November 21, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

মায়ের পরিচয়ই হোক সন্তানের পরিচয়

আফরোজ ন্যান্সি।। আমাদের জীবন জুড়ে মাতৃভূমি, মাতৃভাষা ইত্যাদি শব্দ জড়িয়ে আছে কিন্তু মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের কথা বলতে গেলেই হা রে রে রে করে ছুটে আসবেন অনেকেই। মায়ের রক্ত চুষে মায়ের পেটে জন্ম নিচ্ছি, মা বড় করছেনে পেলে-পুষে, মাতৃভূমিতে হামাগুড়ি খেয়ে হাঁটতে শিখছি, মাতৃভাষায় কথা বলছি তবু পরিবারটি হওয়া চাই পিতৃতান্ত্রিক, নামের শেষে বাবার উপাধি জুড়ে দেওয়াই নিয়ম, স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে যাবতীয় অফিসিয়াল, আনঅফিসিয়াল কাজে চাই পিতার নাম-পরিচয়।

বার্থ সার্টিফিকেট সম্ভবত মানুষের জীবনের প্রথম লিগ্যাল ডকুমেন্ট যা তার অস্তিত্বের স্বীকৃতি দেয়। সহজ করে বললে, বার্থ সার্টিফিকেট একজন মানুষের প্রথম লিগ্যাল আইডেন্টিটি। জন্ম নিবন্ধন কেন একইসাথে ব্যক্তির এবং রাষ্ট্রের জন্য জরুরি আর এর অনুপস্থিতিতে কী কী অসুবিধা তৈরি হতে পারে একজন সচেতন নাগরিক মাত্রই তা জানেন। অথচ ইউনেস্কোসহ বেশ কিছু সংস্থার করা জন্মনিবন্ধন সম্পর্কিত জরিপে দেখা যায় যে গোটা বিশ্বের ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ২৩০ মিলিয়ন শিশুর কোনো জন্মনিবন্ধন করা হয়না। শুধুমাত্র বাংলাদেশে ১০ মিলিয়ন শিশু আছে যা মোট শিশুর ৩৭% অফিসিয়ালি যাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। অর্থাৎ সরকারি নথিতে এই এক কোটি শিশুর অস্তিত্ব অনুপস্থিত। এই জরিপগুলি আমাদের ভাবতে বাধ্য করে যে, অতি প্রয়োজনীয় এই বিষয়টিতে মানুষের কেন এমন অনীহা? বিশ্বব্যাপী এই বিশাল সংখ্যক শিশু, অফিসিয়ালি যাদের কোনো অস্তিত্ব নেই, যাদের জন্মহার, মৃত্যুহার, শিক্ষার হার, অপরাধপ্রবণতা, রোগ-শোক ইত্যাদির কোনো পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই।

মুম্বাইসহ বেশ কিছু বড় শহরের বস্তিগুলিতে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে জন্ম নিবন্ধন না করার পেছনে সব থেকে বড় যে কারণটি কাজ করে তা হল, এইসব শিশুদের পিতৃপরিচয় না থাকা। অনিবন্ধিত এই বিশাল জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগেরই পিতৃপরিচয় নেই। আর যেহেতু যে কোন ডকুমেন্টাল ইস্যুতে সবার আগে পিতার নাম-পরিচয় দরকার হয় তাই এইসব শিশুদের জন্ম-নিবন্ধন করা হয়ে ওঠে না, প্রকারান্তরে মোট জনসংখ্যার কোথাও এই শিশুদের অস্তিত্ব থাকেনা। এরই ফলস্বরূপ স্বাভাবিকভাবেই এই শিশুরা যাবতীয় মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনিবন্ধিত এইসব শিশুরা শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেনা, চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অশিক্ষায় এবং অধিকার বঞ্চিত হয়ে বেড়ে ওঠা এইসব শিশুরা খুব স্বাভাবিকভাবেই জড়িয়ে পরছে মাদক ব্যবসা, চুরি, ছিনতাই কিংবা আরো বড় কোনো অপরাধের সাথে। বাংলাদেশের পতিতালয়গুলির দিকে যদি তাকাই দেখবো প্রতিবছর এসব পতিতালয়ে অনেক শিশুর জন্ম হচ্ছে এবং সেই অন্ধকারেই হারিয়ে যাচ্ছে তারা। কেবলমাত্র পিতৃপরিচয়ের অভাবে তাদেরকে মোট জনসংখ্যার তালিকার বাইরে রাখা হচ্ছে, অন্য শিশুদের মতোন তাদেরকে দেওয়া হচ্ছে না যথাযথ মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা ।

এই সিস্টেমের বলির পাঠা শুধু বস্তি এবং পতিতালয়ের পিতৃপরিচয়হীন শিশুরাই না বরং কোনো নারী যদি “কুমারী মা” কিংবা “সিঙ্গেল মাদার” হতে চায় সেক্ষেত্রে তাদের বেশ ঝক্কি পোহাতে হয়। এই উপমহাদেশে গর্ভপাতের হার অন্যদের তুলনায় বেশি কেননা এখানকার মেয়েরা কুমারী মা হবার ঝুঁকি নিতে পারেনা। কেননা সে জানে প্রতি পদে পদে সন্তানের পিতৃপরিচয় দরকার হবে। আর যে প্রতারক পুরুষ সন্তানের দায় না নিয়ে পালিয়ে যায় তার নাম-পরিচয় ব্যবহার করে সন্তানকে বড় করার অধিকারও স্বভাবতই সে দিয়ে যায়না। একদিকে আইন করে ভ্রুণ হত্যাকে অপরাধ হিসেবে দেখানো হচ্ছে, অন্যদিকে শিশুজন্মের দিন থেকেই সমস্ত কাগজপত্রে পিতার নাম-পরিচয় বাধ্যতামূলকভাবে চাওয়া হচ্ছে,  নিঃসন্দেহে এই সিস্টেম পারস্পরিক সাংঘর্ষিক।

আবার ধরা যাক, মিসেস অমুক একজন সিঙ্গেল মাদার। তার স্বামীটি চুড়ান্ত মাত্রার অমানুষ। সন্তান গর্ভে আসার কিছুদিন পরেই তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর মিসেস অমুক কখনোই আর সেই অমানুষের ছায়া মাড়ানো তো দূরে থাক নামও মনে রাখতে চান না, কিন্তু বাচ্চার জন্ম নিবন্ধন, স্কুলে ভর্তি, ডক্টরের রেজিস্টার সবখানে ব্যবহার করতে হচ্ছে অমানুষটির নাম, যদিও তিনিই জন্ম দিয়েছেন শিশুটিকে, একাই বড় করছেন, ভরণ-পোষণ সমস্তই দিচ্ছেন, অসুস্থ হলে রাত জাগছেন, মা এবং বাবার দায়িত্ব সবটাই তিনি একা পালন করে যাচ্ছেন। কিন্তু শুধুমাত্র এক ফোঁটা বীর্যের দাবিতে বাচ্চার নামের পরেই সব ডকুমেন্টে সবার আগে লেখা হবে অমানুষটির নাম আর তার নিচের লাইনে লেখা হবে মায়ের নামটি-  এর যৌক্তিকতা কি? আদৌ কোনো যুক্তি আছে কি না আমার জানা নাই।

আপনি কি আমায় দেখাতে পারবেন একজন লোকের জন্মনিবন্ধন হয়েছে বাবার নামের ঘরটি পূরণ করা ছাড়া? কিংবা একজন শিশু স্কুলে ভর্তি হতে পেরেছে পিতৃপরিচয় ছাড়া? একজন লোকেরও ন্যাশনাল আইডি আছে বাবার নাম-পরিচয় ছাড়া?

অথচ এই বাস্তবতা আমাদের সকলের জানা যে, প্রতিবছর পতিতালয়ে, বস্তিতে, ফুটপাতে অসংখ্য শিশুর জন্ম হচ্ছে যার মধ্যে অধিকাংশ শিশুরই পিতৃপরিচয় নেই। এর মানে কি দাঁড়াচ্ছে যে ওইসব শিশুরা অন্য আর দশটা শিশুর মতন শিক্ষার অধিকার রাখেনা? তারা দেশের নাগরিক নয়? এদের খাদ্যের যোগান, শিক্ষার ব্যবস্থা, চিকিৎসার সরবরাহ, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রাষ্ট্রের দিতে হচ্ছেনা? আবার এইসব সুবিধাবঞ্চিত শিশুরাই যখন বড় হয়ে অপরাধ করে, খুনি কিংবা ধর্ষক হয় তখন সেই অপরাধপ্রবনতার দায় কি রাষ্ট্র নেয়? যেহেতু জন্মের পর রাষ্ট্র তাকে স্বীকৃতি দেয়নি, রাষ্ট্রের নথিতে নাম ওঠেনি তার, সে পায়নি শিক্ষার সুযোগ, যাবতীয় মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে রাষ্ট্র তাকে তবে তার অপরাধের দায়, অশিক্ষার দায় তো রাষ্ট্রেরই নেওয়া উচিৎ।

অথবা রাষ্ট্রের উচিৎ বিকল্প এমন একটা নিয়ম করা যেন একজন মানুষের জন্য পিতৃপরিচয় কোনো অমোঘ বিষয় হিসেবে গন্য না করা হয়। শুধুমাত্র মায়ের পরিচয়েও যেন নথিভুক্ত করা যায় এইসব পিতৃপরিচয়হীন শিশুদের। শুধুমাত্র মায়ের পরিচয় দিয়েও সে যেন ভর্তি হতে  পারে স্কুলে। যেহেতু পিতৃপরিচয় না থাকা একজন শিশুর কোন অপরাধ নয়, সেহেতু এই দায়ে তাকে অধিকারবঞ্চিত করে রাখার অধিকার রাষ্ট্রের কিংবা সমাজের নেই। যে নারীরা কখনো অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে শেখেনি তারা যেন নিজের পরিচয়ে সন্তানকে বড় করতে পারে, নিজেদের আত্মসম্মানবোধকে যেন সিস্টেমের কাছে বলি দিতে না হয়, একজন নাগরিক হিসেবে এই মর্যাদাটুকু তাদের প্রাপ্য হওয়া উচিৎ বলে মনে করি।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]