গল্পটা আসলে ক্ষমতার
জাহাঙ্গীর আলম।। কর্মসূত্রে একটা ঘরে রোজ জড়ো হন কিছু মানুষ। তাদের মধ্যে দশজন হিন্দু, দুজন মুসলমান পুরুষ। আর চারজন মহিলা ও দুজন আদিবাসী। যদি কোনোদিন দুজন মুসলমান অনুপস্থিত থাকে, সেদিন বাকিদের মনের এবং মুখের আগল খুলে যায়। প্রাণভরে সেদিন তারা মুসলমান নামক ‘জাত’-টাকে তুলোধনা করে। তারা যে সকলেই জেহাদি, পাকিস্তানের সাপোর্টার, জন্মগত অপরাধী সে ব্যাপারে সকলেই সেদিন একমত হয়। ঘরে থাকা মহিলারাও সেই আলোচনায় সামিল হন এবং সব কটা মুসলমানকে যে ঘাড় ধরে দেশ থেকে বার করে দেওয়া উচিত, সে ব্যাপারে তাদের পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন।
মজার ব্যাপার হল, যেদিন কোনো কারণে ওই চারজন মহিলা অনুপস্থিত থাকেন, সেদিন কিন্তু হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমস্ত পুরুষের আক্রমণের লক্ষ্যে থাকেন ওই মহিলারা। সেদিন আবার সমবেত নিন্দা চলে মহিলাদের নিয়ে। তারা যে আসলেই ফাঁকিবাজ, কাজের জায়গায় এসেও তাদের যে মন পড়ে থাকে বাড়িতে এবং ম্যাটারনিটি লিভ, সিসিএল ইত্যাদি বহুবিধ ‘অন্যায় রকমের সুযোগ-সুবিধা’ যে তারা পেয়ে থাকেন, তা নিয়ে সেদিন প্রকাশ্যেই তীব্র অসন্তোষ ব্যক্ত করা হয়।
তাই বলছিলাম, গল্পটা আসলে ক্ষমতার। পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার বলয়ে প্রথম যে মেয়েটি পৃথিবী প্রদক্ষিণের জন্যে পথে বেরিয়েছিলেন, তাকে যেতে হয়েছিল পুরুষের বেশে। তিনি ছিলের ফরাসী রাজা ফিলিবার্টের স্ত্রী জঁ ব্যারে।
তার দুই’শ বছর পরে নিউজিল্যান্ডের মেয়ে নাওমি জেমস এর কথা মনে আছে? কতটা দুঃসাহসিক স্বাধীনচেতা মেয়ে ছিল জানেন?
নাওমি জেম্স, ছোটবেলা থেকে তার একটিই মাত্র শখ ছিল, স্বপ্ন দেখা। ঘুমিয়ে না, জেগে জেগেই। কাজকর্ম ফেলে বসে বসে আকাশকুসুম কল্পনা করতে যে কি সুখ!
বড় হয়ে নাওমির জুটল হেয়ার ড্রেসারের কাজ। কিছুকাল পর নাওমি বুঝলেন, কাজ তার দিবাস্বপ্নে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। কিন্তু দিবাস্বপ্নের সঙ্গে যেহেতু কিছুতেই আপোষ করা যায় না, ফলে কাজ ছেড়ে দিয়ে তিনি পাড়ি দিলেন সুদূর ইউরোপে।
সেখানে গিয়ে কী করবেন? নাওমির জবাব ছিল, কিছু যদি ‘করব’ই তা হলে তো নিউজিল্যান্ডেই করতে পারতাম, কিছু না-করার সম্ভাব্যতাকে এই পৃথিবী স্বীকার করে কি না, তার উত্তর খুঁজতেই বেরোচ্ছি, খুঁজে না পেলে ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে আসব!
এরকম উত্তর দিতে পারে যে মেয়ে, আমি এমনিতেই ধপাস করে তার প্রেমে পড়ে যাই, কিন্তু সেই ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ থাক, নাওমির বাকি গল্পটা শুনুন।
ইউরোপে গিয়ে রব জেম্স নামে এক ছেলের সঙ্গে ভাবসাব হল নাওমির। রব এক ধনী মানুষের নৌকা ও ইয়ট দেখাশোনা করে। নাওমি বলল, আমাকে ইয়ট চালানো শেখাবে?
তার বছরখানেক বাদে ওদের বিয়ে হল। এবার ঘরকন্না, বাচ্চাকাচ্চা। বিয়ের পরদিন নাওমি রবকে বলল, আমার একটা আবদার আছে। একটা ইয়ট নিয়ে আমি বেরোবো পৃথিবী প্রদক্ষিণে, সম্পূর্ণ একা। তুমিও যাবে না আমার সঙ্গে। রাজি? রব মানুষটি ততদিনে নাওমিকে ভালোই চিনেছে। রাজি না হয়ে উপায় আছে! নাওমির আরও আবদার, সবচেয়ে বিপদসঙ্কুল যে রুট, তা তুমি বেছে বেছে ঠিক কর। যে পথে আগে কেউ যায়নি। কেন না, স্বপ্ন দেখার সঙ্গে কোনো আপোষ করা যায় না!
মাত্র ছ’সপ্তাহ ইয়ট চালানোর অপ্রতুল অভিজ্ঞতা সম্বল করে, ১৯৭৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর, একটি মেয়ে বেরিয়ে পড়ল পৃথিবীর পথে। এই রোমাঞ্চকর জার্নি একটা ভিন্ন গল্পের বিষয় হতে পারে। আমার আপাতত মনে করতে ভালো লাগছে নাওমির আত্মজীবনের শেষ অংশটুকু।
নাওমি লিখেছিল, জীবন যখন বেশ স্থিরতার দিকে এগোচ্ছে, তখনই মনে হল পূর্ণতার সন্ধান যে আজও বাকি রয়ে গেল। তাই বেরিয়ে পড়লাম জন্মান্তরের দিকে। মুক্তির দিকে।
তাই বলছিলাম কি, স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করতে হলে ক্ষমতার পাঁচিলকে না ভাঙ্গতে পারলে সেই পাঁচিল টপকেই ঢুকতে হয়। তবেই নারী দিবস পালন সেদিনই যথার্থ সার্থকতা পাবে, তার আগে নয়।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব মতামত]