উপার্জনক্ষম নারী মাত্রই এমপাওয়ার্ড নয়!
আফরোজ ন্যান্সি।। সম্প্রতি বলিউডের এক নায়িকার উক্তি নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে দারুণ আলোচনা- সমালোচনা হচ্ছে। এমনিতে রুমকি যথেষ্ট মুখচোরা, তবে এই টপিকে গ্রুপের অন্য এক সদস্যের সাথে ওর দারুণ এক তর্কই হয়ে গেলো গতকাল।
নারীবাদ শব্দটার সাথে কবে প্রথম পরিচয় হলো তা স্পষ্ট করে মনে না থাকলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে রুমকি একটু একটু করে নারীবাদকে বুঝতে শুরু করেছে। নারীবাদ নিয়ে আলোচনা উঠলেই কিছু শব্দ খুব অনিবার্যভাবে সামনে চলে আসে- ব্যক্তিস্বাধীনতা, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, পোশাকের স্বাধীনতা ইত্যাদি। ছয়-সাত জনের একটা গ্রুপ আছে রুমকিদের। ওরা একেকদিন নারীবাদের সাথে রিলেটেড বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। ইন্ট্রোভার্ট ক্যারেক্টার হওয়ার কারণে রুমকি কেবল সবার আলোচনা শোনে আর অবসরে নিজের মনে মনে এসব নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিখন্ডন করে।
গত আড্ডায় তানিশা যখন বলিউডের ওই নায়িকার কথার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, তখন রুমকির কী যে হলো, নিজের স্বভাব থেকে বেরিয়ে এসে সে গড়গড় করে কত কিই না বললো। আর বলবে নাই বা কেন, অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী প্রত্যেক নারীই যে এমপাওয়ার্ড উইমেন নয় এই বাস্তবতার জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত তো রুমকি ছোটোবেলা থেকেই দেখে আসছে। জন্মের পর থেকে রুমকি দেখছে ওর বাবা একজন বেকার, অকর্মন্য, পরিবারের প্রতি দায়িত্বহীন একজন মানুষ। মাই প্রাইমারি স্কুলে চাকুরি করার পাশাপাশি সেলাই এর কাজ করে অনেক কষ্টে সংসারটাকে টিকিয়ে রেখেছেন। রুমকি আর ওর আরো দুই ভাই-বোনের লেখাপড়া, বয়স্ক দাদীর চিকিৎসাসহ সংসারের সবার ভরনপোষণের ভার মা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন কোনোরকম দ্বিধা না করেই।
বিনিময়ে মা কী পেয়েছিলেন?
সবার অবহেলা, অসন্তোষ, মানসিক এবং শারিরীক নির্যাতন! একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমকি বলে- মা তো নিজে আয় করতেন এবং নিজের আয়ে শুধু নিজের নয় বরং গোটা সংসারের খরচ চালাতেন তবু মাকে ক্ষমতাবান নারী বলা যায় কি! সংসারে পিতার ভূমিকা পালন করলেও কর্তাব্যক্তি কিন্তু তিনি ছিলেন না, উল্টো পান থেকে চুন খসলে পরিবারের কর্তাটির হাতে মার খাওয়াই ছিলো তার নিয়তি। মনে ও মননে একজন আধুনিক নারী হয়েও ডিভোর্সের কথা ভাবার মতোন মানসিক জোর মায়ের ছিলো না হয়তো তাই সারাজীবন মার খেয়ে এই সংসারেই পরে থেকেছেন।
তানিশা সহজেই বলতে পারে, তোর মায়ের ব্যাপারটা ব্যতিক্রম।
কিন্তু আশেপাশে আরো তো দেখছে। ওদের ভার্সিটিরই এক সিনিয়রের সাথে রুমকির বেশ সখ্যতা। ইনফ্যাক্ট ভার্সিটিতে ভর্তির সময় থেকে- ভর্তি হওয়া, হলে ওঠা সব ব্যাপারেই সোমা আপু বেশ হেল্প করেছে রুমকিকে। সেই সোমা আপু ঢাকা ভার্সিটি থেকে পোস্ট-গ্রাজুয়েশান শেষ করে প্রথম শ্রেনির সরকারি চাকুরি নিলো, বিয়ে করলো পছন্দের মানুষকে। স্বাভাবিকভাবেই সোমা আপুকে একজন এমপাওয়ারর্ড উইমেন মনে হবে। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ন ভিন্ন। নামমাত্র স্যালারিতে চাকুরি করা সোমা আপুর হাজবেন্ড কিন্তু নির্বিঘ্নে বৌয়ের টাকায় খাচ্ছে-দাচ্ছে, ব্রান্ডের কাপড় পরছে, বিদেশি দামী মদ খাচ্ছে, নানান মেয়েদের সাথে প্রেম করছে আবার বৌয়ের টাকায়ই প্রেমিকাদের দামী গিফট কিনে দিচ্ছে। আর সোমা আপু কিছু বলতে গেলেই ঝগড়া হয়। তার হাজব্যান্ড নোংরা ভাষায় তাকে গালিগালাজ করে, গায়ে হাত তোলে। বিয়ের প্রথম সপ্তাহ না ঘুরতেই সোমা আপুর মনে অস্বস্তি শুরু হয়েছিল, কিন্তু তবু গত তিন বছর ধরে সোমা আপু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। হাজব্যান্ডের বিষয়টা বাদ দিলে সোমা আপু এই সমাজে একজন প্রতিষ্ঠিত, ক্ষমতাবান, স্বাধীন নারী ব্যক্তিত্ব কিন্তু ঘরের পুরুষটির কাছে তিনি শুধুই একজন নারী যার মূল কাজ হলো ঘরের কাজ করা, বাচ্চা লালন-পালন করা এবং পতিধর্ম পালন করা।
তানিশা পাল্টা লজিক দেওয়ার আগেই রুমকি বলে- তোর বড় আপুর গল্প তো তুই নিজেই আমাদের বলেছিস। একজন স্বাধীনচেতা ওয়ার্কিং উইমেন হয়েও দিনশেষে বাসায় ফিরে ঘরের সমস্ত কাজ তার একারই করতে হয়। এমনকি মিসক্যারেজের পর হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরে সেদিনই ঢুকতে হয়েছিলো রান্নাঘরে। কেননা জামাইবাবুটি মনে করেন রান্না করা পুরুষের কম্ম নয়।
তাছাড়া শুধু হাউজহোল্ড ওয়ার্ক ক্যানো, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই তো নারীদের কম বেতনে বেশি কাজ করিয়ে নেয়ার ট্রেন্ড চালু আছে। তাই শুধু বড় ডিগ্রি আর বড় চাকুরি করে বেশি টাকা আয় করলেই রাতারাতি নারী স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে এটা ভাবা বোকামি। যে দেশে নারী স্বাধীনতার বুলি আওড়ে প্রতি পদে পদে নারীকে তার প্রাপ্যটুকুও দেওয়া হচ্ছেনা সেই দেশে অধিকার আদায় করতে হলে নারীকে আরো বেশি সাহসী, আরো বেশি বেপরোয়া তো হতেই হবে। স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতা আদায় করা খুব কঠিন ব্যাপার আর যদি বিষয়টি হয় নারীর স্বাধীনতা, তাহলে এই রন্ধ্রে রন্ধ্রে পুরুষতন্ত্র ধারণ করে রাখা সমাজ কখনোই তা হতে দেবে না। তাই স্বাধীনতার জন্যে যার যা কিছু আছে তাই নিয়েই যুদ্ধটা করে যেতে হবে যতদিন না স্বাধীনতা আসে। এখানে পুরুষতন্ত্রের নির্দিষ্ট করে দেওয়া অপশন থেকেই বেছে নিতে যদি হয় তাহলে আর স্বাধীনতা কিসের!
রুমকি বেশ একটা স্বস্তিবোধ করলো কথাগুলো বলতে পেরে। মায়ের মতো, সোমা আপুর মতো আরো অনেক নাম না জানা নিপীড়িত নারীর গভীর দুঃখবোধ রুমকিকে আচ্ছন্ন করে রাখে অনেকটা সময়। মনে মনে ও নিজেকে সান্তনা দেয় এই ভেবে যে একদিন নিশ্চয়ই সারা পৃথিবীর নারী সত্যিকারের এমপাওয়ার্ড উইমেন হয়ে উঠবে। পুরুষতন্ত্রের গছিয়ে দেওয়া ছেলেভুলানো খেলনায় তারা আর সান্তনা খুঁজবে না। সেই দিন পৃথিবীতে পুরুষতন্ত্রের বিনাশ আর শুভবোধের আবির্ভাব হবে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য শোষনহীন সেইরকম এক পৃথিবীর স্বপ্নই তো দেখায় নারীবাদ।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব মতামত]