“হাহা” গ্রুপ: যারা আপনার আত্মবিশ্বাস ভাঙ্গতে চায়
মেহেরুন নূর রহমান।। নারী বা নারীবাদ সম্পর্কিত অনলাইন পোর্টালগুলিতে আমি যখনই সময় পাই একটু ঢুঁ মারি। প্রকাশিত লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করি। কিছু কিছু লেখার সাথে আমার মত মিলে যায় আবার কিছু কিছুর সাথে হয়তো মেলে না, কিন্তু আমি লেখকের পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে বোঝার চেষ্টা করি। অনেক লেখাই চিন্তা জাগানিয়া, যাকে বলে থট প্রভোকিং।
এসব লেখায় অনেক ধরণের কমেন্ট থাকে। থাকে অনেক রকম রিঅ্যাকশন। একটা গ্রুপ আছে তাদের কমেন্ট আক্রমণাত্মক এবং গালিগালাজে ভরা। এরা মূলত পুরুষ। সেসব পড়ে আপনি এদের মনোভাব বুঝতে পারবেন সহজেই। এরা নারীদের ঊনমানুষ বলেই মনে করে এবং নারীর অধিকার নিয়ে কেউ কিছু বললেই তাদের খুব বিরক্ত লাগে। নারীর প্রতি হওয়া সহিংসতা নিয়ে লিখলে তারা পুরুষরাও কত অত্যাচারিত তা নিয়ে কথা বলবে। এরাই নারীর পোশাক নিয়ে কটু কথা বলে। ধর্ষণের জন্য নারীদের পোশাক কিংবা যখন তখন নারীদের ঘরের বেরুনোকে ইনিয়ে বিনিয়ে দায়ী করে। নারীবাদীরা পুরুষবিদ্বেষী, তারা নারীবাদের নাম ফ্রি সেক্স এ বিশ্বাসী ইত্যদি ইত্যাদি বলে মজা পায়। এরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নগ্ন অনুগামী। নিরাময়ের অযোগ্য রোগে আক্রান্ত। এদের সাথে তর্কে যাওয়ার মত বোকামি না করাই শ্রেয়।
আমার কথা অন্য একটা সম্প্রদায় নিয়ে। কিছু নারীও এই গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। এরাও পুরুষতান্ত্রিক সমাজেরই তল্পিবাহক কিন্তু সরাসরি তা প্রকাশ করবে না। আমি এদের নাম দিয়েছি “হাহা” গ্রুপ। এরা আপনার লেখায় অপ্রাসঙ্গিকভাবে হাহা (হাসির ইমোজি ) রিয়েক্ট দেবে। কমেন্ট করে আপনাকে সরাসরি গালি দেবেনা, কিন্তু আপনার প্রতি প্রচ্ছন্ন তাচ্ছিল্য দেখাবে।
আপনি ধর্ষণ নিয়ে লিখেছেন, সেখানে হাহা। আপনি নারীর অর্গাজম নিয়ে কথা বলছেন, সেখানে হাহা। আপনি নারী স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলছেন সেখানে হাহা। আপনি নারীর প্রতি হওয়া ভয়ংকরতম নৃশংসতা নিয়ে লিখছেন, সেখানেও হাহা। নোংরা কথা বলবে না, কিন্তু আপনার লেখাটা যে হাস্যকর তা প্রমানের আপ্রাণ চেষ্টা থাকে এদের প্রতিক্রিয়ায়। অনেকটা ধরি মাছ না ছুঁই পানি অবস্থা।
এরা আসলে এই ইমোজি এবং এ ধরনের প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে আপনাকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে। অপমানের চেষ্টা করে। আপনার লেখাটা যে কী পরিমান ফালতু, তুচ্ছ তা বোঝানোর জন্য চেষ্টা করে। আপনার আত্মবিশ্বাস ভাঙার চেষ্টা করে যাতে ভবিষ্যতে আপনি এই ধরনের লেখা লিখতে সাহস না করেন।
এই গ্রুপের নারী আইডির অনেকগুলো কিন্তু আবার পুরুষ। তারা ফেক নারী আইডি বানিয়ে হাহা রিয়েক্ট দেয়। নারী আইডি নিয়ে এই কর্মটি করার কারণ আপনাকে বোঝানো যে আপনার লেখাটি আসলে নারীদেরও পছন্দ নয়। এটাও একটা কৌশল নারীকে দমন করার।
এদের আমার সোসিওপ্যাথ (sociopath) বলে মনে হয়। নারীর প্রতি এদের কোন সহমর্মিতা নেই। আদতে এদের কারো প্রতিই কোন সন্মান নেই।
ব্যক্তিগত জীবনেও আপনি এরকম অনেক দেখে থাকবেন। শিক্ষিত, আপাত ভদ্র। তাদের সাথে আপনি নারী বিষয়ক কোন কথা বলছেন, ভান ধরবে তারা আপনার কথা শুনছে, কিন্তু মাঝপথে আলটপকা এমন একটা মন্তব্য করবে বা অপ্রাসঙ্গিক একটা কথা বলবে যা শুনে আপনি বুঝবেন এই লোক এতক্ষন আপনার কথা শুনছিলোই না বা শুনলেও আপনার কথাগুলো তার কাছে খুব মূল্যহীন, তুচ্ছ লাগছে। ভদ্রভাবে অপমান করার এরচেয়ে ভালো উপায় আর কি আছে বলুন!
এরা আছে সব জায়গায়। আপনার আশেপাশে, অফিসে, ইউনিভার্সিটিতে, কলেজে। আপনার পোশাক, আপনার কাজের ধরন, আপনার জীবনযাপন, এসব কিছু নিয়েই তাদের মাথাব্যথা। আপনার ব্লাউজের গলা বড় না ছোট, আপনার শাড়ি পাতলা না ভারি, আপনার টপসটি আঁটোসাঁটো না ঢোলা, আপনার ছেলে বন্ধু আছে না নাই, আপনি রাত বিরাতে ঘর থেকে বের হন কি হন না এসব নিয়ে আপনাকে টিটকারির ছলে কথা শুনাতে চাইবে বা বাঁকা হাসি দিয়ে আপনাকে ছোট করতে চাইবে। ওই যে বললাম, সরাসরি কিছু বলবেনা, শুধু হাসি, তাকানো এবং উদ্ভট মন্তব্য করে আপনাকে খেলো করার চেষ্টা করবে।
চাইলে আপনি তর্ক করেত পারেন এদের সাথে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এদের খুব বেশি গুরত্ব না দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আপনি দাপটের সাথে লিখে যান যা লিখতে চান, যাপন করুন জীবন যেভাবে চান। এদের এই ফালতু সস্তা প্রচেষ্টা যেন আপনার আত্মবিশ্বাসে চিড় না ধরায় সে ব্যাপারে খেয়াল রাখুন।
আর এদের হাসতে হাসতে জ্বলতে জ্বলতে মরতে দিন।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]