পুরুষতন্ত্রে আক্রান্ত আমার ভাষা
সোনিয়া সরকার জয়া।। আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহৃত ভাষায় কিছু অসামঞ্জস্য চোখে পড়ার মত। যেমন বিশ্বেজুড়ে বহুল ব্যবহৃত স্টুডেন্ট শব্দটির বাংলা পরিভাষা শিক্ষার্থী অর্থাৎ ছেলে-মেয়ে আলাদা না করে জ্ঞান ও বিদ্যালাভ করা সকলকেই “ছাত্র” বলা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে বিদ্যার্থী মেয়ে হলেই তাকে ছাত্র বা শিক্ষার্থী না বলে বলা হয় “ছাত্রী”। পরিতাপের বিষয় এই, যখন ব্যাকরণ বইয়েও ছাত্রের বিপরীত শব্দ হিসেবে ছাত্রী শব্দটি যুগ যুগ ধরে ব্যবহৃত হতে থাকে।
এখানে পুরুষতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় গণিত বইতে থাকা নির্ধারিত কিছু অংক করতে গিয়ে শিশুদের মনে ঢুকিয়ে দেয়া হয় শারীরিক শক্তির একচ্ছত্র অধিকারী শুধু পুরুষই হয়। যেমন- “একটি কাজ ১ জন পুরুষের করতে ৩ দিন ও ৪ জন মহিলার করতে ৫ দিন সময় লাগে!
বাংলা ব্যাকরণের লিঙ্গান্তর অধ্যায়ে পরিষ্কার লেখা থাকে “কুলটা” নারীর কোন পুরুষবাচক শব্দ নেই। অথচ সমাজ জেনেও স্বীকার করে না পুরুষও পতিত হয়। সন্তান জন্ম দিতে না পারার অক্ষমতা বাবার থাকলেও ব্যাকরণ অনুসারে বন্ধ্যা শব্দটি শুধু মেয়েদের জন্যই উচ্চারিত হয়। অসূর্যস্পর্শাও তেমন একটি শব্দ। সতী শব্দটি এত বেশি প্রচলিত, অথচ সতী বলতে যে যৌনতার শুদ্ধতার কথা বলা হয়, পুরুষবাচক সৎ শব্দটি সেটি বুঝায় না। সপত্নী বা সতীনের কোনো পুংলিঙ্গ না লেখা থাকলেও ইংরেজী গ্রামারে Wife এর বহুবচন Wives শব্দটি নির্লজ্জের মত ব্যবহৃত হয়। ধর্ম বইয়ে অমুক তমুকের ডজনখানেক বউ থাকে এবং এদের বিশেষায়িত করা হয় “পতিব্রতা” “গৃহস্থালি” ও “সতীসাধ্বী” নামক মেয়াদোত্তীর্ণ শব্দাবলী দিয়ে!
ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতদূর জানি মানুষ বা প্রাণি ছাড়া অন্যকিছুর লিঙ্গান্তর হয় না। কিন্তু এই সমাজে কাজ বা পেশার ক্ষেত্রে এত বেশি লিঙ্গান্তর হয় যে এটা রীতিমত বৈষম্যের পর্যায়ে চলে গেছে। এখানে ডাক্তার, লেখক, অফিসার, সাংবাদিক, পাইলট, মন্ত্রী, খেলোয়াড়, ব্যাংকার, শিক্ষক, সেনাসদস্য, ব্যবসায়ী, অভিনয়শিল্পী, পরিচালক এসব পেশার নাম শুনলেই আমরা শুধু পুরুষ কর্মীদের বুঝি। এসব কর্মক্ষেত্রে নারীও নিয়োজিত থাকে তা সবাই এমন ভাবে ভুলে যায় যে মনে করানোর জন্য সবকটি পেশার আগে নারী/মহিলা শব্দটি বিশেষভাবে সংযোজন করতে হয়। যেমন মহিলা প্রেসিডেন্ট, নারী ভিসি, নারী সার্জেন্ট, মহিলা কবি, নারী ক্রিকেটার, নারী নেত্রী, মহিলা প্রকৌশলী ইত্যাদি। এরমধ্যে যেসব নারী আবার শিক্ষকতা পেশায় আছেন তাদের শিক্ষক বা অধ্যাপক সম্বোধন করতেও সবার কোথায় যেন বাধে! বলতে হয় “শিক্ষিকা”, “শিক্ষয়িত্রী” বা “অধ্যাপিকা”। দেশ বা প্রতিষ্ঠান প্রধান নারী হলে সংজ্ঞায়িত করা হয় নারী প্রধানমন্ত্রী, নারী অধ্যক্ষ, মহিলা রাষ্ট্রদূত, নারী রাষ্ট্রপতি, নারী উপাচার্য বা মহিলা উপাধ্যায় নামে।
এখানে ছেলেরাও এসব সংস্কার থেকে মুক্ত না। কোনো পুরুষ ভালো রান্না করে, সেলাইয়ের কাজে হাত ভালো, নিজের কাপড় নিজেই ধোয়, মশারী টাঙায় বা বিছানা নিজে গোছায়, ঘর ঝাড়ু দেয়, পাঞ্জাবির সাথে শাল পরে, হাতে/কানে/গলায় অলংকার পরে, চুল লম্বা রাখে, উশৃঙ্খলতার বদলে ভদ্রভাবে চলাফেরা করে বা মদ,সিগারেট ছুঁয়ে দেখে না, শিষ দেয়না, টিজ করেনা, দুইবেলা মা/বোন তুলে অশ্লীল গালি দেয়না, নোংরামি, নষ্টামি থেকে দূরে থাকে, শিল্পচর্চায় জড়িত থাকে, ছবি আঁকে, নম্র স্বরে কথা বলে- তাহলে এখানে তাকে নির্দ্বিধায় “হাফ লেডিস” ডাকা হয়। ছেলে হয়েও কেউ যদি নাচে বা সে ডান্সকে পেশা হিসেবে নেয় তাহলে তাকে হিজরা উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এরা এটাও জানে না হিজরা কোনো গালি না। নৃত্যশিল্পী হওয়ার দায়ে এদেশে রোষানলে পড়তে হয়েছিলো আনন্দমোহন থেকে ইলিয়াস জাভেদকে। গান, কবিতা রচনার অপরাধে রজনীকান্ত, রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও “মেয়েলি” স্বভাব খুঁজে পেয়েছিলো আমাদের মহান সমাজ।
এখানে মেয়েদের জন্য সমাজের নির্ধারণ করে রাখা কাজ পুরুষরা করা অন্যায়। আর কন্যা/মেয়ে/নারী হওয়া একটি পাপ, তারা অপবিত্র বলে বিবেচিত হয়! সুবোধকে তাই এখান থেকে প্রতিনিয়ত পালিয়ে বেড়াতে হয়।
সোনিয়া সরকার জয়া: শিক্ষার্থী
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখা লেখকের নিজস্ব মতামত]