদের মধ্যে, কারণ পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেম এখন নারীকে ঘরবন্দি করার চেয়ে নারীকে দিয়ে টাকা আয় করানোর কথা বেশি ভাবে।

নাহিদ: বাংলাদেশের নারীবাদ আন্দোলনকে কীভাবে দেখছেন? এটি কি সঠিক পথে এগুচ্ছে?

তসলিমা: বাংলাদেশে নারীবাদ আন্দোলন আদৌ আছে বলে আমার মনে হয় না। যদি থাকতোই, তাহলে আজও দেশের পারিবারিক আইন ধর্মভিত্তিক থাকতো না। যদি থাকতোই, এত লাখো লাখো নারী নারী-নির্যাতনের সিম্বল হিজাব বোরখা পরার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তো না। এমন তো নয় যে ইরানের মতো হিজাব পরা বাধ্যতামূলক। প্রধানমন্ত্রী নারী হওয়া সত্তেও নারীআন্দোলনের নেত্রীরা যদি আইনে নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করতে না পারেন, মেয়েদের জন্য ঘর বাহির নিরাপদ না করতে পারেন, যদি দিন দিন জনপ্রিয় হওয়া নারীবিরোধী ওয়াজ  নিষিদ্ধ করতে না পারেন, নারীবিদ্বেষী মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিতে পারেন, তবে কবে পারবেন?

নাহিদ: আপনি কি দেশের বর্তমান নারীবাদ আন্দোলনের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত মনে করেন?

তসলিমা: দেশের নারীনেত্রীরা চিরকালই আমাকে বয়কট করেছে।

নাহিদ: আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশের মেয়েরা কথা বলতে শিখেছে? সাহসী হচ্ছে? প্রতিবাদ করছে?

তসলিমা: কিছু মেয়ে প্রতিবাদ করে, অধিকাংশ মেয়ে করে না। এই চিত্রটি সব ধরণের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে প্রায় একই।

নাহিদ: ৩০ বছর আগে আপনি ফেমিনিজম নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বেশ্যা আখ্যা পেয়েছিলেন। এখনও নারীবাদীরা একই আখ্যা পায়। সময় কি এগুলো এতটুকু?

তসলিমা: সবাই তো বলে না, ঘোর নারীবিদ্বেষী লোকেরা বলে। ওদের গ্রাহ্য না করাই উচিত। নারী পুরুষ উভয়কে নারীর সমানাধিকারের জন্য সংগ্রাম করতে হবে।

নাহিদ: নারীবাদ রাজনীতিকে আপনি কীভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান? একদম প্রাথমিক স্তরের মেথোডলজি কি হতে পারে? নারীবাদের আলাদা কোন রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করা নাকি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে নারীবাদ এজেন্ডাকে পুশ করা ?

তসলিমা: নারীবিদ্বেষ যে দেশে জনপ্রিয়, সে দেশে নারীবাদ জনপ্রিয় হবে না। সরকার যদি নারীর বিরুদ্ধে যেসব বৈষম্য বিদ্যমান, সেসব ঘোচানোর ব্যবস্থা করে, তাহলে ভালো হয়। সরকারকে চাপ দিতে হবে, সে কারণে সামাজিক আন্দোলন জরুরি, নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহনও জরুরি। অবশ্য নারীরাই যে নারীর সমানাধিকার চায় তা নয়। ভালো পুরুষও চায়। চায় না কারা? মূর্খ এবং ধুর্ত পুরুষ, আর তাদের মাথামোটা সহচরী নারী।

নাহিদ: ফেমিনিজম নিয়ে উপমহাদেশে একটা বড় ধরনের ভুল ধারনা আছে! নারীবাদীদের নিয়েও আছে। এর কারন কী এবং এই ধারনা দূর করতে হলে কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন ?

তসলিমা: প্রচুর পুরুষ মনে করে নারীরা সমান অধিকার পেলে, পুরুষেরা এতকাল নারীকে যেভাবে নির্যাতন করেছে, সেভাবে নির্যাতন করবে পুরুষদের। অপরাধীদের অপরাধ করা বন্ধ করতে বলা হচ্ছে, আর অপরাধীরা শাস্তির ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে, আসলে এসব অন্য কিছু নয়, নারীবাদীরা পুরুষদের মতো নিষ্ঠুর নির্যাতক  হবে – এ কথা প্রচার করে পুরুষদের আরও বেশি নারীবিদ্বেষী বানানোর ব্যবস্থা করা।

নাহিদ: আমরা জানি যে, সরকারগুলো এখনও চরমভাবে পুরুষতান্ত্রিক। আপনার কী মনে হয়, এই ধরনের আচরণ পাল্টে সরকার কে কীভাবে নারীবাদী করা যায়?

তসলিমা: ভালো সরকার হলে চাপ দেওয়ার দরকার হয় না। সংবিধানে লেখা আছে, নারী পুরুষ উভয়ে সমান। সেই অনুযায়ী সরকারের কাজ করা উচিত।।

নাহিদ: ফেমিনিজম নিয়ে লেখালেখি করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ আপনার কাছে?

তসলিমা: খুবই।

নাহিদ: আমরা সকলেই পুরুষতন্ত্র দেখে, জেনে, শুনে, বুঝে এবং চর্চা করে বড় হই বা বেড়ে উঠি এবং খুব বেশী করে শিখি এই সিস্টেমকে, তো এটা নিয়ে আমাদের কী করণীয়?

তসলিমা: এটাকে বাতিল করা অবশ্য করণীয়।

নাহিদ: বাংলাদেশের নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন এবং সামাজিক ও ধর্মীয় নির্যাতন আগের চেয়ে বেড়েছে না কমেছে?

তসলিমা: আগেও ছিল। আগে রিপোর্ট হতো না, এখন হয়।

নাহিদ: ১৯৯৩ সাল থেকে বাধ্য হয়ে আপনি দেশের বাইরে। এর মধ্যে আপনার মার অসুস্থতার সময় ১৯৯৮ সালে আপনি দেশে এসেছিলেন। অনেকেই বলেন যে, আপনি তখন দেশে থেকে গেলেন না কেন? আপনি কি তখন কোন শর্ত সাপেক্ষে দেশে আসার অনুমতি পেয়েছিলেন ?

তসলিমা: ১৯৯৪ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত দেশের বাইরে। সরকারের বাধা সত্তেও আমি দেশে ঢুকে গিয়েছিলাম ১৯৯৮ সালে। মাকে তখন ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে, মা আর তিন মাস পর মারা যাবেন। সরকারের অবাধ্য হয়েছি, দেশে ঢুকেছি, সেই রাগ  শেখ হাসিনার ছিল। তিন মাস পর তিনি খালেদা জিয়ার মতোই আচরণ করলেন। আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন, আমাকে ছলে বলে কৌশলে দেশ থেকে বের করেছেন। আজও দেশে ঢুকতে দেন না। না দেন ভিসা, না করেন আমার বাংলাদেশের পাসপোর্ট রিনিউ, না তোলেন বই থেকে নিষেধাজ্ঞা।

নাহিদ: পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম প্রায় দেড়শো বছরের সংগ্রম-দীর্ঘ সময়! এই দীর্ঘ সময়ের ফল কী বা কতটুকু পেলাম আমরা ?

তসলিমা: প্রায় কিছুই না।

নাহিদ: হিজাব পরা একটি বাস্তবতা এখন। নারীবাদে এর অবস্থান কী হবে? হিজাব পরিহিতাদেরকে বিবেচনায় নিয়ে নারীবাদ তার কৌশল নির্ধারন করবে নাকি তাদের বয়কট করবে ?

তসলিমা: হিজাবিদের আমি নারীবাদী মনে করি না, কেউ কেউ মনে করতে পারে। নারীবাদ বিভিন্ন রকম। আমার নারীবাদে ধর্মের কোনও জায়গা নেই, যেহেতু ধর্ম নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্যকে সমর্থন করে।

নাহিদ: নারীবাদ যখন অনেকের কাছে একটি গালি হিসেবে বিবেচিত এবং নারীবাদীরা যখন আক্রমণের শিকার, তখন অনেকেই এর গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রেখেছেন, আপনি এই বিষয়টি কীভাবে দেখেন এবং সেখানে নারীবাদের ভবিষ্যত গতিপথ কীভাবে এগুবে বলে আপনি মনে করেন ?

তসলিমা: বাংলাদেশে নারীবাদকে গালি হিসেবে তো নেবেই লোকেরা। বাংলাদেশের দুই নারী প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের এক নারীবাদী লেখিকাকে দেশ থেকে তাড়িয়েছে, আজও তাকে দেশে ঢুকতে দেয় না। আর তুমি কিনা বাংলাদেশের নারীবাদ নারীবাদ করছো। যে তথাকথিত নারীবাদীরা আমার নির্বাসনের বিরুদ্ধে বাক্য উচ্চারণ করে না, প্রতিবাদ করে না, তারা নারীবাদী নয়।

নাহিদ: বাংলাদেশের নারীবাদ কি ওয়েভ ধরে এগুবে? নাকি আমাদের নারীবাদ আন্দোলন ভিন্নভাবে ভাববার অবকাশ আছে ?

তসলিমা: নারীবাদই নাই, আবার ওয়েভ।

নাহিদ: আমরা জানি যে, পুরুষতান্ত্রিকতা শুধু নারীদেরকে নির্যাতন করে না, পুরুষদেরও নির্যাতন করে কিন্তু নারীরা এর বিরুদ্ধে যে ভাবে সোচ্চার হন, পুরুষরা তা হন না, এর কারণ কি বলে মনে করেন?

তসলিমা: পুরুষরা মনে করে না পুরুষতান্ত্রিকতা তাদের নির্যাতন করছে, তারা ভালোবাসে এই সিস্টেমকে।

নাহিদ: এদেশের নারীবাদীরা সেই অর্থে একতাবদ্ধ হতে পারে নি। এর কারণ কী বলে ভাবেন ?

তসলিমা: কারণ তারা সিরিয়াস না এই ব্যাপারে।

নাহিদ: আপনার লেখালেখি কেমন চলছে? কী লিখছেন এখন?

তসলিমা: কত কিছুই তো লিখছি। বাংলাদেশে তো ছাপানো হয় না। তোমার ‘’নারীবাদীরা’ জানে এই কথা যে আমার নারীবাদ বিষয়ক লেখা বাংলাদেশে নিষিদ্ধ?

নাহিদ: আপনার সময় কাটে কীভাবে? কী কী কাজ করছেন এখন?

তসলিমা: লেখাপড়ায়।

নাহিদ: আপনি কি এখনও অপেক্ষা করেন একদিন দেশে ফিরবেন?

তসলিমা: তোমাদের দেশের যা অবস্থা, ওই দেশে ফেরার ইচ্ছে না হওয়াটাই উচিত। কিন্তু দেশে ফেরার অধিকার রক্ষাটা চাই।

নাহিদ: দেশের সাথে যোগাযোগ আছে?

তসলিমা: হাতে গোনা দুই একজন ভালো মানুষের সংগে যোগাযোগ আছে।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *