কৃষাণীর শোক-তাপ, সমাজেরই চিত্র
লাবণী মণ্ডল।। গ্রামে আছি। দেশব্যাপী চলছে সাধারণ ছুটি। করোনা ভাইরাসের আক্রমণে বৈশ্বিক দুর্যোগ নেমে এসেছে। এর মধ্যেই কৃষক তার ফসল ঘরে তোলার জন্য মাঠে নেমে পড়েছেন। কৃষাণীও থেমে নেই। কখনও থেমে থাকেন না তারা। ঘরে বাইরে মাঠে ঘাটে সমানতালে কাজ করেন কৃষক নারীরা।
আবহাওয়া অফিস বলছে, আগাম বন্যার কথা। শঙ্কা রয়েছে মাঝারি বৃষ্টিপাতের। দুপুর গড়ালে প্রায় প্রতিদিনই আকাশ মেঘলা হয়ে আসে। বিভিন্ন জেলায় হচ্ছে শিলাবৃষ্টি। যা ফসলের জন্য ক্ষতিকর। ধানের ছড়া পড়ে যাবে। কৃষকের মাথায় হাত। করোনার আমলে বিভিন্ন জেলাশহর থেকে ধানশ্রমিকদের আসার কথা থাকলেও তারা আসতে পারছেন না। এ অবস্থায় কৃষক কৃষাণীরা পড়েছেন মহাবিপদে।
বলছিলাম, কৃষক নারীদের কথা। যাদের কোনো স্বীকৃতি নেই। নেই কোনো সামাজিক মর্যাদা। শ্রমের মূল্য তো নেই-ই। আমরা যারা নারীদের নিয়ে ভাবি, লিখি, সংগঠন গড়ে তুলি তারা কৃষক নারীদের জীবনচরিত্র নিয়েই ভেবে থাকি। কিন্তু সমাজ কি ভাবে এই কৃষক নারীদের জীবনযাপন নিয়ে?
আমাদের ঘরলাগোয়া ধানী জমিগুলোর ধান পেকেছে। বৈশাখ মাসের খরতাপ। রোজার মাস। ঘুম থেকে জেগেই দেখছি, কৃষাণীরা ধান কাটছে। মাথায় গামছা বাঁধা। শাড়ির আঁচল কোমরে বাঁধা। হাঁটুসমেত শাড়ি কাপড় তোলা।
আমাদের সিঁড়িতে বসেই জিরিয়ে নিচ্ছিলেন আমেনা বেগম। ফাঁক পেলাম কথা বলার। কাছে গিয়ে মুখোমুখি বসলাম। যেহেতু বাড়ির পাশে বাড়ি, সেহেতু একটা সম্পর্কও তো রয়েছেই। প্রশ্ন করলাম, সকালে কী নাস্তা বানিয়ে এসেছেন?
উনি অবাক হয়ে, বিরক্তির ভাব নিয়ে বললেন, নাস্তা না বানিয়ে আসব কেমনে! সকালে উঠে গরু ছাগল বের করেছি। গোয়ালঘর পরিষ্কার করেছি। উঠান বাড়িঘর ঝাড়ু দিয়েছি। ছোট পোলাডারে খাবার খাইয়ে দিয়েছি। তোমার কাকারে রুটি বানিয়ে দিয়েছি। অন্য সবার জন্য পান্না ভাতের খিঁচুড়ি রান্না করে তবে আসলাম ধান কাটতে!
– কয়টার সময় এসেছেন?
– সব কাজ সেরে সাড়ে সাতটায় ক্ষেতে এসেছি। আমি তো আবার রোজাও রেখেছি। রোদটা কড়া। আবার দুপুরে গিয়ে রান্না করব। গরু ছাগলের পানি দিব। খাওয়াব। আবার ক্ষেতে আসব। বন্যা হতে পারে দ্রুতই, ধান কাটতে হবে সন্ধ্যা নাগাদ। কোনোরকমে ইফতারটা বাড়িতে করব। তারপর ধানের আঁটি বারাইব। লাইটের আলোয়। আজকে কিছু ধানও সেদ্ধ করব। রাতের জন্য কিছু খাবার কইরা এরপর শুইতে যাব।
অবাক! তার দিকে তাকানোর মতো দুঃসাহস আমার নেই। এরপরও প্রশ্ন করলাম, এই যে এত কাজ করেন ক্লান্তি লাগে না, বিরক্তি লাগে না, একঘেয়েমি লাগে না, আবার তো কোনো শ্রমের মূল্য নেই!
উনি এবার বললেন, তুমি আমাকে প্রশ্ন করছো তো! আমি নাইন পর্যন্ত পড়েছি। রিডিং পড়া ভুলে গেছি। আর ক্লান্তি, বিরক্তি ওসবের বালাই নেই। ওসব ভেবে আমাদের লাভ কী! মাইয়া মানষের জীবনের কোনো মূল্য আছে (দুঃখ ভারাক্রান্ত হাসি)! এরপর তোমার কাকা বলবে, ‘তোর কাজটা কি? পোলাপান এত দুষ্টামী করে দেখে রাখিস না! রান্নার এত দেরি কেন? কয়ডা শাক তুইলা তো রানতে পারিস!’ শ্রমের মূল্য নেই। আমরা তো শ্রমই দেই না! উঠি আবার চিল্লাবে।
আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ক্ষেতের দিকে পা বাড়ালেন। ঘাম মুছলেন নাকি চোখের কোনে জমে থাকা পানি মুছলেন- তা বুঝে নিতে হবে।
তার চোখে মুখে অতৃপ্তির ছায়া। জীবনে কোনোদিন মনের ভাব ব্যক্তও করতে পারেননি। যা আমাদের ‘মা সমাজ’ পারেন না। তাদের কীসে ভালো লাগা, মন্দ লাগা, তাদের যৌনসুখের কোনো অনুভূতি নেই। আছে বাচ্চা বানানোর মেশিন। লালনপালন করা। বড় হলে সেই বাচ্চাদের দ্বারাই নির্যাতনের শিকার হওয়া। স্বামীর ইচ্ছেমতো নিজের শরীরকে বিলিয়ে দেওয়া- রাতের পর রাত। জীবনে এই একটা সুখের স্পর্শ তারা পাননি। কত নারীর অন্ধকার মুখ নিজের চিন্তার দর্পণে ক্ষণিকের মধ্যেই ভেসে উঠলো!
এ তো গেল নিজের ধান কাটা কৃষাণীর কথা। অন্যের জমিতে কামলা খেটে ধান কাটা নারীদের কথা বললে গা শিউরে উঠবে। সমাজের মুখে থু থু ছিটাতে ইচ্ছে করবে। ঘৃণাটা তীব্র থেকে তীব্র হবে। শ্রমিক নারীদের চেয়ে কোনো অংশেই এদের নির্যাতন কম নয়। একজন গার্মেন্টস শ্রমিক যেমন নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হন, একজন ধান কাটা নারী শ্রমিকেরও তাই হতে হয়।
আমাদের পাশের বাড়ির কাকী। উনি ডির্ভোসী। মেয়ে দুটিকে বিয়ে দিয়েছেন। একটা মেয়ে খাবারের অভাবে বিষ খেয়ে মারা গেছে। ছেলেটা ভাদাইম্মা। নেই বলতে কেউ-ই নেই। রোগ জরা শোক তাপ সব একার। কষ্টের কোনো রঙ নেই। জীবনের রঙ বহু আগেই ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। পরের জমিতে কামলা দেন। একজন পুরুষের চেয়ে কাজ বেশি করেন বলে তার তীব্র দাবি। পুরুষ শ্রমিক বিড়ি খাওয়ার কথা বলে আধাঘণ্টা কাটিয়ে দেন। কিন্তু উনি জিরান না। তারপরও পুরুষ শ্রমিকের মাইনে ৫০০ টাকা। উনার ৩০০ টাকা। তারপরও গেরস্তরা বলবে, কাজ শেষে দুই কুলা ধান ঝেড়ে দিও! এসব কারণে দু’দিন যাবত কাজে যাচ্ছেন না। রোজার মাস। কষ্টটা দ্বিগুণ। বৈশাখী খরতাপ।
শ্রমের মূল্য, নারী অধিকার, নারীর ভালো থাকা, নারীর চাহিদা- এসব নিয়ে তার কোনো চিন্তা নেই। ভাবনাও নেই। আছে যা, পেটের প্রয়োজনে কাজ করে খাওয়া। কারো দু’পয়সা মেরে না খাওয়া। কারো সাথে কোনো দুর্ব্যবহার না করা। জীবন বলতে একেই বুঝেন।
এরকম হাজার হাজার নারীর বর্ণনা এ লেখায় দেওয়া যাবে। প্রত্যক্ষভাবে মিশেছি এরকমও অনেক কৃষক নারীর জীবনচরিত তুলে ধরা যাবে। কিন্তু বর্ণনাতীত সব ঘটনা ‘বর্ণনা’য় নিয়ে আসাও কষ্টসাধ্য।
কথা হয়েছিল আরেক কৃষক নারীর সাথে। হাঁস পালেন উনি। মুরগীও রয়েছে। হাঁস যেহেতু ঝিনুক খায় সেহেতু তিনি সকালে উঠেই ঝিনুক তুলতে নদীতে নামেন। দুপুর গড়িয়ে আসলে বাড়ি ফিরেন। রান্না করেন। স্বামী বাচ্চাদের খাওয়ান। এরপর নিজের বর্গা নেওয়া ধান কাটতে যান নদীর পাড়ে। কাঁচা ধানই কাটছেন। বৃষ্টির ভয়ে। উনার স্বামী ভাটায় কাজ করেন। ধান কাটা, সংসার সামলানো, ঝিনুক তোলা সব উনার কাজ।
‘নারীদের আবার কোনো অনুভূতি আছে নাকি!’ বলে উপহাসের সুরে কথা বলেন। নিজেকে নিজেই ‘উপহাস’। এছাড়া উপায় কী!
আচ্ছা বলেন তো, এদের মধ্যে যদি সংগঠন গড়ে তুলতে চান তাহলে সেটা কতটা পরিশ্রমসাধ্য! এদেরকে জীবন-সংগ্রাম বুঝাতে গেলে নিজেকে যুক্ত করতে হবে ওই জীবনসংগ্রামে।
বড় বড় আর্টিকেল লিখে, টকশো করে, মিছিল মিটিং, নারী অধিকারের কথা বলে এদেরকে সচেতন করা যাবে? নাহ্! এদের কাছে আসতে হবে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর লেগে থাকতে হবে। আপনি যদি তার মনের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেন তাহলে জীবনের সকল জরা গ্লানি বলে দিয়ে হালকা হবে। কিন্তু সেরকম সংগঠন কই?
আগাম বন্যার কারণে ধান গোলায় উঠবে নাকি মাঠেই নষ্ট হবে- এই চিন্তায় ঘুম হারাম হয়ে গেছে কৃষকের। যে কারণে অন্য সব বছরের চেয়ে এ বছর কৃষাণীরা মাঠে বেশি। এর সাথে যুক্ত রয়েছে অন্যান্য জেলা থেকে কৃষক শ্রমিক না আসা। এর দায় বর্তেছে কৃষাণীদের উপর। এজন্য বলি, যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে নারীর উপর চাপটা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ থেকে দ্বিগুণ হয়।
বিবিএসের তথ্য অনুসারে- ‘৬৮ দশমিক ১ শতাংশ নারী কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু কাজের বিনিময়ে উপার্জন তো দূরের কথা রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি নেই নারীর। কারণ নারী আজও কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। জাতীয় কৃষি নীতিমালায় কৃষক হিসেবে নারীর অধিকারকে মূল্যায়ন করা হয়নি।’
কৃষক নারীদের শ্রমের মর্যাদার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলাটা জরুরি। তাদের মধ্যে সংগঠনের বিস্তার ঘটানো, সংগঠিত শক্তি যতটুকু আছে ততটুকু দিয়েই কাজ করানো। কিন্তু আমরা দেখতে পাই বিপ্লবী সংগঠনগুলোও কোনো না কোনোভাবে এদের প্রতি গুরুত্ব কম দেন। এটা কি সমাজব্যবস্থার ছাপ?
বাংলাদেশের কৃষিতে নারীর অবদান ৭০ শতাংশের বেশি। মাঠ পর্যায়ের কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ কম হলেও, পারিবারিক কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ শতভাগ। কৃষিখাতে নারীরা মজুরি বৈষম্য এবং নানা নিপীড়ন বঞ্চনার শিকার।
কৃষিতে কর্মরত নারীদের কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে, ভূমিতে নারী কৃষকের মালিকানা নিশ্চিত করতে হবে, সরকারি নীতিমালায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষী, বর্গা চাষী, নারী কৃষকের সংজ্ঞা থাকতে হবে, কৃষক নারীদের শ্রমের মর্যাদা দিতে হবে, শিক্ষার সুযোগ করে দিতে হবে, মানুষ হিসেবে যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে, সমাজ-রাষ্ট্র সম্পর্কে অবগত করার জন্য স্কুলিং ব্যবস্থা করতে হবে এবং বাজার ব্যবস্থায় নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে । এ কথাগুলো যখন বলি তখন একই সাথে পুরো সমাজব্যবস্থাকে পরিবর্তনের কথাও বলি। জোর দেই।
নারী কৃষক মর্জিনা বলেন, ‘আমরা কষ্ট করে পণ্য উৎপাদন করি। সামাজিক সমস্যার কারণে সেই পণ্য নিয়ে বাজারে যেতে পারি না। এছাড়া যারা পরিচালনা করে তারা সবাই পুরুষ। বাজারে সরাসরি জিনিস বিক্রি করতে না পারায়, নায্যমূল্য পাচ্ছি না।’ নারীরা যাতে নিজেরা পণ্য বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে পারেন সে সুযোগ সৃষ্টি রাষ্ট্রকেই করতে হবে। সবকিছু গুছিয়ে দেবে নারী আর মাতব্বরীটা করবেন সমাজের পুরুষ- এটাই নিয়ম হয়ে এসেছে। যুগের পর যুগ। কিন্তু এ প্রচলিত নিয়ম – ‘মেনে নাও, মানিয়ে নাও’ থেকে নারীকে বের হয়ে আসতে হবে।
যেখানে শতকরা ৭০ ভাগের বেশি নারী কৃষিতে অবদান রাখেন সেখানে তাদের কোনো ‘মর্যাদাবোধ’ থাকবে না। এটা হতে পারে না। হতে দেওয়া যায় না। পুরুষতান্ত্রিক ভোগতান্ত্রিক পুঁজিতান্ত্রিক সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এগুলো ঘটতে থাকবে এটা যেমন সত্য কথা। ঠিক তেমনি সত্য হলো, এর থেকে পরিত্রাণের ব্যবস্থা করতে হবে। সংগঠিত শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। নারীবান্ধব সরকার ‘নারীদের’ সব মর্যাদা দিয়ে ফেলেছে বলে যারা গলা ফাটান তারা দয়া করে এই কৃষক নারী, শ্রমিক নারীদের জীবন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান নেবেন। ‘নারীমুক্তি’ বলতে সামগ্রিকভাবে মানবমুক্তি। প্রকৃতপক্ষে মানুষের পৃথিবী হলেই একমাত্র ‘নারীমুক্তি’ সম্ভব। আর সে দাবিই আমরা করে যাচ্ছি কৃষক শ্রমিক নারীদের সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার দায় নিচ্ছি।
লাবণী মণ্ডল: সহ-আহ্বায়ক : বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন, সংগঠক : বিপ্লবী নারী মুক্তি
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব মতামত]