November 2, 2024
কলামফিচার ২

করোনাকালে নারীমুক্তির প্রশ্নটি কি তুলে রাখতে হবে?

ইমতিয়াজ মাহমুদ।।

[১]

করোনা ভাইরাস মানুষকে অসুস্থ করে, কোন কোন সময় মানুষের মৃত্যুও ঘটায়। এই কথাটা নারী পুরুষ সকলের জন্যেই সত্যি। করোনার জন্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিঘ্নিত হচ্ছে, বড় বড় সব দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে প্রায়। এইটাও নারী পুরুষ দুইয়ের জন্যেই দুঃসংবাদ। নারীরাও চাকরি হারাচ্ছে, পুরুষরাও হারাচ্ছে। কলেজ ইউনিভার্সিটি ছেলেদের জন্যেও বন্ধ, মেয়েদের জন্যেও বন্ধ। খেলার মাঠ শপিং মল সিনেমা হল এইসবের ক্ষেত্রেও- নারী পুরুষ দুইই সমানভাবে আক্রান্ত। তাইলে কি বলব করোনা ব্যাধি এবং তার সামাজিক অর্থনৈতিক প্রভাব বা প্রতিক্রিয়ায় নারী ও পুরুষের মধ্যে কোন বৈষম্য নাই? এখন কি তবে ঐসব নারীমুক্তি প্রশ্ন না নারীবাদী বক্তব্যগুলি তুলে রেখে কেবল কীভাবে এই ব্যাধির প্রকোপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় সেই ধ্যানে নেমে পড়ব?

না ভাইয়া, একটু রাখেন। নারীমুক্তির প্রশ্নটি মানব সমাজের জন্যে একটি অগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় যে সেই প্রশ্নটি এখন তুলে রাখবেন বা নারীবাদী ইস্যুগুলি কোন সৌখিন আলাপ আলোচনা নয় যে সেগুলি আপাতত শেলফে গুছিয়ে রাখবেন পরে আলোচনা করবেন বলে।

নারীমুক্তির প্রশ্নটি প্রকৃত অর্থে মানুষের মুক্তির প্রশ্ন এবং সামগ্রিকভাবে মানুষের মুক্তির যে ক্রমাগত সংগ্রাম চলে আসছে যুগ যুগ ধরে তারই একটি অবিচ্ছেদ্য অনিবার্য অংশ হচ্ছে নারীমুক্তির প্রশ্নটি। আরেকটু স্পষ্ট করে বললে, নারীর পূর্ণ মুক্তি যতদিন নিশ্চিত করা না যাবে ততদিন আপনি বলতে পারবেন না যে মানুষের মুক্তির সংগ্রাম জয়যুক্ত হয়েছে বা অগ্রসর হয়েছে। এটা খুবই সোজা এবং সহজ একটি প্রস্তাবনা যেটা সমাজ-অনুগত পুরুষ এবং পুরুষ-অনুগত নারীরা বুঝেন না। প্রস্তাবনাটি যদি খুবই সহজ হবে তাইলে ওরা বুঝবেন না কেন? ওরা বুঝেন না তার কারণ হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য ব্যাপারটাকে একরকম চন্দ্র সূর্যের মত স্বতঃসিদ্ধ ধারনায় রূপান্তর করেছে। ফলে এইটা যে একটা অস্বাভাবিক ঘটনা বা অস্বাভাবিক প্রপঞ্চ এবং এটা যে অন্যায় এই কথাটাই চট করে কারো মাথায় আসে না। পুরুষদের মাথায় তো আসেই না, এমন কি নারীদের মাথায়ও আসে না। এ যেন অনেকটা গাছ থেকে মাটিতে আপেল পড়ার মত ব্যাপার। ছোটবেলায় আমরা বন্ধুরা ঠাট্টা করতাম নিজেদের মধ্যে নিউটন সাহেবকে নিয়ে, ওরে গাছ থেকে আপেল মাটিতে পড়বে না তো কি আসমানে উঠবে? এইটা নিয়ে তোর এতো চিন্তা করার দরকারটা কী ছিল ইত্যাদি। মাঝে মাঝেই আপনি পুরুষদেরকে বলতে শুনবেন, ও ভাই নারীদেরকে এতো অধিকার দেওয়া হয়েছে তাও ওদের শান্তি হয় না, এরা আরও কী চায়? মানে কী? মানে হচ্ছে যে নারীর অধিকার ব্যাপারটা হচ্ছে পুরুষদের দেওয়া দান। পুরুষ আর নারীর মধ্যে পুরুষরা হচ্ছে মালিক আর নারীরা হচ্ছে দাস। মালিক পক্ষ দাসদেরকে এতো স্বাধীনতা দিয়েছে তারপরেও কেন নারীদের এতো হা হুতাশ এইটা নিয়েই পুরুষের বিস্ময়। নারী আর পুরুষ যে মানুষ হিসাবে সমান হতে পারে, দুইজনই যে মানুষ এই কথাটা আমরা ভুলে গুলে খেয়ে বসে আছি।

এজন্যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীমুক্তির প্রশ্নটিকে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে করে না। এমনকি আপাতদৃষ্টিতে যাদেরকে প্রোগ্রেসিভ মনে হয়, লিবারেল মনে হয় এইসব লোককেও দেখবেন বলছে, ও ভাই এখন করোনাকাল চলছে, একটা বিপদের সময়, এখন এইসব নারীবাদী কথাবার্তা বলার সময় না। ভাবখানা যেন নারীবাদী কথাবার্তাগুলি একটা শখের ব্যাপার, শিক্ষিত উচ্চবিত্ত নারীদের কিটি পার্টির মত আরেকটা অলস সময় কাটানোর হাতিয়ার। অথচ বাস্তবতা কী? বাস্তবতা হচ্ছে সমাজের বৈষম্য ইত্যাদি নিয়ে যেমন নারীকে লড়তে হয় দুইটা ফ্রন্টে, যেখানে পুরুষকে লড়তে হয়ে কেবল একটা ফ্রন্টে, ঠিক একই রকমভাবে এই যে এখন করোনাসৃষ্ট সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলি নিয়েও নারীর লড়াইটা পুরুষের লড়াইয়ের দ্বিগুণ কঠিন।

[২]

করোনাপূর্ব পৃথিবীর উদাহরণ দিই। একজন শ্রমিক বা কৃষক বা যে কোন মানুষ যখন শোষণ নির্যাতন বা বৈষম্যের শিকার হয় সেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে ওরা ওদের মত করে ওদের পথে একটা সংগ্রাম গড়ে তোলে অথবা বৈষম্য শোষণ নির্যাতন এইসব সহ্য করে। এই যে শোষণ নির্যাতন বা বৈষম্য এটা তো নারী পুরুষ দুইয়ের বিরুদ্ধেই হচ্ছে। সুতরাং লড়াই যদি করে বা সংগ্রাম যদি করে তাইলে নারী  ‍পুরুষ দুইজনকেই করতে হচ্ছে। এটা হচ্ছে নারীপুরুষের কমন লড়াইয়ের ফ্রন্ট। এই কমন বৈষম্য বা শোষণের সাথে সাথে নারীকে তো কেবল নারী বলেই আবার আরেক দফা বৈষম্য ও শোষণের শিকার হতে হয়। নারী হিসাবে যে তাকে বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে যদি নারী লড়তে নামে তাইলে সেই লড়াইটা হয় নারীর জন্যে সেকেন্ড ফ্রন্ট, যেটা একান্তভাবেই নারীর লড়াই। এই যে সেকেন্ড ফ্রন্টের যে লড়াইটা এখানে পুরুষরা কেউ কেউ নারীর পাশে থাকে বটে, কিন্তু লড়াইটা তো নারীরই লড়াই। এইজন্যে আমরা বলি, নারীকে পুরুষের চেয়ে একটা লড়াই বেশি লড়তে হয়। কেননা সংকট নারীকে দুইভাবে আঘাত করে, একটা এমনিই মানুষ হিসাবে আরেকটা কেবল নারী হিসাবে।

এই যে করোনাসৃষ্ট সংকট চলছে এখন, এখন কী হচ্ছে! আমরা সকলেই এই সংকটে কোন না কোনোভাবে আক্রান্ত। ব্যাধি আক্রমণ করতে পারে এটা তো আছেই। তার উপরে যোগ হয়েছে কাজ না থাকা, আয় উপার্জন বন্ধ হয়ে যাওয়া, জিনিসপত্রের সরবরাহ কমে গেলে কী হবে এইরকম নানা সমস্যা। এইগুলি তো নারী ও পুরুষ উভয়কেই বিপদগ্রস্ত করে। কিন্তু এইসব সংকট আবার নারীর জন্যে আরেক প্রস্থ বাড়তি সংকট যুক্ত করে যেটা হচ্ছে একান্তই নারীর সংকট। আপনারা খবরের কাগজ টেলিভিশনে খবর এইসব যদি দেখেন, তাইলে দেখবেন, এই করোনাকালে নারীর উপর নির্যাতন এক বিন্দু কমে তো নাই উল্টা আরও বেড়েছে। লক্ষ্য করলেই দেখবেন নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ইত্যাদি করোনাকালে যেন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে একটু বেড়ে গেছে। ভাবখানা এই যে, কাজকর্ম নাই অলস সময়, যাই একটা ধর্ষণ করে আসি। এই কয়দিনের খবরের কাগজ অনলাইন পোর্টাল এগুলি খুঁজে দেখেন কয়টা শিশু ধর্ষণ হয়েছে। দেখবেন শিশু ধর্ষণের সংখ্যাও বেড়েছে। সেই সাথে বেড়েছে ঘরের মধ্যে নারীর উপর নির্যাতন।

দেশে করোনা ছুটি চলছে। চলাচল বন্ধ, কাজকর্ম বন্ধ। ব্যাটামানুষগুলি ঘরে বসে বসে কী করে? বৌ পিটায়। এমনিই মেজাজ খারাপ বলে খালি খালিই বৌ পিটায়। অনেকে আবার যৌতুক চেয়ে বৌকে দেয় মাইর। হাতে টাকা পয়সা নাই, বৌকে কিছুক্ষণ পিটিয়ে বলে কিনা ‘যা, বাপের বাড়ী থেকে থেকে টাকা নিয়ে আয় আর টাকা না পেলে ফিরবি না’। আমাদের দেশে ঘরের মধ্যে বৌকে মারধোর করা অত্যাচার করা যৌতুক চাওয়া এগুলি নিয়ে কড়া কড়া সব আইন আছে। কিন্তু এই মরার করোনার কারণে এইসব আইনও ওদের কার্যকারিতা হারিয়েছে অনেকাংশে। কীভাবে? আদালত তো বন্ধ। সুতরাং আপাতত বিস্তারিত বিচার ইত্যাদিও বন্ধ। পুলিশ ভাইরাও এখন লকডাউন কার্যকর করা বা ত্রাণের চাল চোরদের ধরা এইরকম নানারকম করোনাসৃষ্ট জরুরি পরিস্থিতি সামলাতে ব্যাস্ত। এক ব্যাটিকে ওর ভাতার লাথি মেরেছে না লাঠি মেরে মাথা ফাটিয়েছে এইসব তুচ্ছ বিষয় দেখার কি ওদের সময় আছে? পুলিশকেও সেইভাবে দোষ দিতে পারি না, ওদের তো আসলেই অবস্থা কাহিল। করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ওদেরকে রাস্তায় থাকতে হচ্ছে। নিজেরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে, মারাও যাচ্ছে, আবার আইনশৃঙ্খলা এইসবও দেখতে হচ্ছে, ত্রাণের কাজও করতে হচ্ছে। গুরুতর ঘটনা হলে ওরা মামলা নিয়ে মেডিকেল টেস্ট ফেস্ট করে রেখে দিচ্ছে। করোনাকাল যাক, বাকিটা পরে দেখা যাবে। কিন্তু এই যে ভিক্টিম নারীরা, ওদের কী হবে? ওরা কোথায় যাবে?

[৩]

এই যে করোনার কারণে নারীর দুর্দশা বেড়েছে সেটা আমি ঘরে বসে টের পাই। আমার স্ত্রী একটি বড় এনজিওর একজন পরিচালক। নারীর সুরক্ষা ইত্যাদি তাঁর কাজের একটি অংশ। আমার তো কোর্ট বন্ধ, অফিস বন্ধ, আমি ঘরে বসে থাকি, ফেসবুকিং করি, এটা ওটা পড়ি, টেলিভিশন দেখি, মাঝে মাঝে বাসার আশেপাশে গিয়ে একটা দুইটা ফুলের ছবি তুলে নিয়ে আসি। আর তিনি সেই সাত সকালে শুরু করেন টেলিফোন অনলাইন সব যোগাযোগ মাধ্যমে এর সাথে মিটিং, ওখান থেকে খবর নেওয়া, এই দপ্তরে যোগাযোগ করা, অন্যান্য নারী অধিকার সংগঠনগুলির সাথে যোগাযোগ করা। তাঁর টেলিফোন আলাপ শুনতে পাই, ধর্ষণের শিকার নারীটি বা কিশোরীটি পুলিশের কাছে গেছে, পুলিশ মামলা নিয়ে মেডিকেল টেস্ট করে ওকে বিদায় করে দিয়েছে। সেই নারীটি বা কিশোরীটি বা শিশুটির পাশে দাঁড়ানোর এখন কেউ নাই। আবার শুনি যে ঘরের মধ্যে স্বামীর হাতে মারধোর খেয়ে নারীটি পুলিশের কাছে গেছে, জখম গুরুতর না, পুলিশ তাকে বিদায় করে দিয়েছে। কেন? এইসব ছোটখাটো বিষয় দেখার এখন সময় নাই, আপনি ঐ এনজিওর কাছে যান ওরা মিডিয়েশন ইত্যাদি করে কোন রকমে একটা মিটমাট করে দিবে।

এইটাই হচ্ছে অবস্থা। নারী কেবল নারী বলেই বাড়তি বিপদ বাড়তি বৈষম্য বাড়তি অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়। দেশ যখন সংকটে থাকে, সমাজ যখন মহামারি যুদ্ধ বা এইরম অন্য কোন সংকটে থাকে; সংকট সকলেরই হয় কিন্তু নারীর চিরাচরিত সংকট ও সমস্যাগুলি তো থাকেই সেই সাথে আরেকটা বাড়তি সংকট যুক্ত হয়। কৈশোরে যখন ছাত্র রাজনীতি করতে নামি, তখন আমরা শিখেছি ঐ কথাটা- বৈষম্যমূলক সমাজ ভাঙা আমার জন্যে যতটুকু জরুরি, নারীর জন্যে তার চেয়ে দ্বিগুণ জরুরি। শোষণের বিরুদ্ধে আমার লড়াইটাতেও নারীকে থাকতে হয়, সেই সাথে তাকে আবার কেবল নারী বলেই আরেকটি বাড়তি লড়াই লড়তে হয়। এই কথাগুলি যে কেবল কথার কথা নয় সেটি টের পাই জীবনে পদে পদে। আজকের এই করোনাকালেও দেখি, নারীমুক্তির প্রসঙ্গটি করোনার টিকা আবিষ্কারের প্রসঙ্গের চেয়ে কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]