September 20, 2024
সাহিত্যগল্পফিচার ৩

সত্যি গল্প

কিশোয়ার জাবীন।।

২২শে ফেব্রুয়ারি, বিকাল ৪টা

সবুজ রঙ (বিশেষ করে টিয়াপাখির মতো রঙ) আমার একদম পছন্দ না। যখনি পূর্বাকে টিয়া সবুজ রঙের শাড়ি পরে রিকশা থেকে নামতে দেখলাম, মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। আজ ২২শে ফেব্রুয়ারি, অনেকদিন পর পূর্বার সাথে দেখা হবে।

আমাদের বইমেলায় যাওয়ার কথা। আমি ওর জন্য অপেক্ষা করছি টিএসসি’র ওয়ালের উপর বসে। আমার চারপাশে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষ। এতো মানুষ আমার ভালো লাগে না। মনে হচ্ছে, ঢাকা শহরের সব মানুষ রঙবেরঙের কাপড় পরে এখানে ঘুরতে এসেছে।
তার উপর প্রচন্ড গরম। গরম আমি একদম সহ্য করতে পারি না। সব মিলে মেজাজ খারাপ লাগছিল; তার সাথে যোগ হলো পূর্বার টিয়া সবুজ রঙের শাড়ি। মুহূর্তের মধ্যে মেজাজ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল।

পূর্বা আমার সামনে এসে বলল, “তুমি ওইখানে বসে আইসক্রিম খাচ্ছো কেন? তুমি কি বাচ্চা ছেলে যে ওয়ালের উপর বসে আইসক্রিম খাচ্ছো?”

মেজাজ টা কেমন লাগে? আমি জানি আমি বাচ্চা ছেলে না, আমার বয়স ৪২। কিন্তু কোন আইনে কি লেখা আছে যে ৪২ বছরের একজন মানুষ ওয়ালের উপর বসে আইসক্রিম খেতে পারবে না?
আমি ওর কথার উত্তর না দিয়ে ওয়াল থেকে নামলাম।
জিজ্ঞাসা করলাম, “এখনই কি মেলায় ঢুকবা?” মহারাণি একটা ভ্রুকুটি দিয়ে বললেন, “না তো, এখন আমরা রিকশায় ঘুরবো।”
মেজাজটা একটু ভালো হলো। যাক্, অন্তত কিছুক্ষণ বাতাস খাওয়া যাবে। পূর্বার হাতটাও ধরা যাবে।

রিকশায় এলোমেলো ঘুরছি আমরা। আমি ধরে আছি পূর্বার একটা হাত । হাত ভর্তি লাল চুড়ি। টিয়া রঙের শাড়ির সাথে লাল চুড়ি যে এতো সুন্দর লাগতে পারে, আমি জানতাম না। খুব ইচ্ছে করছে আরেক হাত দিয়ে ওর কোমরটা ধরি। ও রেগে যাবে, এই ভয়ে ধরতে পারছি না। পূর্বা বেশি কথা বলছে না, আমিই সমানে বকবক করে যাচ্ছি। ও মুখে একটু প্রশ্রয়ের হাসি ধরে রেখে আমার কথা শুনছে, মাঝে মাঝে হাসছে, কখনো সায় দিচ্ছে, কখনো আবার বলছে, “না অর্ণব, তোমার এই কথাটা ঠিক না।”
আমি তো জানি, আমার কোন কথাটা ঠিক আর কোন কথা ঠিক না। আমি কথা বলছি আমার অস্থিরতা লুকানোর জন্য।

হঠাৎ খেয়াল করলাম, আশেপাশের অধিকাংশ মানুষ আমাদেরকে লক্ষ্য করছে। আমাদেরকে না, লক্ষ্য করছে পূর্বাকে। কোন মানে হয়? এমন হা করে দেখার মতো সুন্দরী ও না। তবুও, কেন যে মানুষ ওর দিকে এভাবে তাকায়, আমি বুঝি না। আজকে মনে হচ্ছে ও নয়, ওর টিয়া রঙের শাড়িটা মানুষের চোখে পড়ছে বেশি। আমার মেজাজ আবার খারাপ হতে শুরু করেছে। কোন মানে হয় এমন বিদঘুটে রঙের শাড়ি পরার?

———————————————————————

পূর্বার সাথে আমার প্রথম দেখা হয় শাহবাগের বড় পাঠক সমাবেশে। ও একটা চেয়ারে বসে বই পড়ছিল। ফিকে নীল শাড়ি, মোটা চশমা ও লম্বা বেনীতে ওকে খুব সাদামাটা লেগেছিল প্রথম দেখায়। কোথাও বসার জায়গা না পেয়ে ওর টেবিলে এসে বললাম, ” কিছু মনে না করলে, আমি কি এইখানে বসতে পারি?”
পূর্বা চোখ তুলে তাকালো আমার দিকে।
মনে হলো এরকম অপার্থিব চোখ আমি কখনো দেখিনি।
মনে হলো, বর্ষার সমস্ত মেঘ জড়ো হয়েছে ওর চোখে; এখনি নামবে বৃষ্টি হয়ে।
মনে হল এমন চোখেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সর্বনাশ দেখেছিলেন।
পূর্বার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি ওর প্রেমে পড়ে গেলাম।

সেদিন কথোপকথন আগাচ্ছিলো আমার আগ্রহেই। কোথায় থাকেন, কী করেন এইসব কথার মধ্য দিয়ে ওর ফোন নাম্বার নেওয়ার জন্য আমি তখন মরিয়া। কিন্তু পূর্বা, আমার সাথে কথা বলতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাচ্ছিল না। সে আপন মনে দি এসেনশিয়াল রুমি পড়ে যাচ্ছিল। আর আমি ওর উল্টাদিকের চেয়ারে বসে উশখুশ্ করছি; মানুষটা চলে যাওয়ার আগে ওর ফোন নাম্বারটা কীভাবে নেওয়া যায়, সেই চিন্তা করে।
হঠাৎ মাথায় একটা বদবুদ্ধি ঢুকলো। নিতান্ত ভদ্রলোকের মত ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার কি রুমি খুব পছন্দ?”
মেঘভরা চোখে হেসে ও বললো, “জ্বি।”

ওর হাসি দেখে মনে হলো, ঘন কালো মেঘের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো এক ঝলক রোদের আলো। আমি বললাম, “আমার কাছে দি এসেনশিয়াল রুমির প্রথম এডিশন টা আছে। আপনি চাইলে ধার নিতে পারেন।”
হাসিটা পূর্বার ঠোঁটের কোণ থেকে সারামুখে ছড়িয়ে পড়ল। ও বললো, “সত্যি প্রথম এডিশনটা আছে?” আমি বললাম, “না থাকলে বলবো কেন? আপনার ফোন নাম্বারটা দিন, বইটা আপনাকে ধার দেব।” ও বললো, “ধার দেওয়া লাগবে না। আমি শুধু একটু দেখবো, তাইলেই হবে।”
বুঝলাম, ও খুব সচেতনভাবে ফোন নাম্বার দেওয়াটা এড়িয়ে গেল।
আমি গম্ভীর মুখ করে বললাম, “কোথায় কবে দেখতে চান বলুন, নিয়ে আসব।”
একটা কফিশপের ঠিকানা দিয়ে ও বললো, “রবিবার বিকাল ৫টায় আমি এখানে থাকব।”
খুশিতে আমার চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হল।
কারন, ঠিক সময়ে জায়গামতো গেলেই, ওকে আমি আবার দেখতে পাব।

নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দেখি, বাসন্তি রঙের শাড়ি, লম্বা হাতার গাঢ় নীল ব্লাউজ, মোটা বেনী কাঁধের উপর দিয়ে সামনে এনে, এক কাপ কালো কফি নিয়ে, বসে আছে পূর্বা।
আবার সেই চোখ, সেই হাসি! আমার মাথার ভিতর গন্ডগোল হয়ে গেল !
আমি ধীরপায়ে গিয়ে বসলাম ওর উল্টাদিকের চেয়ারে। আমার হাতে কোনো বই নেই, আছে একটা খাম। সেই খামের ভিতরের চিঠিতে লেখা আছে, দি এসেনশিয়াল রুমির প্রথম এডিশন কেন, কোন এডিশনই আমার কাছে নেই। শুধুমাত্র ওর সাথে দেখা করার জন্য আমি মিথ্যা কথাটা বলেছি।
চিঠিটা পড়ে, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ বসে থাকল পূর্বা। একবার আমার দিকে তাকালো পূর্ণদৃষ্টি মেলে; তারপর ওয়েটারকে বলল বিল দিতে। ওর সামনে নিজেকে কেমন কেঁচোর মতো লাগছিল; মনে হচ্ছিল মাটির ভিতর ঢুকে যাই। কিন্তু আমি তখন মরিয়া। বুঝতে পারছি আজকের পর ওকে আমি আর কখনো দেখতে পাবো না।
টেবিলের উপর ওর ফোনটা রাখা ছিল। খপ্ করে ওটা নিয়ে আমার পকেটে ঢুকিয়ে ফেললাম।
ও রেগে গিয়ে বলল, “কি করছেন এসব! আমার ফোন নিলেন কেনো?”
আমি বললাম, “আপনি যতোক্ষণ আমার কথা না শুনবেন, ততোক্ষণ আমি ফোন দেব না।”
ও আরো রেগে গিয়ে বললো, “এসব কি ছেলেমানুষী করছেন!”
আমি বললাম, “ছেলেমানুষরা তো ছেলেমানুষীই করবে।”
অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে পূর্বা বললো, “আপনি তো দেখছি মহা ফাজিল। ফোন দিন, নয়তো ম্যানেজারকে ডাকব।”
উত্তরে বললাম, “ম্যানেজার আসলে বলব, আপনি আমার বান্ধবী, আপনার রাগ ভাঙ্গানোর জন্য ফোন নিয়েছি।”
এবার হেসে ফেলে পূর্বা বলল, “অদ্ভুত মানুষ তো; বলুন কি বলতে চান।”
উত্তরে বললাম, “আমি আপনার বন্ধু হতে চাই।”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ও বলল, “আমার চেহারায় কি ‘বন্ধু চাই’ বিজ্ঞাপন দেওয়া আছে?”

———————————————————————

বিজ্ঞাপন থাকুক আর না থাকুক, পূর্বার সাথে আমার খুব সুন্দর একটা সম্পর্ক তৈরি হলো। আমার তরফ থেকে অনুভূতিটা প্রথম থেকেই ছিল বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি কিছু। ও বন্ধুত্বের গণ্ডি পাড় হতে সময় নিয়েছিল বেশ কিছুটা।

আমার বিবাহিত জীবনে একটু ঝামেলা আছে। আমি মায়ের একমাত্র সন্তান। আফরাকে বিয়ের আগেই বলেছিলাম, বাবা মা’কে রেখে আলাদা সংসার আমি করব না। আমার শর্তে রাজি হয়েই আফরা বিয়েতে মত দিয়েছিল।
কিন্তু আমাদের বাচ্চাটা হওয়ার পর থেকে আফরার আস্তে আস্তে পরিবর্তন আসতে থাকে। ও চাইতো, আমার মা তাঁর স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে নাতনির দায়িত্ব নেবেন; তাতে করে আফরা নিশ্চিন্তে অফিস করতে পারবে।
কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই আমার স্বাধীনচেতা মা চাকরি ছাড়তে রাজি নন। তাঁর বক্তব্য হলো, তিনি স্কুল থেকে ফিরে নাতনির দেখভাল করবেন। আর আফরার বক্তব্য হলো, “আপনার ছেলে ও ছেলের বউ যথেষ্ট টাকা কামাই করে। আপনার চাকরি করার দরকার কী?”
একজন চাকরিজীবী মহিলা হয়ে আর একজন চাকরিজীবী মহিলার প্রতি আফরার এই মানুষিকতা আমার কাছে খুব স্বার্থপরের মতো লাগত।
যাইহোক, অশান্তির শুরু তখন থেকে। আস্তে আস্তে তার পরিধি বাড়তে থাকে। আমি বাবা মা কে ছেড়ে আলাদা হব না; মাও চাকরি ছাড়বেন না; আফরা আমার মাকে নিয়ে অভিযোগ করা বন্ধ করবে না- এমনই একটা অদ্ভুত পরিস্থিতিতে আমার জীবনের শান্তি, স্বস্তি সব উবে যাচ্ছিল।

এ রকম একটা সময়ই আমার পরিচয় হয় পূর্বার সাথে।

বিবাহিত জীবনে মোটামুটি সুখি পূর্বা দুই সন্তানের জননী। আমার জীবনে পূর্বার এবং পূর্বার জীবনে আমার অস্তিত্বের কোনো যৌক্তিকতাই নেই। কিন্তু পৃথিবীতে সবকিছু কি যুক্তি মেনে চলে? একজন বিবাহিত নারী অথবা পুরুষ কখন কোন্ পরিস্থিতিতে নিজের সঙ্গী ছেড়ে অন্য একজন বিবাহিত নারী বা পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হয় তার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা কি কেউ দিতে পারবেন?

পূর্বার সাথে সম্পর্ক হওয়ার প্রথম কয়েকটা মাস ছিল রূপকথার মতো। আমরা ফোনে প্রচুর গল্প করতাম। কাজের ফাঁকে ফাঁকে চ্যাটিং চলত দিনভর। আমাদের দেখা হত কম। কিন্তু আমরা কল্পনায় গড়ে তুলেছিলাম নিজেদের একটা জগত, যে জগতের সাথে বাস্তব জীবনের সম্পর্ক ছিল খুবই কম। সেখানে আমরা প্রচুর সময় কাটাতাম একসাথে।

কিন্তু আস্তে আস্তে এক অদ্ভুত অস্থিরতা আমাদের গ্রাস করতে থাকল। আমরা বাস্তবে একে অপরকে কাছে চাইতে লাগলাম। মাঝে মাঝে মনে হত, সংসার ছেড়ে বেরিয়ে আসি দু’জনেই। আবার, কখনো তীব্র অপরাধবোধ গ্রাস করতো আমাদেরকে। আমরা দুজনই আমাদের সঙ্গীদের সাথে প্রতারণা করছি, ঠকাচ্ছি বাচ্চাদেরকে। বাচ্চারা যদি আমাদের এই সম্পর্কের কথা জানতে পারে, তবে তারা কোন চোখে দেখবে আমাদেরকে?

পৃথিবীর যেকোনো সম্পর্কের মধ্যেই টানাপোড়েন থাকে। থাকে প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির খতিয়ান। কখনো প্রাপ্তির খাতটা বড় হয়, কখনো অপ্রাপ্তিরটা। আমরা চেষ্টা করি যোগ বিয়োগ করে জীবনের রেওয়ামিলটা মেলাতে। কখনো মেলে, কখনো মেলে না। নানা খাতে গোঁজামিল দেওয়ার পরেও যখন বুঝি, হিসাবটা কিছুতেই মিলবে না, তখন মেনে নিতে বাধ্য হই বেহিসাবী জীবন। আর তখনই অর্ণবদের জীবনে পূর্বাদের আগমন ঘটে একটু শান্তির আশায়। কিন্তু সত্যিকারের শান্তি মেলে কি? মেলে কি সুখ অথবা স্বস্তি?

——————————————————————

১৮ই ফেব্রুয়ারি, দুপুর ৩টা

এমনি নানান দোলচলের দোলায় দুলতে দুলতে এগিয়ে যাচ্ছিল আমার আর পূর্বার পরিণতিহীন সম্পর্ক। এরকম একটা সময়েই ঘটনাটা ঘটলো।
ভাইবারে পূর্বার সাথে চ্যাট করছিলাম। ফোনের ডান কোণে টুক করে মেসেঞ্জার টোকা দিয়ে গেলো। যেহেতু পূর্বার সাথে কথা বলছিলাম, তাই মেসেন্জার চেক করার কোনো আগ্রহ বোধ করলাম না। কিন্তু খুব অল্প সময়ের বিরতিতে মেসেন্জারে নোটিফিকেশন আসতেই লাগলো। বিরক্ত হয়ে পূর্বাকে বললাম, “তোমাকে একটু পরে নক্ দিচ্ছি।”

মেসেন্জারে ঢুকতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। পূর্বার স্বামী নক দিয়েছেন।
ওনার কথার সাদা অর্থ দাঁড়ায়, উনি আমার আর পূর্বার ব্যাপারটা জানেন। কিন্তু পূর্বাকে পরিবারের কাছে কোনোভাবেই ছোট করতে চাচ্ছেন না বলে ওকে কিছু বলছেন না। ভদ্রলোক চাচ্ছেন, আমি যেন নিজ থেকে পূর্বার জীবন থেকে সরে যাই। তাতে করে পূর্বা কষ্ট পেলেও, ওনার কাছে ছোট হবে না। এবং তিনি কখনোই পূর্বাকে জানতে দেবেন না যে, উনি আমাদের বিষয়টা জানতেন বা আমার সাথে যোগাযোগ করেছেন।
কিন্তু, আমি যদি ওনার শর্তে রাজি না হই তবে উনি পূর্বাকে সব জানাবেন। জানাবেন পূর্বার সন্তান এবং অভিভাবকদেরও। প্রয়োজন মনে করলে তিনি আমাদের চ্যাটিং ভাইরাল করে দেবেন।

আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলাম। কিছুই চিন্তা কিরতে পারছিলাম না। আমার সমস্ত শরীর ঘেমে উঠলো, মাথার ভেতর কেমন যেন করতে লাগলো। মনে হল, আমার পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে।

পূর্বা ! আমার পূর্বা !!
আমার জন্য তোমার এতো বড় ক্ষতি হতে যাচ্ছে? আমার জন্য তুমি সংসারের কাছে, সমাজের কাছে অপদস্ত হতে যাচ্ছ?
তোমার এই অপমান আমি সহ্য করব কীভাবে? পরমুহূর্তেই মনে হলো, “হায় আল্লাহ, আমি পূর্বাকে ছাড়া থাকবো কীভাবে ?”
দিনের মধ্যে যতক্ষণ সময় আমি জেগে থাকি এবং যতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকি, পূর্বা ছায়ার মতো জড়িয়ে থাকে আমার চিন্তা এবং চেতনায়। যখন আমি সচেতনভাবে ওর কথা চিন্তা না করি, তখনো আমি ওর কথাই চিন্তা করতে থাকি।
এই পূর্বাকে ছাড়া আমি বাঁচবো কীভাবে?
এই পূর্বার অসম্মান আমি সইবো কীভাবে?

———————————————————————-

২২শে ফেব্রুয়ারি, সন্ধ্যা ৭টা

পূর্বার স্বামী গত চারদিন ধরে আমাকে নানারকম কথা লিখছেন। ওনার বেশিরভাগ কথার সারমর্ম হচ্ছে, উনি পূর্বাকে কীভাবে অপমান করবেন তার বিভিন্ন বর্ণনা।
গত চারদিন ধরে আমি নানাভাবে চিন্তা করেছি পূর্বাকে আমি কী বলবো, কীভাবে বলবো। শেষ পর্যন্ত ঠিক করেছি আজকে, যেভাবেই হোক, পূর্বাকে কিছু একটা বলবোই বলবো ।

শেষ পর্যন্ত আমাদের আর বইমেলায় যাওয়া হলো না। রিক্সা করে ঘুরতে ঘুরতে পূর্বা হঠাৎ বলল, “চলো নিউমার্কেটে যাই।” নিউমার্কেটে আমরা কিছুক্ষণ হাঁটলাম, চটপটি খেলাম, পূর্বা আমাকে আমসত্ত্ব কিনে দিল। আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না ওকে কীভাবে কথাগুলো বলবো।
পূর্বা হঠাৎ করেই বলল, “চলো তো ওভারব্রীজে উঠি, অনেকদিন উঠি না।”
আমরা দাঁড়িয়ে আছি ফুটওভারব্রীজের মাঝামাঝি। পূর্বা মুগ্ধ চোখে সামনে তাকিয়ে বাস, গাড়ি, রিক্সার অপসৃয়মান স্রোত দেখছে। ওর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আমার চোখ জ্বালা করে উঠল। আমি খপ্ করে ওর একটা হাত চেপে ধরে বললাম, “পূর্বা, আমি তোমার সাথে আর কোন যোগাযোগ রাখতে পারব না। আমার বউ সব জেনে গেছে।” পূর্বা ওর মেঘভরা চোখ মেলে তাকালো আমার দিকে, তাকিয়েই রইল।
আমি ওকে বললাম, “আজকের পর তোমার সাথে আমার আর কখনো দেখা হবে না। আমাদের আর কোনো যোগাযোগও থাকবে না।”
পূর্বা তাকিয়ে ছিল আমার চোখের দিকে; হঠাৎ চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল, “আমার কোনো আপত্তি নেই অর্ণব। তুমি যদি না চাও, তবে আমাদের কোনো যোগাযোগ থাকবে না। ভুলে যাও আমাকে, আমিও চেষ্টা করব তোমাকে ভুলতে। আমাদের দুইজনেরই তো সংসার আছে, পরিবার আছে, তাইনা?”
বলতে বলতে ওর গলার স্বর বুঁজে এলো। ওর চোখের ভিতর লুকানো মেঘগুলো কান্না হয়ে ঝরে পড়তে লাগলো। সেই কান্নায় ভিজে গেলাম আমিও।

আমরা ধীর পায়ে নেমে আসছি ওভারব্রীজ থেকে, আমি শক্ত করে ধরে আছি পূর্বার একটা হাত। জানিনা জীবনে আর কোনোদিন এই হাতটা ধরতে পারবো কিনা। সিঁড়ির মাঝামাঝি আসতেই পূর্বা আমার হাতটা অনেক শক্ত করে চেপে ধরলো, মনে হল কিছু বলতে চাচ্ছে। জিজ্ঞেস করতেই, মাথা নেড়ে জানালো “কিছু না।” কিন্তু হাতের বাঁধন হালকা করল না, শক্ত করেই ধরে রাখল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট গাড়ি এসে পৌঁছালো।
পূর্বা আমার হাত শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে, এই জীবনে কেউ এই বন্ধন ছুটাতে পারবে না। এমনকি, আমরাও না।
কিন্তু, একটু পরেই পূর্বা চলে গেল।
চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর, ওর মুঠোফোন থেকে ভেসে আসলো একটা বার্তা……..
“So I’m gonna love you like
I’m gonna lose you..
I’m gonna hold you like
I’m saying goodbye..
Wherever we’re standing,
I won’t take you for granted…”

———————————————————————

আমি পূর্বা

অর্ণবের হাতটা ছাড়িয়ে আসতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো।
মনে হচ্ছিলো, এ আমি কী করছি?
কি করে বাঁচবো আমি অর্ণবহীন পৃথিবীতে? সংসার, সন্তান, কর্মস্থল সব গুছিয়ে চলার পাশাপাশি অর্ণব হয়ে উঠেছিলো আমার প্রতিমুহূর্তের সঙ্গী।
ও তো আমারই আরেকটা সত্তা।
অর্ণবকে ছাড়া এই বর্ণহীন পৃথিবীতে আমি থাকবো কী করে?

আজকে বিকেলে কী হবে, আমি সবই জানতাম। কিছু দিন আগে অর্ণবের মা আমাকে ফোন করেছিলেন । বারবার অনুরোধ করছিলেন, আমি যেন অর্ণবের সাথে কোন যোগাযোগ না রাখি। গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকবার ফোন করেছেন উনি। বারবার বলেছেন অর্ণবের জীবনে আমার উপস্থিতি ওদের দাম্পত্য কলহের একটা বড় কারণ। অথচ অর্ণব কিছুই বলেনি আমাকে। তিনি বারবার বলেছেন, যেভাবেই হোক অর্ণবের পরিবারটাকে ভাঙনের হাত থেকে বাঁচাতে।

আর আমি? ওনার সাথে কথা বলার সময় প্রতিবারই মিশে গেছি মাটির সাথে। নিজেকে খুব বেশি স্বার্থপর মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, আমার জন্য অর্ণবের সংসারটা ভেঙে যাবে? আমি কি তা হতে দিতে পারি?
মনে হয়েছে, যে কোনোভাবেই হোক,অর্ণবকে ফিরিয়ে দিতে হবে ওর স্ত্রীর কাছে, সন্তানের কাছে।

আমি জানতাম, অর্ণবকে সোজাসুজি বললে ও কিছুতেই মানবে না। ওকে আমি কিছুতেই ফেরাতে পারবো না আমাদের এই সম্পর্ক থেকে।
তাই অনেক চিন্তা করে একটা বুদ্ধি বের করলাম। আমি জানি, অর্ণব সবচেয়ে বেশি ভয় পাবে পারিবারিকভাবে আমার অসম্মানকে।
তাই আমার স্বামীর মেসেঞ্জার দিয়ে নক্ দিলাম ওকে। ভয় দেখালাম আমার সম্মানহানীর।
আমি জানতাম, এতেই কাজ হবে।
ওভারব্রীজ থেকে নেমে গাড়িতে ওঠার সময়ই আমি বুঝে গেছি, অর্ণবের মা যা চেয়েছেন, তা ওনাকে আমি দিতে পেরেছি। ব্লক করার আগে শেষবারের মতো একটা টেক্সট পাঠালাম আমার পাগলা অর্ণবকে।

———————————————————————-

অতঃপর টিয়া সবুজ রঙের শাড়ি

গাড়ির পিছনের সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে পূর্বা। গাড়িচালক মাঝে মাঝেই সামনের আয়নায় অবাক হয়ে ওকে দেখছেন। কারণ ভদ্রমহিলা গাড়িতে ওঠার পর থেকেই সমানে কেঁদে যাচ্ছেন। মাঝেমাঝে ফুঁপিয়ে উঠছে পূর্বা, কিছুতেই চোখের পানি বন্ধ করতে পারছে না। তার চোখ থেকে অনবরত পানি পরছে টিয়া সবুজ রঙ শাড়িতে। চোখের পানিতে শাড়ির বুকের কাছের খানিকটা জায়গা টিয়া সবুজ থেকে পরিণত হয়েছে গাঢ় সবুজে, যে রংটা অর্ণব একদমই পছন্দ করে না।

————————————————————————————————————————–
(অর্ণবের মা কীভাবে পূর্বার ফোন নম্বর পেলেন, পূর্বা কিভাবে তার স্বামীর মেসেন্জার থেকে অর্ণবকে নক দিল এবং ওর স্বামী তা টের পেলেন না, সেই ব্যাখ্যা দিতে গেলে অহেতুক গল্পের পরিধি বাড়ে, তাই বিষয়টি আমি এড়িয়ে গেছি।
হয়ত কোন একদিন ওই গল্পটাও বলব আপনাদেরকে)