পর্ব-৪: শ্রম বৈষম্য এবং সন্তান পালনের দলিল
শিল্প সমালোচক, লেখক শার্লট মালিন্সের A Little Feminist History of Art বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন বিশিষ্ট অনুবাদক, শিক্ষক জি এইচ হাবীব। বইটির অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর চতুর্থ পর্ব। সব পাঠকের সুবিধার জন্য প্রতি পর্বের শুরুতে বইটির এবং লেখক শার্লট মালিন্সের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া থাকবে।।
[নারীবাদী শিল্প আন্দোলনের শুরু ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে। পুরুষ প্রাধান্যবিশিষ্ট রঙ্গমঞ্চে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে সে সময় নারী শিল্পীরা তাঁদের কাজগুলোর জেন্ডারচ্যুতি ঘটাবার সংগ্রামে নামেন। এরপর থেকে সেই আন্দোলন শিল্প জগতে গোটা বিশ্বজুড়ে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন ক’রে আসছে। ‘নন্দনতাত্ত্বিক ফরমালিযম’ ব’লে অভিহিত যুগের পর সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক নানান ইস্যুতে কথা বলার জন্য ‘নারীদৃষ্টি’-র সাহায্যে নারী শিল্পীরা বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ ক’রে জেন্ডার, পরিচয় এবং ফর্মের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, সমালোচনা করেছেন সাংস্কৃতিক প্রত্যাশাগুলোকে এবং নারীকে সনাতনী দৈনন্দিন ধারণায় আটকে ফেলার ব্যাপারটিকে। সমাজের দৃষ্টি ঘোরাতে চেয়েছেন সাম্যের জন্যে নারীর সংগ্রাম এবং নারীদেহকে পণ্য হিসেবে দেখবার মানসিকতা ও ক্রিয়াকর্মের দিকে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” (A Little Feminist History of Art) নামের ছোট্ট বইটিকে এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে জাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিল্পকর্মের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভ ভূমিকা বলা যেতে পারে। ১৯৬০-এর দশক থেকে বর্তমান কাল অব্দি পঞ্চাশটি অসামান্য কাজ নারীর জীবন ও অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে, ভিয্যুয়াল সংস্কৃতির ওপর নারীবাদী আদর্শ ও রাজনীতি যে প্রভাব ফেলেছে সেটাও এই কাজগুলো মেলে ধরেছে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” নামের এই গ্রন্থটি জেন্ডার বৈষম্য, যৌনতা, গার্হস্থ্য জীবন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর নারী দেহের মতো বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা বিংশ শতকের সবচাইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, প্রভাবশালী ও টেকসই শৈল্পিক আন্দোলনগুলোর একটির আনন্দ উদযাপন।
শার্লট মালিন্স একজন শিল্প সমালোচক, লেখক এবং সম্প্রচারক। তিনি রেচল হোয়াইরিড, সেসিলি ব্রাউন, র্যাচেল লামসডেন, জেনি স্যাভিল, ক্যাথে ডে মনসাউক্স, স্যু অ্যারোস্মিদ, সুজ্যান কুন, স্যুযি হ্যামিলটন এবং পলা রেগোসহ বিভিন্ন নারী শিল্পীকে নিয়ে লেখালেখি করেছেন। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “লাইভ্স অভ দ্য গ্রেট আর্টিস্টস” (২০০৮) এবং “র্যাচেল হোয়াইহেড” (২০০৭)। তিনি বিবিসি রেডিও ফোর-এর “ফ্রন্ট রো” এবং “স্যাটারডে রিভিউ’’-র নিয়মিত প্রদায়ক]
মার্গারেট হ্যারিসন, কে হান্ট এবং মেরি কেলি
(জন্ম ১৯৪০; ১৯৩৩-২০০১; জন্ম ১৯৪১)
মার্গারেট হ্যারিসন, কে হান্ট এবং মেরি কেলি ১৯৭০-এর দশকের ব্রিটিশ নারীবাদী দলগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৭৩ সালে তাঁরা একসঙ্গে লন্ডনের বার্মন্ডসে-তে অবস্থিত ধাতব বাক্স তৈরির একটি কারখানায় শ্রমিক শ্রেণির কর্মচারীদের ভেতর বৈষম্যের ব্যাপারটি উন্মোচন করার জন্যে দু’বছরের একটি গবেষণা প্রকল্প হাতে নেন।
তাঁরা সেখানে কর্মরত নারীদের ছবি তোলেন এবং তাঁদের শ্রমঘণ্টা ও বেতনের গ্রেড-এর অনুপুঙ্খ তথ্য সরবরাহকারী বেশ কিছু পাঞ্চকার্ড, কারখানার পরিবেশ সম্পর্কে বাচিক বয়ান ও ফিল্ম ফুটেজ জড়ো করেন। সাউথ লন্ডন আর্ট গ্যালারিতে ১৯৭৫ সালে Women and work : A document on the division of labour in industry (নারী ও কাজ : কারখানায় শ্রমবিভাজন সম্পর্কিত একটি দলিল) প্রথম প্রদর্শিত হয়। এতে দেখা যায় নারীদেরকে নিম্ন স্তরের কাজে ঠেলে দিয়ে পুরুষরা সব ভালো ভালো কাজ দখল ক’রে নিয়েছে। হ্যারিসন স্মৃতিচারণ ক’রে বলেছেন, “১৯৭০-এর দশকে আমি সেসব কাজ ক’রে বেশ স্বস্তি পেতাম যেগুলোকে সেসময় প্রবলভাবে রাজনৈতিক ব’লে বিবেচনা করা হতো। আমি সেটাকে জীবনের অংশ ব’লে মনে করতাম। আলোকচিত্রগ্রহণ এবং প্রামাণ্যকরণ (ফটোগ্রাফি ও ডকুমেন্টশন) শিল্প হিসেবে গণ্য হতো না, এবং যে কাজ কেবল সাজসজ্জার জন্য নয় বরং বিষয়টির আরো গভীরে ঢুকেছিল সে কাজ সৃষ্টি করার জন্য আমরা সমালোচিত হয়েছিলাম।”
সমালোচকেরা ইন্সটলেশনটির প্রামাণিক বৈশিষ্ট্যটি (ডকুমেন্টারি নেচার) ধরতে ব্যর্থ হলেও সেটার তাৎক্ষণিক প্রভাবটি ছিল সুস্পষ্ট – এই তিন শিল্পী ফের সেই ধাতব বাক্স তৈরির কারখানায় প্রবেশাধিকার হারিয়েছিলেন।
চিত্র পরিচিতি:
Women and work: A document on the division of labour in industry (নারী ও কাজ:কারখানায় শ্রমবিভাজন সম্পর্কিত একটি দলিল) ১৯৭৩-৫;
ভিডিও (২টি মনিটর, রঙ, অডিও) এবং আলোকচিত্র;
কাগজে জেলাটিন সিলভার প্রিন্ট, এবং কাগজের ওপর নানান কাজ, কালি;
বিচিত্র মাত্রিক
মেরি কেলি
(জন্ম ১৯৪১)
মেরি কেলি ছিলেন ১৯৭০-এর দশকে যুক্তরাজ্যে নারী আন্দোলনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিত্বদের অন্যতম। ১৯৬৮ সালে তিনি লন্ডন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চ’লে যান। পাঁচ বছর পর তাঁর পুত্র গর্ভে থাকা অবস্থায় তিনি মা হওয়ার মনস্তাত্বিক বিষয়টি ধ’রে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। আর তারই ফসল Post-Partum Document “প্রসবোত্তর দলিল” – ছটি দলে বিভক্ত ১৩৫টি উপাদানের একটি ইন্সটলেশন, যেখনে জন্ম থেকে পাঁচ বছর অব্দি শিশুর বেড়ে ওঠা এবং বিকাশের পর্বে মায়ের ভূমিকা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ব্যাপারটি খোলাসা ক’রে কেলি বলেন, “এটা কোনো সনাতনী আখ্যান নয়; একটি সমস্যা বিরামহীনভাবে সামনে আসছে কিন্তু কোনো সমাধানে পৌঁছানো যাচ্ছে না। পাওয়া যাচ্ছে কেবল বিচ্ছেদ ও ক্ষতির মুহূর্তগুলোর আবর্তন; এবং তার কারণ সম্ভবত এই যে বাসনা অন্তহীন, তা কোনো স্বাভাবিকীকরণের ধার ধারে না, বরং বায়োলজিকে উপেক্ষা করে, দেহটিকে বিক্ষিপ্ত করে।”
Post-Partum Document “প্রসবোত্তর দলিল” প্রথম প্রদর্শিত হলে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়, বিশেষ ক’রে কেলি নোংরা ন্যাপির আস্তরণ ব্যবহার করার কারণে। আস্তরণটাকে তিনি একটা বেইস হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন, আর সেটার ওপরেই ধ’রে রাখা হয়েছিল কিভাবে তিনি তাঁর সন্তানকে বুকের দুধ ছাড়িয়ে অন্য খাবারে অভ্যস্ত করেছিলেন সেই ব্যাপারটি (‘রাত সোয়া একটায় ৬ টেবিল চামচ গাজর’; ‘বিকেল তিনটায় আড়াই আউন্স সফ্ট ড্রিংক রিবেনা’)। আর এসবের সঙ্গে তিনি তাঁর শিশুর গেঞ্জি, প্রথম উচ্চারিত শব্দ, তার কম্ফোরটারের খণ্ডাংশ, তাত্ত্বিক ডায়াগ্রাম, এবং তাঁর নিজের রোজনামচা ধরনের লেখাও জুড়ে দিয়েছিলেন। ফলে দর্শক একটি শিশুকে লালন-পালন করার একঘেয়েমি, সুখ, শারীরিক সহিষ্ণুতা ইত্যাদি অনুভব করেন। আমরা বাইরে থেকে ভেতরে তাকাবার বদলে বরং খোদ অভিজ্ঞতাটির ভেতরে ঢুকে যাই।
চিত্র পরিচিতি:
Post-Partum Document (প্রসবোত্তর দলিল) ১৯৭৩-৯;
মিশ্র মাধ্যম;
বিচিত্র মাত্রিক
(চলবে)