November 24, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

যে দানব আমার অনেকগুলো সুন্দর সময় নষ্ট করেছে

শেখ সিরাজুম মুনিরা নীরা।। ভর্তির সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করে যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী শাটল ট্রেনে করে বাড়ি ফিরছিলাম, তখন আমার মনে কেবল একটাই প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিল। আর সেটা হল, পিরিয়ডের সময় শরীরে তুলার বস্তা বেঁধে কেমনে এই শাটলে ওঠানামা করব! আর যদি কোনোদিন ষোলশহর স্টেশনে নামতে হয় তাহলে তো লাফ দিয়ে নামতে হবে, কারণ প্লাটফর্ম অনেক নিচে! হায় হায়, কেন ভর্তি হলাম!

আমার যখন পিরিয়ড বা মেনস্ট্রুয়েশন বা মাসিক শুরু হয় তখন কেবল নাইনে উঠেছি। ক্লাস শুরু হয়নি, এমন সময় একদিন শুরু হয়ে গেল বিভীষিকার জীবন।

সাইজে বড়সড় হলেও আমি বেশ বোকা প্রকৃতির ছিলাম, মানে একটু ছোটমানুষ টাইপ। তাই আম্মু যেমন কখনো বলেনি, বান্ধবীরাও এই সম্পর্কে কিছু বলে আমাকে বিব্রত করেনি। ফলে পিরিয়ড শুরু হওয়ার পর যখন বিষয়টা সম্পর্কে জানলাম, তখন আসলে প্রথম দফা মারা গিয়েছিলাম আমি। এই ভয়াবহ কষ্ট প্রতি মাসে সাতদিন করতে হবে এইটা ভেবে কতদিন যে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে কান্নাকাটি করেছি তার ঠিক নেই। এখনো মনে আছে, প্রথম প্রথম কয়েক দফা রাতে ঘুমাতাম না আমি। কতবার যে উঠে টয়লেটে যেতাম তার ঠিক নেই।

ক্লাস টেনের কোনো একটা পরীক্ষার সময় পিরিয়ড শুরু হলো। পুরো সাতদিন আমি বাসায় একবারের জন্য টেবিল চেয়ারে বসে পড়িনি। ওয়্যারড্রোবের ওপর বই রেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়তাম। কী যে ভয়াবহ সেসব দিন গেছে, এখন ভাবলেই শিউরে উঠি।

তখন তো স্যানিটারি ন্যাপকিনের এতো বাহার ছিল না, তার ওপর হেভি ফ্লো এর কারণে খুব ভয়ে থাকতাম। স্যানিটারি ন্যাপকিনের ওপর তুলা, টয়লেট টিস্যু কত কি যে ব্যবহার করতাম। অন্তত যেন বাইরে গিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে না হয় সেজন্য। আর বস্তা নিয়ে চলাফেরা করা যে কত কঠিন সেটা মেয়েরা ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। আমি আবার বিরাট স্বেচ্ছাসেবক ছিলাম। নানান রকম ভলান্টারি কাজ করতাম শিক্ষা জীবনে। তাই আমার জন্য ওই বস্তা বহন করে চলা ছিল মৃত্যু যন্ত্রণার মতো।

আমাদের সময় শেখানো হতো, পিরিয়ড চলছে এইটা কোনোভাবেই প্রকাশ করা যাবে না। বিষয়টা খুবই লজ্জার। অর্থাৎ এটা এমন এক কষ্ট যেটা কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না।

পিরিয়ড যে কোনো লজ্জার জিনিস না, বরং মানবজাতির বিকাশে এর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি সেটা বুঝতে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। হায়! আরও আগে বুঝলে আমার জীবন আরেকটু সহজ হতো।

পিরিয়ড নিয়ে কত জোকস যে আছে! ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই, একটা হাসির গল্পে স্যানেটারি ন্যাপকিনকে রূপক অর্থে পাউরুটি আর পিরিয়ডের রক্তকে জেলি হিসেবে বর্ণনা করা আছে। বোঝেন তাহলে!

একটা মেয়ে সেই কিশোরীকাল থেকেই আলাদা হয়ে যায়। মাসের সাতদিন এই কষ্ট নিয়ে, প্রবাহমান রক্তের ধারা নিয়ে অন্য সবার মতো সব কাজ করতে শেখে সে। তার বয়সী একটা ছেলের মতো একইভাবে স্কুলে যায়, কোচিংয়ে যায়, বাসে ওঠে, রিকশায় ওঠে, লাফ দিয়ে নালা পার হয়, বৃষ্টিতে ভেজে, রোদে পোড়ে, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে। মোটকথা সব করে, সব। অথচ তার শরীর দিয়ে বয়ে চলেছে রক্তের ধারা, সমাজ যে রক্তের নাম দিয়েছে নষ্ট আর অপবিত্র! এই নষ্ট রক্তস্রোত নিয়েই জীবনযাপন করতে হয়। কারণ, তাকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে।

পিরিয়ড হয়েছে বলে ক্লাস মিস দিলে পিছিয়ে পড়তে হবে দৌড় থেকে, পিরিয়ডের ব্যাথায় অফিস থেকে আগে বের হতে চাইলে কিংবা স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের দাবি করলে শুনতে হবে, ‘এই জন্য অফিসে মহিলা নিতে চাই না, যত্তসব ঝামেলা।’

অথচ এই পিরিয়ড কোনো মেয়ে শখ করে চেয়ে নেয়নি। মা হতে চায় কি চায় না সেইটা কেউ তার কাছে জানতে চায়নি, তার আগেই নিজ দায়িত্বে প্রকৃতি তাকে মা হওয়ার প্রক্রিয়ায় শামিল করেছে!

আগে শুনতাম কিছু ছেলে নাকি এতোই স্মার্ট যে তারা কোনো মেয়ের হাঁটা দেখলেই বুঝতে পারে যে তার পিরিয়ড চলছে কি না। আমার এক কাজিনই ছিল এমন স্মার্ট। তাই পিরিয়ড হলে পারতপক্ষে তার সামনে পড়তে চাইতাম না।

এই ২০২০ সালের কিশোরীদের কথা জানি না, তবে আমি যখন কিশোরী ছিলাম মানে সেই ১৯৯৭/৯৮ সালের বা তার আগের কিশোরীরা আসলেই এসবের মধ্যে দিয়ে গেছে। নিজেরা দোকান থেকে স্যানেটারি ন্যাপকিন কেনার কথা তো ভাবাই যেত না। রাস্তায় কোথাও সেনোরার প্যাকেট পড়ে থাকলেও লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিতাম। আবার আশপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করতাম, আমি যে প্যাকেটা দেখে ফেলেছি, সেইটা অন্য কেউ দেখলো কিনা!

কি অদ্ভুত না?

আমার পরিচিত কারও যখন মেয়ে বাচ্চা হয়, প্রথমেই আমার মনে হয়, আহারে বাচ্চাটাও মাসে সাতদিন ভয়াবহ কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাবে। এমন এক কষ্ট যেটা কাউকে বোঝানো যাবে না। এমনকি যেদিন আল্ট্রাসাউন্ড রুমে আমাকে জানানো হলো যে, আমার গর্ভে বেড়ে উঠছে একজন পুরুষ, তখন আমার এক সময় মনে হয়েছে, যাক বাবা, আমার বাচ্চাটা অন্তত পিরিয়ডের হাত থেকে বেঁচে গেল!

হু এটা ঠিক যে, সবার পিরিয়ডের অভিজ্ঞতা এক না। শরীর ভেদে এর প্রকাশ বিভিন্ন রকমের। তাই আমি শুধু আমার কথা জানি। আমি জানি সাতদিন তলপেটে তীব্র ব্যাথা, ঠিকমতো বসতে না পারা, নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘুম না হওয়া, বমি বমি ভাব হওয়া আর ক্লান্তির নাম পিরিয়ড। আমি জানি, প্রতিবার সাতদিন ধরে কেবল মরে যাওয়ার ইচ্ছা হওয়ার নাম পিরিয়ড। আমি জানি, নিয়ম করে দুই বেলা পেইন কিলার খাওয়ার নাম পিরিয়ড।

আমার পিরিয়ডের আগে এবং চলাকালে ভয়াবহ মুড সুইং হয়, অবশ্য আগে মুড সুইং তো বুঝতাম না। তখন শুধু জানতাম, পিরিয়ড চললে আমার মেজাজ খারাপ থাকে। রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে বন্ধু, সবার সাথে ক্রমাগত ঝগড়া হয়। মন এতোটাই খারাপ থাকত যে, মনে হতো মরে যাই। মরে গেলেই এই নারী শরীর থেকে মুক্তি।

এখন অবশ্য নিজের মুড সামলাতে শিখে নিয়েছি। আবার সেল্ফ প্যাম্পারিংও পারি, যেমন ওই সময় একটু পার্লারে যাওয়া, একটা ফেসিয়াল বা হট ওয়েল ম্যাসাজ কিংবা একা কোথাও বসে পছন্দের কিছু খাওয়া, পছন্দের কোনো বই পড়া কিংবা শখের কিছু কেনা, এই তো।

কিন্তু তবু, পিরিয়ড আমার কাছে এক বিভীষিকার নাম। এমন এক দানবের নাম, যে আমার কিশোরী আর তরুণীবেলার অনেকগুলো সুন্দর সময় নষ্ট করেছে। এমন অনেকগুলো দিন যার জন্য নষ্ট হয়েছে, যে দিনগুলোতে হয়তো আরেকটু ভালো কিছু, ক্রিয়েটিভ কিছু আমি করতে পারতাম।

 

শেখ সিরাজুম মুনিরা নীরা: সাংবাদিক

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব মত]