‘না মানে না’: আমাদের চিন্তাজগতে তীব্র ধাক্কার নাম গিল্টি
রাজনীন ফারজানা।। মেয়েটার নাম নানকি। উচ্ছল, উদ্দাম, চোখ ধাঁধানো রূপসী। যেমন ইচ্ছে তেমন পোশাক সে পরে, যা ইচ্ছে তাই করে। স্মোক, জয়েন্ট, মাদক, নেশা কোনকিছু থেমে নাই। সারা গায়ে, হাতে, আঙুলে অসংখ্য ট্যাটু। বুকের ভাঁজে ট্যাটুতে লেখা, ‘একলা চলো রে’। কপালে পিয়ার্সিং করা। তাতে ঢোকানো একটা সেফটিপিন।
বর্ণনা শুনে নাক কুচকাচ্ছেন? তাহলে আরও শুনুন। নানকির বয়ফ্রেন্ড কলেজ হার্টথ্রব বিজয় প্রতাপ একেএ ভিজে। গার্লফ্রেন্ডকে ঘাড়ে করে ক্লাসরুমে ঢোকে সে। সবার সামনে মেক আউট করে তারা।
ছিঃ বলে মুখ বাঁকাচ্ছেন? নানকিকে জাজ করছেন? করুন না। সেতো আমার আপনার মতো নয়। আজ তার চুল লাল তো কাল সাদা৷ এমন মেয়ের সম্পর্কে আর কিইবা ভাববেন আপনি?
একই ব্যান্ডের সদস্য ওরা। নানকি গান লেখে, ভিজে গান গায়। দিল্লির নামী কলেজ সেইন্ট মার্টিনের অর্ধেক মেয়ে যদি ভিজেকে চায় তো অর্ধেক ছেলে চায় নানকিকে। আর দশটা টিনেজারের মতো ওরাও নিজেদের খ্যাতি উপভোগ করে। কিন্তু হঠাৎ করে নানকি আর ওর বন্ধুদের দুনিয়া আপসাইড ডাউন হয়ে যায় যখন কলেজের তানু নামের এক মেয়ে ভিজের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ ক’রে টুইট করে। অভিযোগ করে হ্যাশট্যাগ মিটু আন্দোলনে সামিল হয়ে৷ আমরা নানকিকে দেখি সে তার বয়ফ্রেন্ড ভিজেকে রক্ষার জন্য সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করছে। সে এবং তাদের ব্যান্ডের সদস্যরা বলতে থাকে তানু ‘ফেইম সিকার’ এবং ‘এটেনশন সিকার।’
আমরা দেখি কীভাবে তানু শুরু থেকেই ভিজের সঙ্গে খুল্লামখুল্লা ফ্লার্ট করে, গায়ে পড়ে, সিডিউস করে। আমাদের জাজমেন্টাল মন অসম্ভব বিরক্তিতে ভরে ওঠে তানুর প্রতি। নানকির মত আগুনের শিখার মত গার্লফ্রেন্ড যার, সেই ভিজেকে নিজের দিকে আকর্ষণের এত নোংরা চেষ্টা কেন? ধানবাদ থেকে আসা হিন্দি মিডিয়ামে পড়ুয়া, ইচ্ছাকৃতভাবে ছোট আর খোলামেলা কাপড় পরা তানুর মত মেয়েদের কি কোন আত্মসম্মান থাকে? নানকির ওকে অপছন্দ করাই উচিৎ। নিতান্ত মার্কসের জোরে এমন নামি কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। তার আবার কলেজ হার্টথ্রবের দিকে নজর দেওয়া কেন?
ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র কনসার্টে তানু নানকির সামনেই মদ খেয়ে ঢলে ঢলে পড়ে ভিজের গায়ে। টাইট মিনি স্কার্ট আর মশারির মত পাতলা টপসের নীচে সাদা অন্তর্বাস পরে ভিজের মুখের কাছে বুক নিয়ে যায় বারবার। আর সেই মেয়ে কি-না রেইপের অভিযোগ করে! টুইট করে বলে সে রাতে ভিজে তাকে রেপ করেছে!
ভিজে নানকিসহ সবাইকে কনভিন্স করে ফেলে যে তানুর সাথে সে রাতে ঘটনাটি ছিল কনসেনসুয়াল অর্থাৎ সম্মতিসূচক শারীরিক মিলন। নানকি ক্ষমা করে দেয় ভিজেকে। কারণ সে নিজের চোখেই দেখেছে তানু কীভাবে প্রতিটা মুহুর্তে ভিজেকে নিজের জালে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছে, কীভাবে সেদিন তার সামনেই গায়ে ঢলে ঢলে পড়েছে। তানু তো নিজ থেকেই ভিজের সঙ্গে শোয়ার জন্য বয়েজ হোস্টেলে তার রুমে গিয়েছে। সঙ্গে ভিজের আরও দুই বন্ধুও ছিল। তারা বলছে যে দুজনের সম্মতিক্রমে যৌনমিলন ছিল সেটা। দুজনকে ঘনিষ্ঠ হতে দেখে রুম থেকে চলে আসে তারা।
এদিকে বিজয়ের বাবা ক্ষমতাসীন দলের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ। রয়েছে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা। নানকি নিজে কনভিন্সড যে তানু ভিজের কাছ থেকে টাকা খাওয়ার জন্যই মিথ্যা মিটুর অভিযোগ এনেছে। ভিজের বাবা শহরের সবচেয়ে বড় ল ফার্ম ভাড়া করেছে তানুর বিরুদ্ধে ডিফেমেশন কেইস করতে। সেখানকার এক তরুণ ব্যারিস্টার নানকি, ভিজেসহ তার সব বন্ধুদের বক্তব্য শুনছে। তাদের জবানিতেই আমরা ঘটনা দেখি। জাজ করতে থাকি ফেইমসিকার তানুকে।
কিন্তু তানু টুইট করে হ্যাশট্যাগ ‘নো মিনস নো’। আমরা বুঝতে চেষ্টা করি, তবে কি সেদিন শেষ মুহুর্তে সে ভিজের সঙ্গে যৌনতা চায়নি? ভিজে বলছে সম্মতিসূচক শারীরিক মিলন আর তানু বলছে ধর্ষণ। নানকির অন্ধ সমর্থন তার বয়ফ্রেন্ডের প্রতি। আবার সে সন্দেহও করে। হ্যালুসিনেশন হয় মাঝেমধ্যে। কখনো সে তানুর পায়ে রক্ত দেখে। কিন্তু আমরা জানতে পারি সেদিন তানু রক্তাক্ত হয়নি। আমরা বুঝতে পারি নানকির কোন একটা মানসিক সমস্যা আছে। তার লোকাল গার্ডিয়ান কলেজ কাউন্সিলর বলে নানকির ওভার থিংক করার সমস্যা আছে। এমনকি সে অতিরিক্ত কল্পনাপ্রবণ। নানকিকেও তিনি কনভিন্স করেন যে সে অতিরিক্ত মেধাবী তাই এমন সব দৃশ্য দেখে যার বাস্তব অস্তিত্ব নাই। একারণেই সে ভালো গান লেখে। প্রফেসর তাকে বলেন, একটা ছেলের জন্য জীবন নষ্ট না করে রোডস স্কলারশিপের জন্য প্রস্তুতি নিতে। তাদের কথাতেই বোঝা যায়, নানকির ক্ষেত্রে ফ্যামিলি শব্দটা ট্রিগার ওয়ার্ড হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ এই শব্দ শুনলে তার মন উল্টোপাল্টা আচরণ করে।
এক পর্যায়ে নানকি তার মনের মধ্যে চলা বাস্তবতা – পরাবাস্তবতার দ্বন্দ্ব ভুলে নিশ্চিত হয় তানু ধর্ষণের শিকার। ভিজে তাকে সেদিন ধর্ষণ করে। কিন্তু তানু রক্তাক্ত হয়নি। তাহলে কার উরুতে রক্ত ছিলো? নানকি কেন পরিবারের কথা কানেও নিতে চায় না?
আমরা তখন তানুর মুখে শুনি, জোরালো কণ্ঠে শুনি, ‘না মানে না।’ সে ভিজেকে বয়ফ্রেন্ড বানাতে চাইত। সেদিন ভিজের সঙ্গে শোয়ার জন্যই তার রুমে গিয়েছিল। কিন্তু সে চায়নি ভিজে’র বন্ধুদের সামনে সেটা ঘটুক। কোন সুস্থ মাথার মানুষই সেটা চাইবে না। এক সময় তানু তাই ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছে। কিন্তু ভিজের পৌরুষে আঘাত লাগে। সে জোর করতে থাকে। বল প্রয়োগ করে তানুর ওপর। এক পর্যায়ে ভিজেকে চড় মারে তানু। পুরুষের ইগো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ভিজে এ সময় জোর করে যৌন মিলন করে তানুর সঙ্গে। মানে ধর্ষণ করে। সেই ধর্ষণ দৃশ্য মুঠোফোনে ধারণ করে আরেক বন্ধু।
সেই থেকে তানুর লড়াই শুরু। সবাই তানুকে সুযোগসন্ধানী বলেছে কিন্তু সে থেমে যায়নি। কে তাকে নিয়ে কী বলবে সেটা না ভেবেই হ্যাশট্যাগ মিটু আন্দোলনে সামিল হয়েছে। চেয়েছে ন্যায়বিচার।
এরপর আমরা জানতে পারি নানকির জীবনের গল্প। রক্ত রহস্যের অবসান ঘটে শেষবেলায়। তেরো বছরের নানকি যখন ধর্ষণের শিকার হয়েছিল, তখন তাকে বলা হয়েছিল, সে মেয়ে তাই ধর্ষণের শিকার হয়েছে। সে বেশি যৌনাবেদনময়ী তাই তাকে রেপড হতে হয়েছিল। তেরো বছরের মেয়ের যৌনাবেদন! তাকে সেই থেকে শেখানো হয়েছে এই সমাজ ছেলেদের। ভিজেরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। আর নানকিদের রক্তাক্ত হয়েও সব ভুলে যেতে হবে। সামাজিক নিয়ম ভেবে মেনে নিতে হবে পুরুষের সব অন্যায় আচরণ। নিজের রক্তাক্ত স্মৃতিকে নিজের মনেরই কোন অস্বাভাবিকতা ভাবতে হবে।
এই হল গিল্টির গল্প। এ সিনেমাটি আমাদের ভাবতে শেখায়। তীব্র এক নাড়া দেয়। ঝাঁকি দেয়অ ধাক্কা দেয়। আমাদের সহস্র বছরের চিন্তাধারা মানসিকতাকে জোরে আগাত করে। পোশাক দেখে নারীকে বিচার করা, পুরুষের ধর্ষণ ইচ্ছাকে ন্যায্য ভাবা, জোর করাকে সহী মনে করা, না বলার পরও জোর করে যৌনকর্মকে স্বাভাবিক ভাবা- এইসব আদিম চিন্তার মুখে জোরে লাথি কষাবে এই সিনেমা।
রাজনীন ফারজানা: সাংবাদিক