September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

মা মানে কি মাতৃত্বের শেকল প’রে থাকা?

শেখ সিরাজুম মুনিরা নীরা।। যদি আমার সবচেয়ে পছন্দের মুহূর্তগুলোর তালিকা করতে বলেন, তাহলে নিঃসন্দেহে এর প্রথমে থাকবে উপুড় হয়ে থাকা! মানে আক্ষরিক অর্থে উপুড় হয়ে বই পড়তে, সিনেমা দেখতে বা ঘুমাতে ভালোবাসি আমি। ছোটবেলা থেকে মা খালাদের বহু বকাবকিও আমার উপুড় হয়ে ঘুমানোর অভ্যাস বদলাতে পারেনি।

সেই আমি পুরো সোজা হয়ে গেলাম।  যখন জানতে পারলাম আমি গর্ভধারণ করেছি।

প্রথম কয়দিন তো হাঁটতেই ভয় পেতাম! সবচেয়ে বিপদে পড়লাম ঘুমের সময়। আমার তো সোজা হয়ে শুয়ে থাকলে জীবনেও ঘুম আসবে না। কী যে কষ্টে গেছে প্রথম কয়েকমাস।  তখন শুধু মনে হতো নয়টা মাস পেরোলেই বাঁচি, আবার আরাম করে ঘুমাতে পারবো।

সেই সময়ও আমি জানি না, মাতৃত্ব কেবল আমার ঘুমের অভ্যাসই বদলে দেবে না, বদলে যাবে আরও বহুকিছু।

শুধু আমার কেন, দুনিয়ার তাবৎ মেয়েদেরই দুনিয়াটা উল্টেপাল্টে যায় মা হওয়ার পর।  আর যদি বেবি ব্লুজের কবলে পড়েন, তাহলে তো কথাই নেই।  আমি শুধু ভাবি, আমার মায়ের কথা।  ঘরকন্না সামলানো মা আমার গোটা জীবন বেঁচেছেন কেবল আমাদের দুই বোনের জন্য।  নিজের পছন্দের মাছের টুকরোটা, পছন্দের সবজিটা অনায়াসে তুলে দিয়েছেন আমাদের পাতে।  অন্তত আমাদের দুবোনের জন্মের পর নিজের জন্য আম্মু একদিনও বেঁচেছে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তার কাছে মাতৃত্ব এমনই।

আমার কাছে মাতৃত্ব মানে ঠিক এরকম না। আমি মা হয়েছি ঠিকই, তবে চেষ্টা করেছি এমন কোনো মুহূর্ত তৈরি না করত যার জন্য সন্তান আমার কাছে বোঝা মনে হয়।  মা হওয়ার আগেও প্রচুর আড্ডা দিতাম, এখনও দিই, পরিমানে হয়ত কমেছে, কিন্তু অভ্যাস বা শখটা বাদ দিয়ে দেইনি।  আর যেহেতু আমি মায়ের সঙ্গে থাকি, তাই সেটা করার সুবিধা আমি পেয়েছি।

যদিও আমার নিজের মা-ই বিষয়টা তেমন পছন্দ করেন না। তার যুক্তি হলো, বাচ্চাটা সারাদিন মা বাবার পথ চেয়ে থাকে।  সেখানে কীভাবে আমি অফিস শেষে বাসায় না ফিরে অন্য কোথাও যাই! কিন্তু আমি জানি, শুধু অফিস আর বাসা করলে আমি মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে যাবো। বন্ধু বা প্রিয়জনদের সঙ্গ আমার মনকে আরাম দেয়। এ কারণে সুযোগ মিললেই আমি আর আমার ছেলের বাবা নাটক বা সিনেমা দেখতে চলে যেতাম অফিসের পর।  তারপর একটু কফি বা ফুচকা খাওয়া। জাগতিক সব কিছু ভুলে নিজেদের জন্য একটু সময় তো বের করাই লাগে, তাই না?

মাতৃত্ব মানে কিন্তু নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলা না।  অবশ্য আমার আম্মু তার মাতৃত্বে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। এতোদিন আমাদের মানুষ করেছেন, এখন আমার সন্তানকে বড় করছেন। তিনি না থাকলে আমার এমন মাতৃত্ব উদযাপন করা অসম্ভব ছিল।  স্নেহ নিম্নগামী, এই উদাহরণ দেখতে আমাদের বাসায় আসলেই চলবে। যে কাজগুলোর জন্য আমি বা আমার বোন বকা খেয়েছি সেগুলো আমার বাচ্চার জন্য দুষ্টুমি। আমি এসএসসি পরীক্ষার সময় চা পানের অনুমতি পেয়েছিলাম। আর আমার সন্তানকে তার নানী চা দিয়ে মুড়ি ভিজিয়ে খাওয়ায়! মাতৃত্বের এমন চেহারাও হয়। যখন আকাশকুসুম ভাবি, তখন মনে মনে ঠিক করি, আমার ছেলের যে স্ত্রী হবে, তার চাকরির জন্য বা তার জীবনের সুবিধার জন্য আমি বেঁচে থাকলে এটুক সুবিধা দেবো। যেন প্রয়োজনে আমার কাছে বাচ্চা রেখে সে তার জীবনটুকু উপভোগ করতে পারে।

অনেকেই আছেন একা থাকেন, পরিবারের বড়রা কেউ সঙ্গে থাকেন না, তাদের জন্য বিষয়টা বেশ কঠিন।  আমার ছোটবোন দেশের বাইরে থাকে। যেটুকু সময় ও বাসায় একা থাকে সে সময়টুকুতে বাথরুমে যাওয়াও সম্ভব হয়ে ওঠে না, অন্য কাজ তো দূরে থাক। তবে এর মধ্যেও সে নিজের জন্য সময় বের করে নেয়। হয়ত বাচ্চাকে বাপের কাছে দিয়ে গ্রোসারি করতে বের হলো, কিংবা বুকের দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে মোবাইলে বা কিন্ডেলে একটা উপন্যাসের পিডিএফ কপি পড়ে ফেললো।

এভাবে সবাইকেই নিজের মাতৃত্বকে নিজের ছাঁচে গড়ে নিতে হয়। নাহলে ওই যে বললাম, বেবি ব্লুজ পেয়ে বসে। আর সেটা হলে কেমন লাগে তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন।

আমার ছেলের যখন সাড়ে তিনমাস বয়স তখন আমি ছুটি শেষে অফিসে যোগ দিই। কষ্ট হয়েছিল, বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জানেন? কোথাও একটা স্বাধীনতার স্বাদ ছিল। সাড়ে তিনমাস পর ডায়াপার, ফিডার, গরম পানি ঠান্ডা পানি, ওয়াইপস, কাঁথা, ন্যাপি র‌্যাশ ক্রিমের টেনশন ছাড়া বাইরে বেরিয়েছিলাম আমি। সেই মুহূর্তে সেটাও কম ছিল না।

আমার ছেলেকে যখন ডিম খাওয়াই, আমার যদি খেতে ইচ্ছা করে তাহলে নিজেও একটা করে খেয়ে নিই। কিন্তু আমার আম্মু হলে সেটা কখনোই করতেন না। তিনি আরেকটা ডিমও তার সন্তানের জন্য বাঁচিয়ে রাখতেন। আর এসব করে করে, নিজের শরীরটার বারোটা বাজিয়েছেন। তাই আমি ওপথে যাই না। হ্যাঁ, তবে এটাও ঠিক, ঘরে যদি একটা ডিম থাকে তাহলে সেটা সন্তানের জন্যই রেখে দিই, তখন আর নিজের খেতে ইচ্ছা করে না। মাতৃত্ব এটুক তো দাবি করেই, কী বলেন?

আমাদের দেশে মাতৃত্বটাকে অনেক বেশি কঠিন করে ফেলা হয়। সন্তান লালনকে পুরোপুরি মায়ের অধীন বলে ধরে নেওয়া হয়। অথচ, যখন বংশের কথা আসে, নামের কথা আসে তখন সেটা বাবার হয়ে যায়।

আমার মনে হয়, সমাজই বাবাকে সন্তান থেকে দূরে রাখে, সারাক্ষণ কানে মন্ত্রণা দেয় যে, বাচ্চাপালা মায়ের কাজ। সে কারণে বাবারাও ওই কাজে আগ্রহী হন না।

আমার সন্তানের বাবা আবার বেশ ব্যতিক্রম। সে সন্তানের সঙ্গে জড়িত যাবতীয় কাজ করতে পারে।  কেবল রান্নায় পারদর্শী নয় বলে ওইদিকে তার কাজ রাখি না।  এছাড়া বাচ্চাকে গোসল করানো, ন্যাপি পরিস্কার, বাচ্চার কাপড় ধোয়া, ফিডার পরিস্কার করা, ঘুম পাড়ানো, গল্প বলা, বই পড়ে শোনানো, ছবি আঁকা এসবই সে আমার চেয়ে বেশি দক্ষতার সঙ্গে করে। ও বাচ্চার সঙ্গ উপভোগ করে। ওকে দেখে বুঝি, চাইলেই বাবারা সন্তানের সঙ্গে এমন সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন। তাহলে মায়েরও কষ্ট লাঘব হয়, সন্তান যে দুজনের সে বিষয়টাও ন্যায্যতা পায়।

আমি মাঝে মাঝেই ভাবি, এই যে আমার সন্তান, সে তো এই দেশেরও সন্তান। সে যদি যথাযথভাবে বড় হয়ে উঠতে পারে, তাহলে এই দেশকেই তো যা দেওয়ার দেবে। দেশের মানুষ তাকে নিয়ে গর্ব করবে। অথচ ওর বেড়ে ওঠায় এই দেশ বা রাষ্ট্র বা সমাজ, কতটুকু ভূমিকা রাখে?

আমার গোটা নয় মাসের গর্ভাবস্থায় রাষ্ট্র বাসে একটা সিটের ব্যবস্থা করে দিতে পারেনি, ছয়মাস মাতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা করতে পারেনি, ছোটবাচ্চাকে কাছাকাছি রেখে অফিস করার ব্যবস্থা করতে পারেনি, পাবলিক প্লেসে ডায়াপার পরিবর্তনের জায়গা করে দিতে পারেনি, একটা দূষণমুক্ত বাতাসের শহর দিতে পারেনি। তাহলে যদি আমার ছেলে বড় কিছু অর্জন করে, সেটা কেন রাষ্ট্রের গৌরব হবে?

মজার ব্যাপার হলো, যুগ যুগ ধরে মাতৃত্বের ভার লাঘব করতে এই সমাজ বা রাষ্ট্র কিছুই করেনি। এখন স্রোতে গা ভাসিয়ে মা দিবস পালন করে, বড় বড় বুলি ছাড়ে। কিন্তু সেই বুলি আদতে মাতৃত্বের কোনো কাজে লাগে না।

 

ফিচার ছবি: লেখক শেখ সিরাজুম মুনিরা নীরা ও তার সন্তান উজান

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব মতামত]

লেখকের অন্য লেখা: কীভাবে আমার ছেলেকে ‘পুরুষ’ নয়, মানুষ করে গড়ছি!