November 2, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

থাপ্পড় খাবেন আর একটু মানিয়ে চলবেন, কিন্তু কেন?

সাবিহা ইশরাত জাহান স্টেলা।। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক স্ট্রীমিং সাইটে মুক্তি পাওয়া একটি বলিউড ছবি ও সেটিকে কেন্দ্র করে কতিপয় বঙ্গ সন্তানের তড়পানি পর্যবেক্ষণের পরই কিছু কথা ভাগাভাগি করে নিতে বসলাম। প্রথমেই দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, এই বঙ্গ সন্তানদের মাঝে পুং লিঙ্গের পাশাপাশি তালিকার ওপরের দিকে স্ত্রী লিঙ্গের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। সে যাকগে, চলুন আগে জেনে নিই ছবিটির কাহিনী সংক্ষেপ।

ছবির নাম ‘থাপ্পাড়’, বাংলা করে চড়, থাপ্পড় বা চটকানি যাই বলুন না কেন। তো ঘটনা হচ্ছে, সুখেই দিন কাটছিলো হোমমেকার বা গৃহিনী অমৃতার। স্বামী শাশুড়ি নিয়ে স্বচ্ছল পরিবার। স্বামী বিক্রমের জীবন নিরবিচ্ছিন্ন রাখতে ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি ভারি ব্যস্ত থাকে সে। এ পর্যন্ত দর্শকও ভীষণ খুশি ছিল। কি ভালো মেয়ে দ্যাখো সবাই। দেহ মন মস্তিষ্কে শুধু স্বামী আর স্বামী। আমারো আপত্তি ছিলো না মোটেও। কে কীভাবে জীবনকে দেখবে এ তো তার নিজস্ব ব্যাপার। এরপরই হলো কি, নিজের কাজের চাপ সামলাতে না পেরে ভরা মজলিসে, নিজ বাড়িতে চলমান পার্টির মধ্যে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ঠাস করে বিক্রম চড় মেরে বসে অমৃতাকে। ঘুরে যায় কাহিনীর মোড়। একদম চুপ হয়ে যায় অমৃতা। এক পর্যায়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাপের বাড়ি যায় এবং সিদ্ধান্ত নেয় ডিভোর্সের। কারণ, শুধু ওই একটি থাপ্পড়।

নিজের চাইতে অন্যের বুঝ বেশি বোঝার দল তাকে হাজার বলেও ফেরাতে পারেনা। এমনকি, আইনজীবীও নন। বহু হ্যাপা পোহাতে হবে জানালেও ডিভোর্স সে দেবেই এবং দেয়ও। তার ওই একটিই যুক্তি, একটি থাপ্পড় সে কোনভাবেই মেনে নেবেনা। স্বামীর বোধদয় হলেও। কারণ এর সাথেই তার ভালোবাসা পুরোপুরি চলে গেছে।

আর ঠিক এইখানটাতেই আপত্তি বঙ্গ সমাজের দর্শককুলের। বাংলাদেশি কতিপয় মুভি রিভিউ পেজ, যা ফেসবুকে পরিচালিত হয়, সেই মারফত এটি প্রিমিয়ারের পর থেকে যেসব মন্তব্য জানা যায় তার কিছু বিবরণ ও এহেন মানসিকতার জন্য সম্ভাব্য কারণ বের করতে চেষ্টা করলাম আমার স্বল্প জ্ঞানের বদৌলতে।

আলোচিত মন্তব্যের একটি- সিনেমাটি একটি নৌটংকি বই আর কিছু না। নারীবাদকে উস্কে দেয়া ছাড়া আর কোন কাজ নেই বলিউডের গে পরিচালকদের। উল্লেখ্য যে, ছবির পরিচালক একজন পুরুষ। বোঝাই যাচ্ছে, বহু বছর ধরে চলে আসা বস্তাপঁচা সামাজিক নিয়মের উপযুক্ত এই ফসলটির দাবি কোন মতেই অগ্রহণযোগ্য নয়। হয়তো বাড়ি ফিরে বাবাকে বরাবরই দেখেছেন মায়ের দেহটিকে তুলোধুনো করতে। আবার সেই মা পরবর্তীতে নিজের ঝাল মেটান ছেলের বউকে কোনঠাসা করে।

একটি মন্তব্য এমন ছিল যে, গুরুজনেরা শাসন করলে আপত্তি নেই, সেখানে স্বামী না হয় ঝোঁকের মাথায় হঠাৎ করে একটু মেরেই বসেছে। এসব দেখালে তো কারো বিয়ে আর টিকিয়ে রাখা যাবে না।

আসলে উনারও দোষ খুব একটা নেই। আমাদের চোখ তো মেয়েদের আইটেম নাম্বারে দেখে দেখে কবেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ও হ্যাঁ, এই মন্তব্যটিতে সায় এসেছে মেয়েদের পক্ষ থেকেও। হয়তো ঘেটে দেখলো জানা যেতো উনি হাসবেন্ডকে কর্তা ডাকতে খুব ভালোবাসেন। আর কর্তার ইচ্ছায়ই তো কর্ম। নিশ্চয় সেই মতই চলেন। বহু সার্টিফিকেটসম্পন্ন এবং নিজে উপার্জন করেও নিজের পায়ে কোন দিনই দাঁড়াতে পারেননি, এমন অনেক মহিলা চারপাশে বিদ্যমান। যারা পুরুষতন্ত্রকে দিনকে দিন শক্তিশালী করে চলেছেন। মদদ দিচ্ছেন ‘ভালো মেয়ে’ সংজ্ঞায়িত করার পুরুষালি ব্যাখ্যায় খুব জোরেশোরে। তাদের কাছ থেকে এর চাইতে আর কী বা আশা করার আছে!

অনেক নারী এই ছবির রিভিউতে গল্পের সমর্থনে মুখ খুলে বিপাকে পড়ছেন। তাদের প্রোফাইল ঘেঁটে পুরুষতন্ত্রের সবচে’ দুর্বল অস্ত্র অন্তত আমার হিসেবে, মেয়েটির কাপড়চোপর বা লাইফস্টাইল নিয়ে শুরু হয় ঘাঁটাঘাটি। এমনও বলা হয়, যে স্বামীর কাছ থেকে প্যাড কেনার টাকা নেয়া যায় সে একটু (!) মারলে কী এমন হয় যে ডিভোর্স পর্যন্ত গড়াতে হবে?

আচ্ছা এই ‘একটু’ মার কতটুকু? কত হাল্কা হলে বলা যায় ‘একটু’?

কিন্তু নারী পুরুষ নির্বিশেষ এসবই কেন যেন বেশ স্বাভাবিক ঘটনা মনে হয়। বীরদর্পে অনেক মা গলা ফাটান এই বলে যে, ছেলেরা তো একটু বাইরে যাবেই। মেয়েরা সন্ধ্যায় বাসায় ফিরবে, এটাই স্বাভাবিক। অনেক মেয়ে চিল চিৎকার জুড়ে দেন অফিসে নিজ যোগ্যতায় পদোন্নতি পাওয়া মেয়ে সহকর্মীর রহস্যময় গল্প নিয়ে। এরা বাপ  ভাইয়ের রাগের বর্ণনাও সগর্বে দিয়ে থাকেন।

সিনেমার গল্প অনুযায়ী অমৃতার ডিভোর্সের কারণ উপলব্ধির পর বদলে যায় আরো কয়েকটি জীবন। অবশ্যই ইতিবাচক অর্থে। সোকল্ড মুভিপ্রেমীরা মেনে নিতে পারেন নি সেটুকুও। তাদের ভাষ্যে, এই তো! এভাবেই তো প্রতিবাদী মেয়েদের জন্য গোটা শহর রসাতলে যায়।

আবার সেই ‘একটু’ প্রসঙ্গে আসি। কেন যে মেয়েরা ‘একটু’ মানিয়ে নিতে পারে না? ইশ্, যারা থাপ্পাড় দেখে এসব বলছেন, তারা বলুন তো কতোগুলো একটু জোড়া দিলে আপনার ‘একটু’ বোধোদয় হবে? একটু একটু করে এভাবেই তো শত কোটি বছর ধরে নিজেই নিজেকে আরো হাজার কোটি বছর দূরে ঠেলে দিচ্ছেন। অবশ্য আপনাদের মনে হয় আপত্তি নেই এভাবে থাকতে। থাকুন তবে, আমি বলার কে! কিন্তু নারীবাদ নিয়ে তবে কেন এতো আপত্তি হে বিচক্ষণ নারীকুল? নারীবাদে আপত্তিসম্পন্ন নারী যে দলে কম ভারি নয়। তারা নিজেরা শুধু চড় নয় লাথিও খাবে কিন্তু পুরুষতন্ত্রের প্রোটিন হয়ে টিকে থাকবেন তেলাপোকার মতো।

এটা সিনেমান কোন সমালোচনামূলক লেখা নয়। আবার শুধু দেশি দর্শকের মন্তব্য দেখে বলা মানে এই নয় যে ভিনদেশি বা প্রতিবেশী দেশের দর্শকের মন্তব্য একটু ভিন্ন হবে। তাহলে হয়তো ধর্ষণের আইন নিয়ে রাজপথ গরম করতে হত না তাদের। কিন্তু নতুন প্রজন্মের জন্য বলতে পারি, সময় এসেছে ‘একটু’ বোধোদয়ের। হতেই পারেন আপনি হোমমেকার বা গৃহিনী, ইচ্ছেটা একান্তই আপনার, কিন্তু তাই বলে যে থাপ্পড় খেয়ে যাবেন এবং এ নিয়ে প্রতিবাদী ছবি, গল্প, কবিতা, নাটক হলে নিজে পারছেন না বলে সেগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন, তবে আপনার অবস্থার কখনোই উন্নতি হবে না বইকি!

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]