আমাকে একজন নারীবাদী বাবা দাও, আমি এক সমতার জাতি উপহার দেব
শাশ্বতী বিপ্লব।। এ বছরের নারী দিবসের থিম হলো ‘সমতার প্রজন্ম’। কিন্তু যেই দেশে সন্তানের অভিভাবকত্ব বাবার দখলে, সন্তানের পাশাপাশি একজন পুরুষ তার স্ত্রীরও অফিসিয়াল অভিভাবক, নারী-পুরুষের সম্পত্তির উত্তরাধিকার সমান নয়, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ৩৬.৩ শতাংশ, নারী পুরুষের মজুরি বৈষম্য স্বতঃসিদ্ধ, উচ্চপদে নারীর সংখ্যা হাতেগোনা, বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে নারী কর্মীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া “ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট” হিসাবে পরিগণিত, কর্মজীবী নারী-পুরুষের শিশুদের জন্য ডে-কেয়ার ব্যবস্থা নাই এবং সর্বোপরি এই প্রজন্মের একটা বড় অংশ নারী কোটার বিরোধী, সেই দেশে একটি ‘সমতার প্রজন্ম’ আশা করাটা অনেকটা কাজির গোয়ালের মতো। কিতাবে আছে, গোয়ালে নাই।
‘সমতা’ খুব সহজ কথা নয়। একটি সমতাভিত্তিক সমাজ তৈরি করতে হলে, সেই সমাজের একটি পুরো প্রজন্মকে সমতা শেখাতে হলে, সবার আগে তাকে সমতা শব্দটার প্রায়োগিক অর্থটা বোঝানো দরকার। দরকার সমতার চর্চার ভিতরে তাকে বড় করে তোলা। দরকার সমতাকে তার অভ্যাসে পরিণত করা। শুধুমাত্র তাহলেই, এই প্রজন্ম যখন রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারক হবে, সমাজের নেতৃত্ব দেবে তখন সে সমতার প্রায়োগিক সংজ্ঞাটা অনুসরণ করতে সক্ষম হবে। এখন সমতার এই সংজ্ঞাটা তাকে কে শেখাবে? রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নাকি পরিবার?
দায়িত্ব আসলে সকলেরই। সবাই শেখাবে। কিন্তু প্রধান দায়িত্ব পরিবারের। না হলে শুধু তত্ত্বই শেখা হবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না। যদি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সমতার বোধ না থাকে, চর্চা না থাকে, তবে বৃহত্তর সমাজে সমতার আশা করাটা অন্যায়।
ধরুন, একটি পরিবারে বাবা একটি কর্তা চরিত্র। তিনি উপার্জন করেন এবং পরিবারের সদস্যদের শাসন করেন। পরিবারের সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তিনি নেন। মা মূলত গৃহকর্ম করেন। তিনি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। যেকোন কাজে তাকে বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। বাবা হুকুম করেন এবং মা পালন করেন। পরিবারটিতে বাবা মূলত অর্থের যোগানদাতা এবং মা সেবা প্রদানকারী। এই পরিবারটিতে বাবা প্রধান চরিত্র এবং মা ও অন্যান্যরা পার্শ্ব চরিত্র। সেই পরিবারের ছেলে সন্তানটি ছোটবেলা থেকেই নিজেকেও কর্তা বা নিয়ন্ত্রণকারী হিসাবে ভাবতে শেখে। পুরুষ হিসাবে তার একধরনের “ইগো” তৈরি হয়। যার কোনরকম ব্যত্যয়ে সে আহত বোধ করে। বড় হতে হতে সেও নিজেকে তৈরি করতে থাকে একজন উপার্জনকারী হিসাবে। যে কিনা বাবার মতোই একটি পরিবারের দায়িত্ব নেবে এবং শাসন করবে। যোগ্যতা যাই হোক, চিন্তায় ও মননে, পরিবারে এবং বৃহত্তর সমাজে সে নিজেকে সুপিরিয়র ভাবে।
অন্যদিকে, সেই পরিবারের মেয়েটি ছোটবেলা থেকেই নিজেকে অধঃস্তন বা ইনফিরিয়র ভাবতে শেখে। মানসিকভাবে সে ছোটবেলা থেকেই পার্শ্বচরিত্র এবং সেবাদানকারী। নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতা তার তৈরি হয় না। সে আজ্ঞা পালনকারী। সে অন্যের পরিবারের দায়িত্ব নেয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করে। বড় হয়ে সে যদি কর্মজীবীও হয়, তবু সংসারে সে অধঃস্তনই থাকে। কর্মক্ষেত্রে যেমন তেমন, সংসারে দায়িত্বের অসমবন্টন সে মেনে নেয়। এই যখন বাস্তবতা, তখন সেই পরিবারে বেড়ে ওঠা প্রজন্মকে দায়িত্বে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমতাসহ পরিবারে সকলেই সমানভাবে প্রধান চরিত্র হয়ে ওঠা শেখাতে হলে বাবার ভূমিকা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন, “আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।” আমি বলি, “আমাকে একজন নারীবাদী বাবা দাও, আমি একটি সমতার জাতি দেব।” যে বাবা নারী পুরুষের সমতায় বিশ্বাস করবেন। যে বাবা নিজেকে কর্তা মনে করবেন না। যে বাবা একা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন না। যে বাবা তার পুত্র কন্যাকে সমান চোখে দেখবেন। যে বাবা তার সম্পদের সমবন্টন নিশ্চিত করেন। যে বাবা ঘরের কাজ ভাগ করে নিতে কুণ্ঠা বোধ করবেন না। যে বাবা শুধুই হুকুমকারী নন, পালনকারীও। যে বাবা নিজে সম্মান পাওয়ার পাশাপাশি পরিবারে মাকেও সমান সম্মান দেবেন।
নেপোলিয়ন ছিলেন একজন যুদ্ধবাজ জেনারেল। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, বাবা তথা পুরুষের কাজ ঘরের বাইরে, যুদ্ধের ময়দানে। তাদের প্রধান কাজ অন্যের দেশ দখল করা, সম্পদ আহরণ করা। এখনকার পুরুষতান্ত্রিক নারী-পুরুষও ভাবে, বাবাদের কাজ শুধু উপার্জন করা আর সংসারে ছড়ি ঘোরানো। তাই নেপোলিয়নের মতো এই যুগেও বাবারা কদাচিৎ পরিবার ও সন্তানকে গুণগত সময় (quality time) দেয়ার কথা ভাবেন। তাদের বেশিরভাগ সময়টাই বাইরে খরচ হয়ে যায়।
একটা সমতার সমাজের স্বপ্নে আমরা ঘরে বৈষম্য জিইয়ে রেখে বাইরে রাজনৈতিক দল বানাই, কিন্তু সংসারে ক্ষমতার রাজনীতিটাকে অস্বীকার করি৷ মাঠে ময়দানে মিটিং-মিছিল করি কিন্তু পরিবারে নিজের ভূমিকা সম্পর্কে উদাসীন থাকি। বাইরে এতোকিছু না করে, আমরা যদি একটু ঘরের দিকে মনোযোগ দিতাম, তাহলে সমতা অর্জনের লক্ষ্যটা অনেক সহজেই অর্জিত হতে পারতো।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব মতামত]