November 2, 2024
কলামফিচার ৩

প্রান্তিক নারী: তাদের কথা কারা ভাবে?

আঞ্জুমান রোজী।। আমরা যারা নারীর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখালেখি করি তাদের বেশিরভাগই শিক্ষিত, শহরকেন্দ্রিক এবং আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত নারী। শহরকেন্দ্রিক নারীর পারিবারিক, সামাজিক,  অর্থনৈতিক বিভিন্ন বাধা প্রতিবন্ধকতা ও সমস্যাগুলো তুলে ধরা হয় বেশি। আমরা সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হই বলে জীবনের সেসব বৈরী অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে চেষ্টা করি। এই লেখালেখি শিক্ষিত, শহরকেন্দ্রিক নারীদের সচেতন করার জন্য নয় শুধু, আমি মনে করি পুরো নারী সমাজের সচেতনতার জন্যই লেখা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব সচেতনমূলক লেখা প্রান্তিক নারীগোষ্ঠির কাছে পৌঁছাচ্ছে কি না! কারণ, শিক্ষিত, অবস্থাসম্পন্ন নারীর বাইরে একটি বিরাট প্রান্তিক নারীগোষ্ঠী আছে। যারা মানবেতর জীবনযাপন করছে এবং সমাজের ঘৃণ্য বৈষম্যের শিকার হয়ে আছে।

যদিও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সব নারীর সমস্যা মূলত এক, তা নিম্নশ্রেণি হোক আর উচ্চশ্রেণির নারী হোক। নারীর ক্ষমতায়ন, অধিকার সচেতনতা ও যথোপযুক্ত শিক্ষা- এর সবই পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শুধু ক্ষেত্রবিশেষে এর প্রকাশ ও ধরণ থাকে ভিন্ন। কিন্তু শিক্ষিত, শহরকেন্দ্রিক নারী যতটা অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে পারে কিংবা যুদ্ধ করে  ঠিক ততটা কি প্রান্তিক নারী পারে?

পারে না। কারণ,  একে তো এদের শিক্ষা নেই।  তার উপর আছে অন্ধ ধর্মীয় গোঁড়ামি।  সবকিছু মিলিয়ে সামাজিক,  অর্থনৈতিকভাবে এরা অমানবিক  জীবনযাপন করে। এমনকি   গ্রামে নারী গৃহস্থালী, কৃষি ও পশুপালনের মত উৎপাদন কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকলেও তার কোনো স্বীকৃতি নেই। স্বীকৃতি নেই দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করা নারীর দক্ষতার। সেখানে সভ্যতার কোনো আলো নেই। তাই প্রান্তিক নারীরাই আর্থসামাজিকভাবে সবচেয়ে বেশি অবহেলার শিকার।

আসলে প্রান্তিক নারী কাদেরকে বলবো? যারা মূলত প্রেক্ষাপট নির্ভর বঞ্চনা ও সামাজিক সব রকম সুবিধাহীনতার শিকার। এভাবে দেখলে হাওর অঞ্চলের নারীরা যেমন প্রান্তিক হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে, তেমনি ঢাকা শহরের মেয়ে পথশিশুরাও এই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। যারা রাষ্ট্রের ও সমাজের নানা কর্মকাণ্ডের মূল স্রোতের বাইরে,  যাদের জন্য সমাজ বা রাষ্ট্রপ্রদত্ত সুযোগ সুবিধাসমূহ অপ্রতুল কিংবা নেই, তারাই মূলত প্রান্তিক নারী। দেশে এদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। যাদের মধ্যে মানবিক সচেতনতা বলতে কিচ্ছু নেই, নেই কোনো শিক্ষা, এমনকি বোধবুদ্ধি বিবেচনায় একেবারে শূন্যের কোঠায় এদের অবস্থান।

শহরের পথে পথে এমন অনেক নারী তো দেখিই, বেশি দেখি গ্রামের দিকে গেলে। এদের জীবনমান কোনো কিছুতেই মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। সব অবস্থায় ছন্নছাড়া জীবনযাপন। অনেক নারী এমন জীবনকে  নিয়তি বলে ধরে নেয়। এদের অবস্থান না বাবার বাড়িতে সুরক্ষিত বা ভালো অবস্থায় আছে,  না শ্বশুড় বাড়িতে আছে। এসব নারী একা থাকার কথা তো কল্পনাও করতে পারেনা। নারী মানুষ, তাদেরও ইচ্ছা অনিচ্ছা, পছন্দ অপছন্দ এবং মতপ্রকাশের যে স্বাধীনতা আছে, এ বিষয়গুলো তাদের মাথাতেই নেই।  এই প্রান্তিক নারীকুল জন্মেই যেভাবে বড় হতে থাকে তাতে তারা ধরে নেই এটাই নারীর জীবন। অথচ আমরা যারা নারী নিয়ে এতো লেখালেখি করি তার বিন্দুবিসর্গ তাদের ধারে কাছে পৌছায় না। এক অন্ধকার কূপে এদের বসবাস বলে না পায় শিক্ষার আলো, না আছে অর্থনৈতিক মুক্তি!

বাংলাদেশে প্রান্তিক নারীদের নিয়ে গবেষণা বা লেখালেখি তুলনামূলক কম। যে গবেষণাগুলো আছে তাতে প্রান্তিক নারীদেরকে আলাদা করে দেখানো হয়নি।  বরং প্রান্তিক এলাকায় থাকার কারণে নারী বা শিশুদের নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে গবেষণা হয়েছে।  ফলে এসব গবেষণার তথ্য থেকে প্রান্তিক এলাকার নারীদের শিক্ষার সার্বিক অবস্থা, তাদের সমস্যার ধরণ এবং সমাধানের পথগুলো চিহ্নিত করা যায়না। কিন্তু  সার্বিক অবস্থা বোঝা না গেলেও তাদের সমস্যা সম্পর্কে বেশ কিছু ধারণা পাওয়া যায়।  শিক্ষার দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যায়, চা বাগান, হাওর,  বস্তি, যৌনকর্মীদের সন্তান আদিবাসী গ্রুপ,  চর ও উপকূলীয় এলাকার মানুষ  ইত্যাদি এলাকার মেয়েশিশু ও নারীরা ভয়াবহ প্রান্তিকতার শিকার।

উচ্চস্তরে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা কিছুটা দূর হলেও প্রান্তিক পর্যায়ে এর তীব্রতা থেকে গেছে চরমভাবে। যার কারণে, প্রান্তিক নারীরা নানা রকম বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। নারী নিয়ে সচেতনতামূলক যতই লেখালেখি করি না কেন, এই লেখা প্রান্তিক নারী শ্রেণির কাছে না পৌঁছালে আমাদের সব পরিশ্রমই পণ্ড হবে। সচেতন নারীবাদীদের বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে ভাবা উচিৎ,  কিভাবে এই প্রান্তিক নারীকুলের কাছে পৌঁছানো যায় সে উপায় খোঁজা উচিত। এদের মানুষ হিসেবে সচেতন করে না তুলতে পারলে এই নারীমুক্তি আর নারী স্বাধীনতার  আন্দোলন সবই ভেস্তে যাবে।

সর্বোপরি নারীর টেকসই উন্নয়নের জন্য নারীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা জরুরি। আর সেই সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রান্তিক নারীর সচেতনতা, শিক্ষা ও দক্ষতার উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব মতামত]