শ্রমিকের লড়াই, মার্ক্সীয় নারীবাদ ও অন্যান্য
নারীবাদ: বোঝা ও বোঝাপড়া (পর্ব-০৫)
শারমিন শামস্।। “একই জমিতে পুরুষের পাশাপাশি আমন ধান কাটার কাজ করছেন আদিবাসী নারী সানজিলি হাজদা(২৬)। দিনের শুরুটা হয় একসাথে একই ধরনের কাজে আবার শেষও হয় সবারই একসঙ্গে। কিন্তু মজুরি নিতে গেলে পুরুষ শ্রমিক মোতালেব হোসেনের চেয়ে দেড়’শ টাকা কম পান সানজিলি হাজদা। সরেজমিনে দেখা যায়, দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার আরজি গলাহার এলাকায় ৭ জন নারী শ্রমিক ও একজন পুরুষ শ্রমিক আমন ধান কাটার কাজ করছেন। পাশের আরেকটি জমিতে ১০ জন পুরুষের আরেকটি শ্রমিক দল আমন ধান কাটার কাজে ব্যস্ত। কিন্তু সারা দিনে নারী শ্রমিকরা একই কাজ করে মজুরি হিসেবে পাচ্ছেন ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। আবার একই কাজে পুরুষ শ্রমিকরা পাচ্ছেন ৩৫০ থেকে সাড়ে ৪০০ টাকা। দিন দিন পুরুষের চেয়ে নারী শ্রমিকদের কদর বাড়লেও বাড়েনি তাদের মজুরি কাঠামো। সস্তা শ্রম আর হাতের কাছেই নারী শ্রমিকদের প্রতুলতা মালিক শ্রেণিকে আকৃষ্ট করতে পারলেও মজুরি কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না।”
গত ২ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকার রিপোর্ট এটি। (শিরোনাম-নারী শ্রমিকের কদর বাড়লেও বাড়েনি মজুরি)
এত এত জাতীয়, আন্তর্জাতিক সভা সেমিনার, এত আলোচনা আর মতবিনিময়, তবু দুনিয়া জুড়ে নারীর জীবন এখনও সামাজিক দুষ্ট রীতি আর আর অন্যায় প্রথার ভেতরে আবদ্ধ। নারী এখনও পুরুষের সমান হয়ে উঠতে পারেনি সমাজ বাস্তবতায়। কর্মক্ষেত্রে একই শ্রম বিনিয়োগ করেও আজো পুরুষের সমান মর্যাদা পায়নি নারী।
১৮৮৮ সালে লন্ডনের একটি ম্যাচ ফ্যাক্টরির ১৪শ নারী শ্রমিক রাস্তায় নেমে এসেছিল। শ্রমঘণ্টা ১৪ থেকে কমিয়ে আনা এবং ন্যায্য মজুরির দাবিতে। সেই সাথে ছিল সুস্থ কর্মপরিবেশের দাবিও। এই ম্যাচ গার্লস স্ট্রাইক সাড়া ফেলেছিল অনেক। জনমত গেল নারী শ্রমিকদের পক্ষে। দাবি মেনে নেয়া হল। ম্যাচ গার্লস স্ট্রাইকের ঢেউ ইংল্যান্ডের অন্যান্য জায়গাতেও বয়ে গিয়েছিল। জোয়ার আসলো ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের চিন্তায়।
এদিকে কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডরিক অ্যাঙ্গেলস তাদের ‘The Communist Manifesto’ তে লিখলেন, পুঁজিবাদই নারীর সব ধরণের বঞ্চনার কারণ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই নারীকে পরিবার ও সমাজে পুরুষের অধস্তন ও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানিয়ে রাখে। পুঁজিবাদের পতন হলেই নারীর মুক্তি আসবে- বললেন তারা। বইটা প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪৮ এ। সেই সময়ই মার্ক্স ও অ্যাঙ্গেলস নারী অধিকার নিয়ে যা বলার কিছুটা বললেন। কিন্তু পরবর্তীতে বহুদিন পর্যন্ত তাদের লেখালেখি ও মতবাদ প্রচারের মূল লক্ষ্য ছিল শ্রেণি বৈষম্য। লিঙ্গ বৈষম্য বা নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য ও নারীর অধিকারহীনতার কথা মোটামুটি চাপা পড়ে গেল তাদের লেখালেখির পরিসরে। তবে জীবনের শেষভাগে এসে মার্ক্স আবারো নারীর কথা বলতে শুরু করেছিলেন।
মার্ক্সের তত্ত্ব বলছে, লিঙ্গ ভেদে যতদিন কাজ ভাগ করে দেবার ব্যাপারটি থাকবে, ততদিন নারী ও পুরুষের করা প্রত্যেকটি কাজ সমান গুরুত্ব পেতে হবে। কেবলমাত্র পুঁজিবাদের উত্থানেই ব্যক্তিগত সম্পদ বাড়ে, যা মানুষকে উত্তরাধিকারের দিকে আগ্রহী করে তোলে। অ্যাঙ্গেলস ব্যাখ্যা করেছেন, উত্তরাধিকারের সাথে ব্যক্তিজীবনের নৈতিকতা ও একগামী পরিবারের সম্পর্ক রয়েছে, যেটি রক্ষা করতেই নারীর যৌনতার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে সমাজ।
অ্যাঙ্গেলস লিখলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা এবং অধিকারহীনতার গোঁড়াটি রয়েছে পরিবারের ভেতরে। অ্যাঙ্গেলস মনে করতেন, দুনিয়াজুড়ে নিউক্লিয়ার পরিবারের উত্থান নারীর দাসত্বকে আরো মজবুত করেছে। এইসব পরিবারে নারী তার স্বামীর দাস এবং শিশু উৎপাদনের যন্ত্র মাত্র। অ্যাঙ্গেলস লিখেছেন, “She is delivered unconditionally into the power of the husband; if he kills he is only expressing his rights.”
মার্ক্সীয় তত্ত্ব বলছে, সামাজিক উৎপাদনে নারীকে অন্তর্ভূক্ত করতে পারলেই তার মুক্তি আসবে। সে কারণেই নারীর সংগ্রাম শ্রেণির সংগ্রামের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশও বটে। মার্ক্স তত্ত্বে বিশ্বাসীরা মনে করেন, ব্যক্তিগত সম্পদের ধারণা দূর হলে লিঙ্গ বৈষম্য থাকবে না, ফলে নারীর বঞ্চনা আর নির্যাতিত হবার দিনও শেষ হবে।
মার্ক্সীয় নারীবাদীরা (Marxist Feminists) বিশ্বাস করেন, পুঁজিবাদ নারীকে ব্যবহার করে। তারা নারীকে বলছেন, ‘Reserve army of labour’, যখন প্রয়োজন তখন ব্যবহার করা হয়, যেমন যুদ্ধের সময়। আবার দরকার শেষ হলে তাদেরকে সব কিছু থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়। পিতৃতন্ত্র এবং পুঁজিবাদ এই দুটি ব্যবস্থাকে মার্ক্সীয় নারীবাদীরা চিহ্নিত করছেন নারীর সব ধরণের বঞ্চনার মূল কারণ হিসেবে। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সম্পদের চিন্তা আসবার আগেই পিতৃতন্ত্র ও পুরুষের আধিপত্য শুরু হয়েছিল- এ নিয়ে তর্কও রয়ে গেছে।
সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ মার্ক্সের শোষণ, বঞ্চনা ও শ্রম সম্পর্কিত চিন্তাধারার সাথে নারীর অধিকারহীনতার বিষয়টির যোগসূত্র খুঁজে পায়। সমাজতান্ত্রিক নারীবাদিরা (Socialist Feminists) মনে করেন, ঘরে এবং বাইরে সব ক্ষেত্রেই শ্রমের অসম বন্টন নারীকে নিচু করে রাখে। তাদের মতে, বিয়ে, শিশুপালন, ঘরের কাজ কিংবা যৌনকর্মী হিসেবে সেবা দেয়ার কাজগুলোর মধ্য দিয়ে নারী পিতৃতন্ত্রের হাতে শোষিত হয়। পিতৃতন্ত্র নারীকে ব্যবহার করে, কিন্তু নারীর কাজের কোনরকম মূল্যায়ন করেনা। আবার ঘরের কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন নাই বলেই নারীকে পরিবারের অন্য সদস্যরা প্রতিনিয়ত ছোট করে দেখে।
বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমাদের সমাজের দিকে তাকালেই। এখনো এই সমাজে গৃহস্থালীর কাজের দায় পুরোটাই নারীর ওপর। কিন্তু এর কোন ধরণের মূল্যায়ন নাই। এখানে উল্লেখ করি, ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের এক গবেষণা বলছে, ৮১ শতাংশ নারী সরাসরি গৃহস্থালি কাজে নিয়োজিত থাকেন। অন্যদিকে, পুরুষ করেন মাত্র ১.৩ শতাংশ। যেখানে ১৯ শতাংশ নারী চাকরির সঙ্গে যুক্ত সেখানে ৯৮ দশমিক ৭ শতাংশ পুরুষ কোনও না কোনও নিয়মিত বা অনিয়মিত চাকরিতে নিয়োজিত।
পুরুষদের তুলনায় সাড়ে তিনগুণ বেশি মজুরিবিহীন কাজ করেন এ দেশের নারীরা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘টাইম ইউজড সার্ভে’ মতে, ১৫ বছরের বেশি বয়সী কর্মজীবীদের মধ্যে ঘরের বিভিন্ন কাজে পুরুষ দৈনিক ১ দশমিক ৪ ঘণ্টা এবং নারী ব্যয় করেন ৩ দশমিক ৬ ঘণ্টা। কর্মজীবী না হলে গড়ে নারীরা দিনে ৬ দশমিক ২ ঘণ্টা এবং পুরুষ ১ দশমিক ২ ঘণ্টা এ ধরনের কাজে ব্যয় করেন। এই কাজের বিকল্প মূল্যায়ন হওয়া জরুরি। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হল, জিডিপিতে এগুলোকে যুক্ত করার কোন বাস্তবতা নেই। কারণ জিডিপির সংজ্ঞায় আছে, এমন এমন সেবা অন্তর্ভুক্ত হবে যেগুলো টাকার মাধ্যমে লেনদেন হয়। গৃহস্থালি কাজ তো তেমন না!
মার্ক্স অনুভব করতেন, শ্রেণি বৈষম্য থেকে মুক্তি মিললে লিঙ্গ বৈষম্য এমনিতেই কেটে যাবে। সোশ্যালিস্ট ফেমিনিস্টরা লিঙ্গ বৈষম্যকে শ্রেণি বৈষম্যের একটা সাব ক্লাস ধরে নেয়ার বিষয়টিকে অযৌক্তিক মনে করেন। এবং বেশিরভাগ সমাজতান্ত্রিক নারীবাদিই শ্রেণি বৈষম্যের বিষয়টি থেকে লিঙ্গ বৈষম্যকে আলাদা করে দেখার পক্ষে কাজ করেছেন। মার্ক্সের তত্ত্বকে তারা সমালোচনাও করেছেন লিঙ্গ বৈষম্যের বিষয়ে নীরব থাকার জন্য। সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা সমাজে কাঠামোয় বড় ধরণের পরিবর্তনের প্রত্যাশা করেন। এদের অনেকেই Radical বলে পরিচিতি পেয়েছিলেন।
মার্ক্স ও অ্যাঙ্গেলসের মৃত্যু এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর নারীর ক্ষমতায়ন ও সারাবিশ্বে ভোটাধিকার নিয়ে নতুন করে ভাবনা শুরু হল।
এ সময় জার্মানিতে ক্লারা জেটকিন ও রোজা লুক্সেমবার্গ এবং রাশিয়ায় আলেকজান্দ্রা কলন্তাই বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। নারী কোন সমাজতান্ত্রিক নেতৃত্বে থাকতে পারবে না- এইরকম চিন্তাধারাকে স্রেফ বাতিল ঘোষণা করেন তারা এবং শ্রমিক মুক্তির লড়াইয়ের প্ল্যাটফর্মে নারী অধিকারকেও সামনে নিয়ে আসেন।
ক্লারা জেটকিন (১৮৫৭-১৯৩৩)
ক্লারা জেকটিন সে অর্থে নারীবাদী ছিলেন না, ছিলেন কম্যুনিস্ট।। ছিলেন সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সক্রিয় কর্মী। নারীবাদকে বুর্জোয়াদের আন্দোলন বলেছিলেন একসময়। পরে তিনিই নারী অধিকার আন্দোলনকে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত করেছিলেন।
জার্মানির স্যাক্সোনিতে জন্মেছিলেন। নারীর ভোটাধিকার ও শ্রমের অধিকার নিয়ে কাজ করে গেছেন। জার্মানিতে নারী অধিকার আন্দোলনকে তিনি পুরো ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী আন্দোলন হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। “Die Gleichheit” নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, যার নামের অর্থ সমতা। ১৮৯২ থেকে ১৯১৭ পর্যন্ত সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নারীদের কার্যালয়টির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আজকে সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ৮ মার্চ যা পালন হয়, তার বড় কৃতিত্ব ক্লারার।
১৯১১ সালে কোপেনহেগেনে শ্রমজীবী নারীদের একটি সমাবেশ করার চিন্তা করেন ক্লারা। প্রথম দিকে অস্ট্রিয়াতে অনুষ্ঠিত হলেও, পরে তা ডেনমার্ক, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডেও হয় এবং ধীরে ধীরে সিারাবিশ্বে ছড়িয়ে যায় এবং এখনও পালিত হচ্ছে।
১৯২০ সালে লেলিনের একটি সাক্ষাৎকার নেন জেটকিন যার মূল বিষয় ছিল নারীর সামাজিক অধিকার ও সমতা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির ভূমিকার বিরোধী ছিলেন ক্লারা। তিনি শ্রমিকদের প্রতি আবেদন জানিয়েছিলেন যেন তারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়। ফলে হিটলার ক্ষমতায় আসবার পর পালিয়ে যেতে বাধ্য হন সোভিয়েত ইউনিয়নে। সেখানেই মৃত্যু হয় তার।
(চলবে)
আরও পড়ুন-
পর্ব-১: নারীবাদ ও পিতৃতন্ত্র: বোঝাপড়ার শুরু
পর্ব ২: নারীবাদের প্রথম তরঙ্গ, ভোটের অধিকার ও স্বপ্নদ্রষ্টা মেরি
পর্ব ৩: সাহসী মেরি, পুরুষতান্ত্রিক গোঁয়ার রুশো ও ফেমিনিন ফিলোসফার মিল
পর্ব-৪: ‘পুরুষের মতই পেশি আমার আছে, তাদের সমান কাজ করতে পারি’