November 2, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

ডিসকাউন্টের নারীদিবস নারীমুক্তি আনবে কি?

প্রমা অর্চি।। যেকোনো দিবস যথাসম্ভব ভাবমর্যাদায় পালন করার এই নতুন রেওয়াজ বা সংস্কার আমার বেশ ভালোই লাগে। ফলে “দিবস” পালনের আড়ালে “দিবসের” তাৎপর্য কতটুকু অর্থবহ হলো সেটা সবসময় আমার মাথায় তেমন গেঁথে থাকে না।

ষোল কোটি মানুষের এই দেশে কোনো একটা “দিবস” যে গুরুত্বসহকারে পালিত হচ্ছে এবং একদিনের জন্য হলে সেই দিবসটার যে এদেশের মানুষের কাছে তাৎপর্য আছে তাই ভেবেই আমি বিশেষ আহ্লাদিত হই।

এবার নারীদিবসে বেশ কৌতুহল উদ্দীপক বিজ্ঞাপনে যাবতীয় প্রিন্ট ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও অনলাইন সয়লাব হয়ে গেল। নারী দিবসে পালা করে বিভিন্ন বিপণনের অফার, ডিসকাউন্ট, উপহারের পসরা সাজিয়ে মোটামুটি ভাবে সবাই বসে গিয়েছে। সেই অর্থে খুশি হওয়া স্বাভাবিক ছিল এই ভেবে যে, আসলেই নারী দিবসের কোনো একটা সংজ্ঞাবহ অর্থ হয়তো এই দেশে তৈরি হচ্ছে। কিন্তু প্যারাডক্সিক্যালভাবেই বেশ শংকা অনুভব হতে লাগল, কারন যেই পুজিঁবাদী ব্যবস্থা নারীদিবসকে “শপিং” এ ৮% ডিসকাউন্ট আর নারীদিবসে কেনাকাটা করলে “অমুকের” সাথে “তমুক” ফ্রি, সেই সমাজ নারীদিবসের তাৎপর্য কতটুকু আদতে উপলব্ধি করে তা নিয়ে আমি সন্দিহান।

নারীদিবসের ইতিহাস এবং পরম্পরা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে ভিন্ন। ফলে পাশ্চাত্য যেভাবে নারীবাদকে দেখে সেই চর্চা প্রাচ্যে করলে তা অনেকাংশেই তথাকথিত সমাজ পরিপন্থী চর্চা বলে গ্রাহ্য হবে। কারণ প্রাচ্যের সমাজ এখনো অনেক ক্ষেত্রেই সুতীব্র পৌরুষিক বিধিনিষেধ দ্বারা আবদ্ধ।  অনধিকার চর্চা করাকে আমরা স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক অধিকার বলে মনে করি। ফলে পাশ্চাত্যের নারীবাদ চর্চার প্রায়োগিক ক্ষেত্র এই দেশে তৈরি হওয়াও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

দেশে নারী দিবস চর্চার প্রায়োগিক ক্ষেত্র যদি হালের ডিসকাউন্ট আর অফার হয়, পাশাপাশি ফেসবুকের গার্লস গ্রুপের লাইভ হয়, তবে দীর্ঘশ্বাস না ফেলার কারণ দেখিনা। নারীবাদের স্বতন্ত্রচর্চা এই দেশে এক অর্থে জোরালো না, অধিকার আন্দোলন ও অন্যান্য বিষয়ে সচেতনতা যখন পুজিঁবাদের প্রলোভনের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়, তখন আসলেই এই দিবসের “তাৎপর্য” নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

প্রকৃত নারীদের সংগ্রাম এবং অধিকার আদায়ের বিষয়গুলো অনেকেই শৈল্পিকভাবে তুলে ধরেছেন এই দিবসে, কিন্তু নারীবাদের আসল কনসেপ্ট এই দেশে প্রোথিত হওয়ার অনেক বাকি। সফল নারীদের হাজারো গল্পে অনলাইন – অফলাইন রমরমা কিন্তু নারীবাদের আসল প্রয়োগক্ষেত্র আসলেই আমাদের দুর্বলতাগুলো চোখে পড়ে।

কর্মক্ষেত্রে সেক্সিস্ট আচরনের শিকার হয়নি- এমন নারী সম্ভবত খুব খুব দুর্লভ। চিকিৎসক হবার পরপরই একদিন শংকাভরে কোনো এক পুরুষ কলিগকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘‘আমার একটা কাগজে সিনিয়র একজনের সাইন লাগবে, উনি কি করবেন?” উনি যথেষ্ট ব্যঙ্গাত্নকভাবেই আমাকে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘হ্যা,যাও, যাও,তোমার রূপ দেখালেই তো অটো সাইন হয়ে যাওয়ার কথা, কিছু বলাও লাগবে না ’’

সেদিন দাতঁভাংগা উত্তরের পর পারতপক্ষে উনি আর পরে আমাকে ঘাটাননি।

এই নারীদিবসে একটা গল্প টানা প্রাসংগিক হয়েই গেল। শরীর খারাপ নিয়েও হাসপাতালে ডিউটি করতে গিয়েছি।কোনো এক মৃত্যুপত্রযাত্রী রোগী কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে (হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া) চলে গেল। আমি প্রাণপণে রোগীকে কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন(CPR) (অর্থ্যাৎ বুকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে হার্ট সচল রাখা) করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এমন সময় এক সিনিয়ার স্টাফ নার্স (আমার মাতৃবয়সী) আমার প্রয়াস দেখে বললেন, ‘মাইয়া ডাক্তারের সিপিআরে জোর কম থাকে, পুরুষের সিপিআর এ ভালো কাম হয়।’

আমি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকলেও উত্তর দেইনি।

পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার বীজ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যেই দেশের মানুষের মাথায় প্রোথিত হয়ে আছে এবং শুধু তাতেই ক্ষান্ত হয়নি, বিশাল বটবৃক্ষ হয়ে বিশাল ঝুড়ি নামিয়ে দিয়েছে, সেই দেশে ‘ডিসকাউন্টের নারী দিবস’ সত্যিই নারীমুক্তি আনবে কি?

 

প্রমা অর্চি: শিক্ষানবিশ চিকিৎসক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব মতামত]