টিকলি
ফারজানা নীলা।। সকালে উঠতে এখন আর আলসেমি লাগে না তারানার। কিন্তু বিরক্ত লাগে। একেকটা দিন শুরু মানে একই রুটিনের শুরু। নাস্তা রেডি করো কোন মতে হাত মুখ ধুয়েই। চুলটা পর্যন্ত আঁচড়ানোর সময় পায় না। বাসি কাপড়ে, বাসি মাথায় চলে রুটি বেলার কাজ, ডিম ভাজি, নয় সেদ্ধ নয় চচ্চড়ি। বড়দার লাগে আদা চা, ছোড়দার লাগে ঘন দুধের চা। ভাবী ওঠে দেরি করে। মা অনেকক্ষণ পরে আসেন। বুয়ার কাজের তদারকি একটু দেখিয়ে দিয়ে হালকা লিকারের চা নিয়ে ছেলেদের সাথে বসেন। বসা মানে এই সংসারে কী লাগবে কী আনতে হবে, বৌমার বাড়িতে ঈদে কী কী জিনিশ পাঠাতে হবে এই সেই ইত্যাদি।
১০টা নাগাদ ভাইদের অফিসে যাওয়া শেষ হলে তারানা অবশেষে একটু সময় পায়। সাড়ে দশটায় বড়দার ছেলেকে স্কুলে দিয়ে আসার আগে একটা রুটি আর এক কাপ দুধ চা নিয়ে বসে সোফায়। শেষ করতেই ভাবী দিয়ে যায় তার ছেলেকে। যেতে যেতে পিছন দিয়ে ডেকে প্রায় বলে, ওর টিফিন দিয়েছো তো তারানা?
দিয়েছি ভাবী। আসি। মাকে টাটা দাও বাবু…
মুখে কোনোদিন বিরক্তি প্রকাশ পায় না তারানার। চোখে মুখে যে ক্লান্তি জমা হয় সে ক্লান্তি কেউ দেখতে পায় না। তারানার মনে হয় মাও এখন আর দেখতে পান না।
রিকশায় যেতে যেতে একটু আনমনে এদিক সেদিক তাকায়। দেখার মত কিছু নাই। ছোট থেকে এখানেই বড় হয়েছে। স্কুল কলেজ সব এই রাস্তা দিয়েই যাতায়াত । নতুন বলতে নতুন নতুন বিল্ডিং ওঠে শুধু। কেউ মরে, কেউ জন্ম নেয়, কারো বিয়ে হয়। সানাই বাজে। হলুদের উৎসব হয়। সবই দেখে শুনে বোঝে তারানা। হলুদের অনুষ্ঠান কান পেতে শোনে রাত জেগে। নতুন বউ আসার হৈ হৈ চোখ পেতে দেখে। দেখতে দেখতে বুকের ভেতর চিনচিন করে একটা ব্যথা। যে ব্যথার সাথে ভেসে উঠে হালকা হিংসার দীর্ঘশ্বাস।
৪০ ছুঁই ছুঁই তারানা তার ৬ বছরের ভাতিজাকে স্কুলে ঢুকিয়ে সামনে একটা ঠেলাগাড়িতে বিক্রি হওয়া হরেকরকমের কসমেটিক্স দেখতে দাঁড়ায়। এমিটেশনের কত রকমের কানের দুল, চুরি, গলার হার, নূপুর আরও কত কি। তারানার চোখ যায় রশিতে টাঙ্গানো কয়েকটা টিকলির দিকে। সেই ছোটবেলা থেকে টিকলি জিনিসটা তার খুব পছন্দের। জীবনে টিকলি পরতে পেড়েছে মনে হয় একবারই শুধু। বড়দার বিয়েতে। একটা লাল পুতির সোনালি রঙের টিকলি পরেছিল। বিয়ের হট্টগোলে কোথায় রেখেছিল, পরে আর পায়নি। খুব প্রিয় ছিল তার টিকলিটা। সাধ ছিল নিজের বিয়েতে পরবে। বিয়েই হল না এই জীবনে! কেন হলো না যদি কেউ জানতে চায় তারানা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কী জবাব দিবে সে খুঁজে পায় না। সত্যি তো! কেন হল না বিয়ে?
নেবে কি নেবে না ভাবতে ভাবতে নিয়েই ফেলল। ৬০ টাকা দিয়ে একটা সোনালি রঙের টিকলি।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে ব্যাগটা পরম মমতায় আগলে রাখলো। যেন ভীষণ দামি কিছু কিনেছে। দামি? টাকা দিয়েই দাম হয় কি? হলে কি বইয়ের পাতার ভাজে রেখে দেওয়া গোলাপের পাপড়ি সযত্নে রেখে দেয় মানুষ যুগের পর যুগ!
বাড়ি ফিরে দেখে মা আর ভাবী বের হচ্ছে শপিং করতে। রান্নার কাজ সেরেই তারানার আর কোনো কাজ নেই বলে ঘোষণা দিয়ে গেছে ভাবী। তারানাও বলেছে, হ্যাঁ ভাবী তেমন আর কই কাজ! তোমরা যাও। খেয়ে আসবে না এসে খাবে?
গরম থেকে এসে ফ্রিজের পানি খেয়ে তারানা রান্নায় লেগে গেলো। টিকলির কথা মনেও থাকল না।
দুপুর গড়ায়। স্নান সেরে তারানা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে লোশন মাখে হাতে গলায়। মাখতে মাখতে চোখ যায় বিছানায় রাখা সেই টিকলির প্যাকেটের দিকে। একটু তাকায়। এরপর তুলে নেয় হাতে। নরম খুব নরম হাতে সে খোলে সেটা। কেন যেন টিকলিটি হাতে নেওয়ার পর সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। ঠাণ্ডা একটা শীতল অনুভূতি পেল হাতে। আয়নায় তাকিয়ে মাথায় পরল টিকলি। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তাকিয়ে থেকে থেকে চোখ জ্বালা করতে লাগল। হুট করে চোখ গেল নিজের পরনের সাদামাটা কামিজটার দিকে। ভ্রু কুচকে গেলো। এ কি জামা! এতো সুন্দর একটা টিকলির সাথে এ জামা কি যায়? না এ জামা যায় না। কিছুতেই যায় না।
তারানা এক টানে কামিজ খুলে ফেলে। ভেতরের বক্ষবন্ধনীও কেমন যেন ফ্যাকাসে রঙের। সেটাও খুলে ফেলে। এরপর এক পলকে তাকিয়ে থাকে নিজের দিকে। কীসের এক চুম্বক আকর্ষণে চোখ ফেরাতে পারে না। অপলক চোখে তাকিয়ে দেখে নিজের চুল, যে চুলে কেউ নাক ঘষেনি। নিজের মুখ, যে মুখ কেউ দুষ্টুমিতে ছুঁয়ে দেয়নি। নিজের ঠোঁট, যে ঠোঁটে কেউ চুমু দেয়নি।
চোখ নামে আরও নিচে। গলায়, গ্রীবায়, বুকে, পেটে, নাভিতে। মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখছে, যেন আজই নিজেকে আবিষ্কার করছে। ৪০ বছর ধরে যে শরীর অস্পর্শে জ্বলছিল বা নিভছিল তা যেন আজই প্রথম দেখল তারানা। এখনও সে কি ভীষণ নমনীয় আছে! কি ভীষণ সুডৌল তার বক্ষ যুগল! নাভির নিচে এখনও কোনও চর্বি জমে নি। এখনো ঝুলে পড়েনি কোথাও চামড়া। তার এই শরীরের সাথে কি চমৎকার মানিয়েছে টিকলিটি! কি প্রবলভাবে জ্বলছে সে । কি ভীষণ আশ্চর্য!
তারানা হাত বুলায় মুখে, ঠোঁটে, গলায়, বুকে, পেটে। আদর করে নিজেকে। চোখ বুঁজে, চোখ খুলে।
টিকলিটির চমক হুট করে যেন একটু কম লাগল। সে আয়নায় ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মনোযোগ দিতেই কানে যায় দূর থেকে কারো হিসপিস শব্দ। কারো চুপিসারে কথা বলার আওয়াজ। তারানা জমে যায়। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নিথর। মনে পড়ে বিছানার পাশে জানালাটা খোলা। সেখান থেকে একটু দূরের বিল্ডিঙের ছাদে উঠলে এই রুমের সব দেখা যায়। তারানার নড়াচড়ার শক্তি থাকে না যেন। সে জানে আয়নাতে একটু ডান পাশে তাকালেই দেখতে পাবে সেই ছাদ। ছাদে নিশ্চয়ই কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। তার উলঙ্গ শরীর দেখছে!
কোনোমতে শক্তি সঞ্চয় করে এক ঝটকায় জামাটা নিতে পিছন ফেরে তারানা। বিছানা থেকে জামাটা তুলে নিতেই অনিচ্ছায় চোখ পড়ে যায় দুই যুবকের প্রতি। যারা তাকেই দেখে যাচ্ছে। তাকে দেখে দেখেই একে অপরের সাথে কথা বলছে। মুখে তাদের কুটিল হাসি।
নিমিষেই বাথরুমে ঢুকে পড়ে তারানা। পুরো শরীর তার কাঁপতে থাকে। কাঁপতে কাঁপতে মেঝেতে লুটিয়ে তারস্বরে একটা চিৎকার দেয়।
আশ্চর্য! সেই চিৎকারে টিকলিটি কীভাবে যেন তারানার মাথা থেকে খুলে মেঝেতে পড়ে যায়!