সব সম্পর্কই রাজনৈতিক
ক্যামেলিয়া আলম।। ‘সব সম্পর্কই রাজনৈতিক’। কথাটা আমরা যতটা বলি, ততটা আমাদের বোধগম্যতায় আসে কিনা সন্দেহ আছে। পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি বা ভাবধারায় বিষয়টি রাষ্ট্র পর্যন্ত স্বীকৃতি জানায়। সেই সব দেশের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সরকার বাচ্চার এক নির্দিষ্ট বয়সের খরচ থেকে শুরু করে শুধু প্রবীণদেরই না, বেকারদেরও এক ধরণের আর্থিক সহায়তা দেয়। সেই সব দেশে আঠারো বছর বয়স হলেই সন্তানকে নিজের পায়ে দাঁড়াবার যুদ্ধে একাই নামতে হয়। পরিবারের বা সমাজের ভার হয়ে বাঁচবার চাইতে বিরতিহীন দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হয়।
একবার এক জার্মান মেয়ের সাথে আমার কথা হচ্ছিল যার বয়স তখন ছিলো ২৭/২৮, যে ৯ বছর তার মা’কে দেখার সময় পান নাই! আমি বিস্ময় প্রকাশ করাতে সে পাল্টা আমায় বললো, ক্যামেলিয়া তুমি এজন্যই ৪০ এ নিজ দেশের বাইরে তোমার ক্যারিয়ার তেমনভাবে গড়তে পারো নাই। আর আমি তোমার ছোট হয়ে তোমার দেশে এসেছি কাজ করতে!
বিষয়টি ভালো মন্দের ব্যাপার না আসলে। ব্যাপারটাই সংস্কৃতি। ফরাসি দেশে রাষ্ট্র থেকে বাবা মাকে দেখাশোনা করলে বা তার লন্ড্রি অন্তত করে দিয়ে এলে সেই সন্তানের জন্য এক নির্দিষ্ট অর্থ বরাদ্দ থাকে।
ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি কেন তা এবার খুলে বলি। আমরা এদেশে নারীবাদী তত্ত্ব যখন প্রচার করি, তখন আমরা তা করি মূলত পশ্চিমা বিশ্বের নারীবাদী তত্ত্বের আলোকে। হ্যাঁ, বৈষম্যের কিছু বেইজ লাইন প্রায় একই থাকে কোন কোন বিষয়ে। কিন্তু তবু আমাদের পরিবর্তন যদি আমরা কেবলই পশ্চিমা ধারায় করতে যাই, তা কতটা সফল হবে এই সংস্কৃতিতে?
এখন এখানে আরেক মৌলিক প্রশ্ন। নারী পুরুষের বৈষম্য যখন প্রকট হয়ে পড়ছে তাতে আমাদের করণীয় কী?
পথ অবশ্যই বের করতে হবে। সেটা সন্ধানের চেষ্টাই এখন করি। যেমন একটা কমন ফেনোমেনা আছে আমাদের সমাজে যা আমাকেও ক্ষুব্ধ করেছিলো বিয়ের পরে পরেই। দেখতাম যে, বিয়ের পর আমার বর আমাদের বাসায় রীতিমতো ভিআইপি ট্রিটমেন্ট পাচ্ছে, অন্যদিকে বিয়ের তিনদিনের মাথাতেই শ্বশুড়বাড়িতে আমাকে তাদের ছেলের জন্য ভালো ভালো মাংস সরিয়ে রেখে খাওয়ার এক প্রচ্ছন্ন উপদেশ দিচ্ছে।
ভীষণ অপমানিত বোধ করতাম। আমরা খুব ছোট পরিবারে মানুষ, আমার মা আজীবন আমাদের দুই বোনকে মুরগির রান খাইয়ে বড় করেছে। সিনার মাংসখানা আমার গলায় নামতে চাইতো না। আর অভিমানের বুদবুদ তো উঠতই। মামুলি একটা বিষয় বা কতগুলো বিষয় আমার মনকে ক্লান্ত করতে করতে বিষিয়ে দিচ্ছিল।
আমি সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছিলাম কিন্তু সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ বের করতে পারতাম না। কারণ সমস্যার সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক দিকটিই আমি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। যা এই বয়সে এসে এখন বোধগম্যতায় এলো। আমাদের সামাজিক পরিকাঠামোয় একজন নারী বিয়ের পরেই স্বামীর ঘরে আসবে। ফলে তার আসবার বিষয়টি মূলত একজন হোস্ট হিসেবে আর পাত্র নিয়ে যাচ্ছে তার কন্যাকে, ফলে কন্যাপক্ষের বাড়িতে তার স্থায়ী অবস্থান না হওয়ার কারণে সে আজীবনই গেস্ট। আর ঠিক এই কাঠামোর মনস্তত্ত্ব এতোটাই শক্তিশালী যে, কোন ছেলে যখন ঘরজামাইও থাকে তবুও অবচেতনে তাকে গেস্ট হিসেবেই পাত্রীপক্ষের মস্তিষ্ক গেঁথে রাখে। মানসিক বিষয় আসলে জগতের সমস্ত শক্তির মূল কেন্দ্রবিন্দু।
আইনস্টাইনীয় এক গল্প প্রচলিত আছে না যে আগুনের কাছে ৫ মিনিটকেও ৫ ঘন্টার মতো লাগে আর কোন সুন্দরী নারীর কাছে কয়েক ঘন্টাকেও ৫ মিনিটের মতো মনে হয়। এর মানে, ঘটমান বিষয়ের সাথে ঘটনা যতটা না জড়িত থাকে তার চাইতেও জড়িত থাকে আমাদের মানসিক কাঠামো। এই মানসিকতা পরিবর্তনের রীতি কী হতে পারে তা মূলত আমাদের বোঝবার বিষয়।
আমাদের জীবনযাত্রায় এখন আধুনিকতার ছাপ পড়েছে স্পষ্টই উপরিকাঠামোতে। আমরা আধুনিক সজ্জায় সজ্জিত হচ্ছি, নানা আক্রমণ দিয়ে পুরুষতন্ত্রকে ঘায়েল করবার চেষ্টা করছি। কিন্তু তা পুরুষতন্ত্রের মূল কাঠামোকে নাড়াতে কি পারছে বা পারবে? যদি পারতোই তবে ওয়াজে আড়াই লাখ লোক, আর অন্যদিকে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে বিশ ত্রিশজনকে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়াতে হতো না।
এখন এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে?
আমি, আপনি সবাই। কারণ আমাদের মাঝে নগরায়ণের সুফলতা ভোগের নেশা যতটা না আছে, ততটা নিজের অবস্থান পরিবর্তনের চেষ্টা নাই। আর এই যে অবস্থান পরিবর্তনের চেষ্টা, তা কী করে আসবে? ক্ষমতায়ণ এমন এক শব্দ যা একই সাথে অংশগ্রহণ, নিয়ন্ত্রণ, সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত হওয়াকে বোঝায়। এই বিংশ শতক অবধি হাটবাজার ব্যবস্থাপণা থেকে সরকারি নীতি নির্ধারণের অভিভাবক হচ্ছে পুরুষ। হ্যাঁ, অবস্থা আগের চাইতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। চিতায় প্রজ্জ্বলিত হওয়ার সামাজিক বন্ধনী থেকে প্রশাসনের চিফ হিসেবে নারীকে দেখবার চোখ আমাদের তৈরি হয়েছে। তবে সংখ্যাটা এখনও কিন্তু নাজুক। অর্থনীতির প্রান্তিক অবস্থান থেকে নারীর অবস্থান মূল অর্থনীতির একটা গ্রেড পর্যন্ত এসেছে। দেখা যায়, শ্রমিক হিসেবে, অধঃস্তন চাকুরিজীবী হিসেবে বা মাঠ পর্যায়ে তারা সংখ্যায় যত ভারি, ঠিক ততটাই সংখ্যালঘু নীতি নির্ধারক হিসেবে। প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদ হচ্ছে জেলা প্রশাসক (ডিসি)। যিনি জেলার সর্বেসর্বা। দেশের ৬৪ জেলার মাঝে বর্তমানে ৯ জেলায় ডিসির দায়িত্ব পালন করছেন নারী। এখানে আশাপ্রদ একটা কথা হল মাঠ পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ডিসিরা জানিয়েছেন যে, এত রক্ষণশীল, সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত এক দেশে কাজের ক্ষেত্রে তারা নারী হিসেবে কখনও প্রতিবন্ধকতা পান নি। রাত ১২ টা পর্যন্ত সাবলীলভাবে কাজ করার কথাও কারও কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে। যদিও তা সমগ্র বাংলাদেশের চিত্র না। কিন্তু একটু খোঁজ নিলে জানা যায় যে, এই যে নারী ডিসি সম্বলিত ৯টি জেলা অন্যান্য জেলার চাইতে আইন শৃ্খংলায় যথেষ্ট অগ্রগামী। এর পেছনে একটাই যুক্তি তা হলো রাজনৈতিক ক্ষমতা। কাজেই কেবল অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা নয়, একজন নারীর পুরনো কাঠামোকে পরিবর্তন করতে হলে চাই তার রাজনৈতিক অবস্থানে শক্তিশালী হওয়া। আর তা অসম্ভব জরুরি এখন।
রাজনৈতিক অবস্থান মানে সংরক্ষিত আসনে তার একটা অবস্থান চিহ্নিত হওয়া নয়। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করা। আর নিজেকে কেন্দ্রবিন্দুতে নিতে চাইলে অবশ্যই সেই মানসিক গঠন সবার আগে জরুরি। দেনমোহর বা কনে পণের সুবিধা ছেড়ে বাবার সম্পত্তিতে পূর্ণ অধিকার, সংরক্ষিত নারী আসন ছেড়ে রাজনৈতিক মূলধারায় কাজের জন্য নিজেকে তৈরি করা, বাসের সংরক্ষিত আসন ছেড়ে গায়ে ধাক্কা দেয়া পুরুষকে কষে থাপ্পড় মারার মানসিক প্রস্তুতি বড় বেশি প্রয়োজন এখন। একজন হোস্ট কখনও গেস্ট হবার অবস্থান তৈরি করতে পারে না। কার কাছে নিজের জন্য চাইবেন? যে সংসারে আপনি নিজে এক বাড়তি মুখ। বাহুল্য মুখের আদর কেন থাকবে?
মায়া মমতা মহানুভবতা পাওয়ার মায়াকান্নার চাইতে নিজেকে প্রস্তুত করা বড় বেশি প্রয়োজন। আর আরেকটা কথা, একজন পুরুষতান্ত্রিক নারী একজন পুরুষের চাইতেও ভয়ংকরভাবে নারীর জীবন পিছিয়ে দেয়। এরা স্বামী, সন্তান বা প্রেমিকের যত্ন নেয়াকে গুলিয়ে ফেলে দাসত্বের সাথে। সমাজের মাঝে তৈরি হয় প্রভু-ভৃত্যের মানসিকতা। এইসব নারীরাই আধিপত্যবাদী পুরুষের থেকে পাওয়া অমানবিক আচরণের শোধ তোলে আরেক দুর্বল নারীর উপর বা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে কোন সবল নারীর উপর। যেখানে নিজেরাই নিজের ভাগ্যের জন্য দায়ী।
দয়া করে সকল নারী আগে নারীবাদকে সমর্থন জানান। পুরুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করার মধ্যে মহত্ত্বের কিছু নেই। মনে রাখবেন, ‘সব সম্পর্কই রাজনৈতিক’।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের কলামে প্রকাশিত লেখা লেখকের নিজস্ব মতামত]