বদলে দেওয়ার সংগ্রামে ওরাও আছে স্পর্ধা বুকে
দীপ্সিতা ধর।।
‘তুমি মাটিতে অন্যায় লিখো
আমরা আকাশে ইনকিলাব এঁকে দেব।’
লাইনটা সবার খুব চেনা। সিএএ, এনআরসি, এনপিআর-বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুখ, সাংস্কৃতিক কর্মী, কবি এবং অবশ্যই ছাত্র প্রতিনিধি আমিরের কবিতা ‘সব ইয়াদ রাখ্খা জায়েগা’ (আমরা সব মনে রাখব)-র শেষ দু’লাইন। কবিতার ভঙ্গিমাটা অসাধারণ। কবি ধরেই নিচ্ছেন, এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা তার বিপক্ষে। তার আদালত, আইন, পুলিশ এইসব কিছু তার বিপক্ষে। অথচ কী সাগ্রহে কী উৎসাহে, কী অদম্য জেদে আমির লিখছে, খুন হয়ে যাওয়ার পরও মৃতের সত্তা ভূত হয়ে ফিরে আসবে, বিচারের দাবিতে, বারবার মনে করিয়ে দেবে খুনি কে? ঠিক যেমন করে চিলির গণঅভ্যুত্থানের সময়ে মেয়েরা চোখে কাপড় বেঁধে রাস্তায় চেঁচিয়ে বলেছিল, ‘el violador eras tu’, যার ইংরেজি অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, ‘The rapist is you’।
প্রতিদিনের বেড়ে চলা হিংসা, যৌন উৎপীড়ন, ধর্ষণ, খুন। দোষী কে? হাজার হাজার মহিলা উদাত্ত কণ্ঠে চেঁচিয়ে বলেন, তুমি, এই তোমরা যারা মেয়েদের পোশাকের দৈর্ঘ্যে তাঁদের চরিত্র মাপ, এই তোমরা, যারা উর্দিতে, কাঁধে লাগানো তারায় অনায়াসে ঢেকে দাও তোমাদের অপরাধ, নিরপরাধ মানুষের রক্ত, খুনি তোমরা, ধর্ষক তোমরা।
‘আর্টিকেল ১৫’ ছবিতে দেখেছেন নিশ্চয়ই, দলিত, গরিব খেটে-খাওয়া মেয়েটা ২ টাকা মজুরি বাড়াতে বলার অপরাধে ধর্ষিত হয়। একবার নয়, বারবার। ঠিকাদার ‘অওকাত’ দেখাতে ধর্ষণ করে, পুলিশের বড়বাবু শখ মেটাতে, সাব ইন্সপেক্টর নিহাল সিং এমনিই, কোনও কারণ ছাড়াই, সবাই করছে তাই। আসলে মেয়ে হওয়া, দলিত হওয়া, গরিব হওয়া ভারতবর্ষের সমাজে, সংস্কৃতিতে অনেকটা অভিশাপের মতো। মহিলা হয়ে জন্মানোই ধর্ষণের জন্য যথেষ্ট। দলিত হয়ে জন্মানোই বিনা বিচারে মরে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। গরিব লোকেদের জীবনের কোনও মূল্য হয় না।
আর এই যাদের জীবন রাষ্ট্রের কাছে মূল্যহীন, তাদেরই কথা বলছে আমিরের কবিতা। ধর্ষিত হওয়া মায়েদের, দাঙ্গায় খুন হয়ে যাওয়া ভাইদের, আত্মহত্যা করতে বাধ্য হওয়া যুবতীর।
তুমি আদালতে বসে মশকরা লিখো
আমরা দেওয়াল রাস্তা ন্যায়ের দাবি লিখবো।
এখন ৮ মার্চ মানেই রুটিন করে নারীবাদী হওয়ার দিন। মা’কে সম্মান করো, মেয়েকে সম্মান করো, কেন? কারণ মেয়ে ক’দিন পর ‘মা’ হবে। মা হয়ে বংশবৃদ্ধি করবে। আর ঠিক এই কারণেই মায়েদের মেয়েদের সম্মান করো। তাঁরা বংশবৃদ্ধির একমাত্র উপায়। ‘মিন্স অব প্রোডাকশনস’ আর তাই তাদের মহিমান্বিত করো। প্রতিদিন-প্রতিনিয়ত মা হতে পারাকে স্বৈর্গিক, দৈবিক বানিয়ে তোলে। যাতে মহিলা মাত্রই মা হওয়া এবং মা হলেই সম্মান পাওয়া—এই দু’টিকে মহিলা জীবনের ধ্রূবসত্য বানিয়ে নেওয়া যায়। মা হওয়ার জন্য একটি বাবা পাওয়া জরুরি। বাবা পাওয়ার জন্য বিয়ে জরুরি। বিয়ে হতে গেলে জাতি-গোত্র, স্ট্যাটাস, গায়ের রং, বাবার বাড়ি, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স এবং কুষ্টি মেলাতেই হবে। সে অনেক ঝক্কির ব্যাপার। ভদ্রবাড়ি, যারা পণ না পেলে পুড়িয়ে মারে না, তা খুঁজে পাওয়া মুখের কথা? তাই বেলাবেলি প্রস্তুতি শুরু। ছোটবেলা থেকে ধরিয়ে দেওয়া খেলনা বাটি, রান্নাবাটি, পুতুল খেলার মধ্য দিয়ে মেয়েকে বড় বেলার জন্য তৈরি করো। ছেলেদের হাতে দাও বন্দুক, গাড়ি, ব্যাট, বল, মারামারি করতে উৎসাহ দাও। ছেলেকে শেখাও পুরুষ মাত্রই বেপরোয়া, বহির্মুখি, গায়ের জোরে ছিনিয়ে নাও যা চাও। আর মেয়েকে বলো নম্র হও, চেঁচিয়ো না, পা জড়ো করে বসো, দৌঁড়াবে না, মেয়েমানুষের এত তেজ থাকতে নেই। ঠিক এইভাবে দু’দল মানুষ তৈরি করো। যার একদল জন্ম থেকেই অন্য দলের দাসী হতে, বরকে ‘স্বামী’ বা প্রভু মানতে তৎপর। বিবাহ এবং পতির প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য নারী জীবনের প্রাথমিক লক্ষ্য। পরবর্তী লক্ষ্য অবশ্যই পুত্রসন্তানের জন্মদান এবং লালনপালন।
অনেকের মনে হতেই পারে, এসব সেকেলে ঘটনা। মেয়েরা মহাকাশ যাচ্ছে, বিড়ি সিগারেট খাচ্ছে, ডিভোর্স করছে, মা হচ্ছে না, গোল্লায় যাচ্ছে। আর উনি এসেছেন গাঁজাখুরি গল্প শোনাতে। আসলে কিছু বদলায়নি। আপনার শখের বিনোদনে বোকা বাক্সের বোম নিষ্ক্রিয়কারী জবা যদি বাড়ি ফিরে ‘বড়’র জন্য চা না করে দেন, তার সোনা মেয়ে নাম ঘুচবে। এই একবিংশ শতাব্দীতেও ‘মাস্টার ফার্স্ট ক্লাস’ পাওয়া মেয়েটির বিয়ে আটকে থাকে তার গায়ের রঙের জন্য। আজও বাচ্চার ভবিষ্যতের কথা ভেবে মা’কেই চাকরি ছাড়ার কথা বিবেচনা করতে বলা হয়। কারণ আমরা প্রগতিশীল, আমরা আধুনিক। ছেলে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরলে কিছু বলি না। বৌমাকে এমনকি জিন্স পরতেও আমরা ‘অ্যালাউ’ করেছি। তাই বিবেচনা করতে বলি। কারণ, আমরা মনে মনে বিশ্বাস করি বাড়ির বৌয়ের জায়গা রান্নাঘর, বাড়ির ভিতরে। আধুনিকতার ঠেলায় নাইটি, হাতা ছাড়া ব্লাউজের আলিঙ্গনে তাই মুখ ফুটে বলতে পারি না। তবে সুযোগ পেলেই কাজেকর্মে দেখিয়ে দিই। আসলে তাঁর তত্ত্ব, ‘Prouduction Relation, means of Production’। নারী শরীর সন্তান তৈরির কারখানা, তাই তাকে কিছুতেই স্বতন্ত্র্য হতে দেওয়া যাবে না। সমাজে-পরিবারে সম্পর্কের নৈতিকতায় আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলতে হবে। বুঝিয়ে দিতে হবে তার মহতী কর্তব্য। কারোর কন্যা, কারোর স্ত্রী, কারোর মায়ের চেয়ে বেশি এগুতে দিলেই মুশকিল।
পরিবার ব্যবস্থা, জাতি ব্যবস্থা এবং এদের বড়দা সামন্ততান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নারী শরীরের ‘disempowerment’ নারী শ্রমকে লঘু করে দেখানো, সর্বোপরি নারীকে দ্বিতীয় স্তরের নাগরিক করে নিজের ভঙ্গুর অট্টালিকা কোনোমতে টিকিয়ে রেখেছে। তাই তারা এক বর্ণে বিয়ে, বিয়ের পর মহিলার পুরুষের বাড়িতে অধিগমন, ক্ষেত্রবিশেষে পদবি পরিবর্তনের মতো চুড়ান্ত পিতৃতান্ত্রিক সংস্থার মধ্যদিয়ে মহিলা সমাজের ‘সাবমিশন’ বা সমর্পণকে সুনিশ্চিত করেছেন। যা আজও বহুক্ষেত্রে খোল নলচে বদলে আমাদের সমাজে অটুট।
তবে একটু বদল এসেছে শিল্প, কলকারখানা এবং শহরের সাথে ইট আলগা হয়েছে। সামন্ততন্ত্রের অট্টালিকার পাশাপাশি তৈরি হয়েছে পুঁজিবাদের হাইরাইজ। এই ব্যবস্থা আপাতদৃষ্টিতে আধুনিক, এতে পরিবারের আড়ষ্টতা নেই। পরিবার ভাঙতে পারে, ছোট হতে পারে, একা হতে পারে। সমাজের বিশেষ দায়ভার নেই। নারীর স্বাতন্ত্র্য থাকার সুবিধা সুযোগও বেশি। তবে পুঁজিবাদের ফ্ল্যাটের দাম বেশি। সে ফ্ল্যাটে থাকতে গেলে সারাদিন অঙ্কের পিছনে দৌড়াতে হবে। টাকা, অনেক টাকা লাগবে। মেধা, শিক্ষা, শ্রম— সব উজার করে দাও। তাতেও কুলাচ্ছে না? উপায় আছে। আমরা প্রগতিশীল, মহিলারা ঘরে বসে থাকবে কেন? তারা চাকরি করুক। পুরুষের চেয়ে এদের কম মজুরি, তাতে কি? তোমায় চাকরির ‘‘স্বাধীনতা’’ দিলাম আমি।
কর্মক্ষেত্রে হেনস্তা, যৌন, শারীরিক, মানসিক। মুখ খোলার উপায় নেই। তাতে কি? তুমি পুরুষের মতো পোশাক পরো, সিগারেট খাও, পানশালায় যাও। এসব করার ‘স্বাধীনতা’ তোমায় আমি দিয়েছি। তুমি কি একেবারে অকৃতজ্ঞ? তোমার শরীর আমার পণ্য। ফ্রিজ বেচতে তোমার মুখ, অ্যাকোয়াগার্ডের বিজ্ঞাপনে তোমার নিটোল গাল, জীবনবিমার ভরসা তোমার মুক্ত ঝরা হাসিতে, খোলা বুক, হাতে, পায়ে। তুমি তখনই আধুনিক, একমাত্র তখনই আধুনিক, যখন তোমার শরীর, চুল, নখ, দাঁত আমার বিজ্ঞাপনে, আমার ব্যবসায়ে লাভজনক পুঁজি। তোমার শরীর আমার লাভের উৎস, ‘means of production’ তাই তুমি কি পরবে, গায়ের রং, শরীরের আকার কি হবে, ঠিক করবে আমার বাজার। কোন পোশাক ‘ইন’ আর কোনটা ‘আউট’ তা আমরা ঠিক করব। আমাদের ব্র্যান্ড ঠিক করবে। তুমি এখন স্বাধীন, তুমি পছন্দ করতে পারো আমার ইংরেজি কোম্পানির গাউন নাকি আরবি কোম্পানির আবায়া, কোনটা পরবে তুমি। লভ্যাংশ আমার ঘরেই উঠবে যদিও, তবুও তোমার কাছে চয়েজ আছে।
‘‘অউর ম্যায় আপনি হাড্ডিও পে
লিখতা রহুঙ্গা ইয়ে সারে বরদাত’’
এই যখন আমাদের মতো ছাত্রছাত্রীরা বইয়ের পাতা উলটে, গবেষণাপত্র ঘেঁটে লড়াই, ঝগড়া বাধিয়ে দিচ্ছি নারীবাদ কী তা স্পষ্টভাবে জানতে, কোট করছি কলোন্তাইকে, তখন আমরা এই পোড়া ভারতবর্ষে ধোঁয়ায়, ধুলোয় ঢাকা দিল্লিতে কারা যেন কালো বোরখা পরে রঙিন কাচের চুড়িতে, মেহেন্দিতে, সবুজ, রানী-সাদা রঙের ওড়না উড়িয়ে রাস্তায় নামছে, তাদের কোলে বাচ্চা আছে। তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়েনি, পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ, ছাইপাস নারীবাদ কিচ্ছু জানে না। খালি জানে সরকার ওদের প্রাণে মারতে চায়, না পারলে ভাতে মারতে চায় আর ওরা বাঁচতে মরিয়া। ওরা সারারাত রাস্তায় বসে থাকে। শীতের রাতে মশাল জ্বেলে ওরা গান গায়, স্লোগান তোলে, বক্তৃতা দেয়। আর রাগে না। উসকানিতেও জ্বলে ওঠে না। ওরা ছোটবেলা থেকে শান্ত থাকতে, নম্র থাকতে শিখেছে। কিন্তু জীবনযুদ্ধে শিখেছে ওদের জন্য লড়ার কেউ নেই। এক হাতে বাচ্চা সামলে, শওহরের সেবা করে জরির কাজ করেছে ঘরে। তারা দশভূজা। প্রতিদিন আজন্ম দারিদ্র তাচ্ছিল্য সব সহ্য করে বেমালুম বেঁচে আছে। তাই ওরা ভয় পায় না।
পুলিশ আসে, ওরা হাতে হাত বেঁধে বসে থাকে। ওদের দেখে অবাক হই আমরা। এই আমরা, যারা তত্ত্ব জানি, বোরখা, ঘোমটা এসব নিয়ে লেকচার দিতে পারি ঘণ্টাদুয়েক, আমরা নেমে আসি ওদের পাশে। কাচের চুড়ি পরা হাতগুলোকে আষ্টেপৃষ্টে ধরি। বুকে চার মাসের আহানকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সালমার হাত ধরে পণ্ডিচেরির তীর্থা, ৬৮ বছরের আকবরির কাঁধে মাথা রাখে সারা জীবন একলা থাকার প্রতিজ্ঞা নেওয়া অনুপ্রিয়া, ওডিশার রক্সির খনি শ্রমিক মমতা মুণ্ডার হাসি মুখ আলিঙ্গন করে আন্দোলনের ভাঁড়ার সামলানো ফরিদা, এই মেয়েরা। মেহনতী ঘরের, নিপীড়িত ঘরের মেয়েরা, রাস্তায় নেমে স্লোগান দেওয়া মেয়েরা বেঁচে থাকার, বাঁচিয়ে রাখার এই লড়াইতে খুঁজে পায় সাথী। আপাতত ওরা বাঁচার জন্য লড়ছে, কাল একসাথে এরা দুনিয়া বদলাবে ঠিক। শ্রমজীবী মায়েরা, মেয়েরা একসাথে একলা বাচ্চা কোলে, ছোট চুলে, বড় চুলে, বোরখায়, শাড়িতে, প্যান্টে-শার্টে একদিন নিশ্চয়ই ভেঙে ফেলবে সুপ্রাচীন অট্টালিকা বা ফ্ল্যাটবাড়িগুলো। নিশ্চয়ই।
‘‘কে কুছ লোগ জিনকে ইরাদে টুটে নাহি থে
লোহে কি হাতোড়িও সে’’…
দীপ্সিতা ধর: সর্বভারতীয় যুগ্ম সম্পাদক, ভারতের ছাত্র ফেডারেশন; জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লী
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব মতামত]