December 3, 2024
ফিচার ৩সাক্ষাৎকার

নারীর সচেতনতা যত বাড়বে, পুরুষ তত হিংস্র হয়ে উঠবে: বোভোয়ার

ফরাসি লেখক ও দার্শনিক সিমন দ্য বোভোয়ারের বিখ্যাত প্রবন্ধ গ্রন্থ দ্য সেকেন্ড সেক্স (ফরাসিতে- ল্য দ্যজিয়েম সেক্স) প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। এর প্রায় দেড় দশক পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমে দ্বিতীয় তরঙ্গের নারীবাদ আন্দোলন দানা বাধে, আস্তে আস্তে পশ্চিমে চাঙ্গা হয়ে ওঠে। অনেকেই মনে করেন দ্বিতীয় তরঙ্গের এই উত্থান মূলত সিমন দ্য বোভোয়ারের সেকেন্ড সেক্স বইটি দ্বারা প্রভাবিত। নারীবাদ আন্দোলনের ওই উত্তাল সময়ে ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ফরাসি অধ্যাপক ও সাংবাদিক জন জেরাসি সিমন দ্য বোভোয়ারের একটি সাক্ষাৎকার নেন। সাক্ষাৎকারে বোভোয়ার নারীবাদ নিয়ে তার ভাবনা, তার বই দ্য সেকেন্ড সেক্স, শ্রেণি সংগ্রাম, সমাজ, রাজনীতিসহ বহু বিষয়ে কথা বলেন খোলামেলা। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য সিমনের সেই সাক্ষাৎকারটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন আতিকুল ইসলাম ইমন। 

জেরাসি: সেকেন্ড সেক্স প্রকাশ হওয়ার পর ২৫ বছর কেটে গেলো। অনেকে, বিশেষ করে আমেরিকায় মনে করে— এই বইটি সাম্প্রতিক সময়ের নারীবাদী আন্দোলনের সূচনা ঘটিয়েছে। আপনিও কি তাই মনে করেন?

বোভোয়ার: আমি তা মনে করি না। বর্তমান নারীবাদী আন্দোলন যা প্রকৃতপক্ষে পাঁচ-ছয় বছর আগে শুরু হয়েছে,  এই বইটি সম্পর্কে তারা জানত না। তারপর যখন আন্দোলন বড় হলো, কিছু নেতা এ বইটি থেকে তাদের তাত্ত্বিক ধারণাগুলোর ভিত্তি সংগ্রহ করেন। তবে সেকেন্ড সেক্স কোনভাবেই এই আন্দোলনের সূচনা করেনি। বেশিরভাগ নারী যারা এই আন্দোলনে সক্রিয়, ১৯৪৯-৫০ সালে যখন বইটি প্রকাশ হয়, তখন তারা খুবই ছোট ছিলেন— এ বয়েসে কেউ এমন বই দ্বারা প্রভাবিত হয় না। তবে যে বিষয়টি নিশ্চিতভাবেই আমাকে আনন্দিত করে তা হল— তারা পরে আমার এই বইটির খোঁজ করেছেন। বেটি ফ্রেইডান তার ফেমিনিন মিস্টিক বইটি আমাকে উৎসর্গ করেন। বইটি পড়ে আমার মনে হয়েছে হয়ত তিনি কোনভাবে আমার বইটি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তবে অন্যরা— মোটেও না। যেমন উদাহরণ হিসেবে কেট মিলেটের কথাই বলি, তার কোন কাজে আমার নাম একবারও উল্লেখ করেননি। তারা হয়ত নারীবাদী হয়েছেন সেসব কারণে, যেসব কারণ আমি সেকেন্ড সেক্সে ব্যাখ্যা করেছিলাম। তবে তারা এসব কারণ তাদের নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আবিষ্কার করেছিলেন, আমার বই থেকে নয়।

জেরাসি: আপনি বলেছিলেন আপনার নারীবাদ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছিল সেকেন্ড সেক্স লেখার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। ঠিক কোন পথে এবং কীভাবে এই আন্দোলনের বিকাশ দেখেন, যখন আপনি বইটি আপনার নিয়মে প্রকাশ করেছিলেন।

বোভোয়ার: সেকেন্ড সেক্স লেখার সময় আমি প্রথমবারের মতো সচেতন হই যে আমি নিজে একটি মিথ্যা জীবনে বাস করছি। আমি ভেবেছিলাম এই পুরুষশাসিত সমাজ থেকে না জেনেই লাভবান হচ্ছি। আসলে যা হয়েছে আমার জীবনের শুরুতে আমি পুরুষের মূল্যবোধগুলো গ্রহণ করেছিলাম এবং সে অনুসারেই জীবনযাপন করছিলাম। অবশ্যই আমি সফল ছিলাম, এবং এটা আমার মধ্যে এই বিশ্বাস দৃঢ় করেছিল যে, নারী ও পুরুষ সমান হতে পারে যদি নারীরা তা চায়। অন্যকথায়, আমি একজন বুদ্ধিজীবী ছিলাম। আমার ভাগ্য ভাল ছিল, আমি সমাজের এমন একটি শ্রেণিতে বড় হয়েছি, যারা বুর্জোয়া। তারা আমাকে শুধু স্কুলে যেতে দিতেই সমর্থ ছিল না, বরং স্বতঃস্ফূর্তভাবে চিন্তা নিয়ে খেলতেও দিত। এই কারণেই আমি পুরুষের জগতে কোন জটিলতা ছাড়াই ঢুকতে পেরেছি। আমি দেখিয়েছি— দর্শন, শিল্প, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে পুরুষের সমকক্ষ হয়ে আলোচনা করতে পারি। নারীত্বের জন্য যা যা আলাদা ছিল তা আমি নিজের মধ্যে রেখেছি। তারপর আমি সাফল্যের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে গিয়েছি। আমি দেখেছিলাম যেকোনও পুরুষ বুদ্ধিজীবীর মতোই আমি রোজগার করতে পারি এবং আমার পুরুষ সহকর্মীদের মতোই আমাকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছিল।

আমি একজন নারী হয়েও দেখলাম যদি আমি চাই একা ভ্রমণ করতে পারি, আমি চাইলে কোন ক্যাফেতে বসে লিখতে পারি এবং যে কোনো পুরুষ লেখকের মতোই শ্রদ্ধা পেতে পারি। এরকম প্রতিটি পর্যায় আমার স্বাধীনতা ও সমতাবোধকে দৃঢ় করেছে। এসব কারণে আমি সহজেই ভুলে গেলাম যে একজন নারী সেক্রেটারি চাইলেই এরকম সমান সুবিধা ভোগ করতে পারে না। তিনি কোনো ক্যাফেতে বসে উত্যক্ত না হয়ে একটি বই পড়তে পারবেন না। তার জ্ঞান বুদ্ধির জন্য কোন পার্টিতে তাকে দাওয়াত দেওয়া হয় না বললেই চলে। তিনি অর্থ সম্পত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবেন না। আমি পারছি। অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমার মধ্যে এই প্রবণতা আছে যে- যেসব নারী পুরুষদের মতো স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে নিজেকে আর্থিক বা আত্মিকভাবে অসমর্থ মনে করে আমি তাদের ঘৃণা করি। এসবের প্রতিক্রিয়ায়, আমার নিজেকে না বলেও আমি ভাবছিলাম- যদি আমি পারি, তবে তারা কেন পারবে না। সেকেন্ড সেক্স লিখতে গিয়ে আমি বুঝতে পারলাম আমার সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি এসেছে প্রত্যাখ্যান (Negate) করার মধ্যে দিয়ে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে আমার নারীত্বের কিছু বৈশিষ্ট্যও প্রত্যাখ্যান করেছি। আমরা যদি এটিকে শ্রেণি অর্থনীতির নিরিখে বিবেচনা করি তবে আপনি সহজেই তা বুঝবেন। আমি একজন শ্রেণি সহযোগী হয়ে উঠেছিলাম। আমি লিঙ্গ সংগ্রামের ক্ষেত্রেও একই রকম মনোভাবের ছিলাম।

সেকেন্ড সেক্স লেখার মাধ্যমে আমি সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠেছিলাম। আমি বুঝতে পারলাম, আমার সামনে যত বিকল্প ছিল বেশিরভাগ নারীরই তা নেই। বুঝতে পারলাম, নারীরা পুরুষভিত্তিক সমাজে মূলত দ্বিতীয় লিঙ্গ হিসেবে সংজ্ঞায়িত হয়- এই প্রবণতা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করলে সমাজটিরও সম্পূর্ণ নির্মূল হবে। কিন্তু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী যেকোনো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিপ্লব যেমন দুর্বল ও শ্লথ, এ ক্ষেত্রেও তাই হবে। প্রথমে মানুষকে এই আধিপত্যের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। তারপর তাদের নিজেদের সামর্থ্যের উপর আস্থা স্থাপন করতে হবে। যারা পুরুষের আধিপত্যের সহযোগী বা লাভবান হয়ে থাকেন তাদের বুঝতে হবে তারা কীভাবে প্রতারিত হচ্ছেন। এবং কোন চূড়ান্ত অবস্থান নিলে যাদের হারানোর ভয় সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ আমার মতো যারা সম্মান ও কেরিয়ার হারানোর ভয়ে আছেন, তারা স্বেচ্ছায় নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত থাকতে হবে। তাদের বুঝতে হবে, তাদের বোনদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি শোষিত তারা তাদের সঙ্গে সবার শেষে যোগ দেবে। কেননা একজন শ্রমিকের স্ত্রী এরকম আন্দোলনে যোগ দেওয়ার পক্ষে সবচেয়ে কম স্বাধীন। তিনি জানেন, বহু নারীবাদী নেত্রীর চেয়ে তার স্বামী আরও বেশি শোষিত-নির্যাতিত, এবং তার স্বামীর টিকে থাকতে পরিবারে গৃহিণী ও মা হিসাবে তার স্ত্রীর ভূমিকার উপর নির্ভরশীল। এইসব কারণে নারীরা আন্দোলনে যায় না।

ও হ্যাঁ, কিছু ছোট্ট চমৎকার ও জ্ঞানী ধরণের আন্দোলন হয়েছিল। সেসব আন্দোলন রাজনীতি ও সরকারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে লড়াই করেছিল। আমি এসব গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারিনি। তারপর ১৯৬৮ সালে সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেল। আমি জানি এর আগেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা (নারীবাদি আন্দোলন) ঘটেছিল। যেমন বেটি ফ্রাইডেনের বইটি, যেটি ১৯৬৮ সালের আগে প্রকাশিত হয়েছিল। বস্তুত আমেরিকান নারীরা ওই বইটির পর  আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। তারা অন্য যে কোনো দেশের নারীদের চেয়ে রান্নাঘরে মহিলাদের রাখার রক্ষণশীল প্রবণতা ও নতুন প্রযুক্তির মধ্যে দ্বন্দ্বের ব্যাপারে বেশি সচেতন হয়ে উঠেছিলেন। প্রযুক্তির প্রসারের ফলে দেখা গেল প্রযুক্তি মাংসপেশির নয় বরং মস্তিষ্কের শক্তি হিসেবে কাজ করছে। পুরুষের যে যুক্তি, নারীরা দুর্বল তাই তাদের গৌণ ভূমিকা পালন করতে হবে— প্রযুক্তির প্রসারের ফলে এমন ধারণা আর যৌক্তিকভাবে রক্ষা করা যাচ্ছে না।  যেহেতু আমেরিকায় ব্যাপক প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন হয়েছে তাই প্রযুক্তি ও রক্ষণশীল মনোভাবের দ্বন্দ্বটিতে সেদেশের নারীরাও পড়েছে। সুতরাং এতে স্বাভাবিকভাবেই সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদের একেবারে কেন্দ্রস্থলে নারীবাদী আন্দোলনটি সবচেয়ে বড় প্রেরণা পেয়েছিল। এমনকি, যদিও এই প্রেরণা চরমভাবে অর্থনৈতিক ব্যাপারে ছিল, অর্থাৎ সমান পারিশ্রমিকের জন্য কিন্তু সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্যেই প্রকৃত নারীবাদী চেতনা বিকাশ লাভ করেছিল। আমেরিকাতে ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনে হোক বা ফ্রান্সে ১৯৬৮ সালের বিদ্রোহের  পর ইউরোপের অন্যান্য দেশে এর প্রভাব থেকেই হোক— নারীরা মূলত তাদের শক্তির ব্যাপারে সচেতন হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এসব আন্দোলনের  পর। পুঁজিবাদ সারাবিশ্বে নিশ্চিতভাবেই দরিদ্রের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে এটা জানার পর বিশাল সংখ্যক নারী শ্রেণী সংগ্রামে জড়িত হয়, এমনকি ‘শ্রেণী সংগ্রাম’ টার্মটি গ্রহণ না করেও অনেকে এ সংগ্রাম সামিল হয়। তারা এক্টিভিস্ট হয়ে ওঠেন। তারা মিছিল, বিক্ষোভ, প্রচারণা, আন্ডারগ্রাউন্ড গ্রুপ ও বামপন্থী সংগ্রামীদের সঙ্গে যোগ দেন। তারা এসব আন্দোলনে যে কোন পুরুষের সমান সংগ্রাম শুরু করলেন।

কিন্তু এতে কী হলো ? তারা যেসব গ্রুপে যোগ দিয়েছিল সেখানে তারা দেখলো- যে সমাজটি তারা পরিবর্তন করতে চাইছে সেই সমাজের মতোই এসব গ্রুপেও তারা শুধুই সেকেন্ড সেক্স হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। এখানে ফ্রান্সের কথা বলি, তারা দেখতে পেল যে নেতা সর্বদাই একজন পুরুষই হয়ে থাকেন। নারীরা ওইসব ছদ্মবিপ্লবী গ্রুপে পরিণত হলো নিছক মুদ্রলেখক, কফি বানানোর মহিলা হিসেবে। যাই হোক, এখানে আমার ‘ছদ্ম’ শব্দটি বলা উচিত হয়নি। ওইসব গ্রুপের অনেক পুরুষ নেতাই প্রকৃত বিপ্লবী ছিলেন। কিন্তু একটি পুরুষকেন্দ্রিক সমাজে প্রশিক্ষিত, বেড়ে ওঠা এবং তৈরি হওয়া একেকজন নেতা পুরষকেন্দ্রিকতাকে এসব গ্রুপেও নিয়ে এসেছিল। বুর্জোয়া শ্রেণি যেমন স্বেচ্ছায় তার ক্ষমতা ত্যাগ করতে চায় না, তেমনই এসব পুরুষরাও স্বেচ্ছায় তাদের এই পুরুষকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিটি ত্যাগ করতে চায় না। তাই এসব ক্ষেত্রে দরিদ্রদের যেমন ধনীদের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে হয়, তেমনই নারীকেও পুরুষদের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে হবে। এর মানে এই নয় যে, পুরুষদের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে হবে। এর অর্থ হলো সমতা প্রতিষ্ঠা করা। সমাজতন্ত্রের মত। সত্যিকার সমাজতন্ত্র যেমন প্রত্যেকের অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠা করে, নারীবাদি আন্দোলনও তাই। সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের অবশ্যই লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে আর এতে ক্ষমতাশালী শ্রেণি অর্থাৎ পুরুষদের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে হবে। শ্রেণি সংগ্রামের মাধ্যমে নারীরা বুঝতে পারলো শ্রেণি সংগ্রাম লিঙ্গসমতার সংগ্রামকে নাকচ করে না। ঠিক ওই পয়েন্টেই আমি যা বলেছি সে ব্যাপারে সচেতন হতে পারলাম। এর আগে আমি বুঝেছিলাম, একবার পুঁজিবাদের বিনাশ হলেই ঝট করে লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, ‘অতএব’…, এবং এই ‘অতএব’ ই হলো প্রতারণা— যেটি হলো, ‘আমাদের অবশ্যই শ্রেণি সংগ্রামে লড়তে হবে’। একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হলেই লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠিত হবে এটি সত্য নয়। সোভিয়েত রাশিয়া বা চেকোস্লোভাকিয়া দেখুন, যেখানে (যদি ওগুলোকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র মনে করেন আরকি, আমি অবশ্য তা মনে করি না) সর্বহারা (প্রলেতারিয়েত) শ্রেণির মুক্তি ও নারীর মুক্তির ব্যাপারে গভীর বিভ্রান্তি রয়েছে। ওসব ক্ষেত্রে কোনো না কোনভাবে শেষ পর্যন্ত দেখা যায় সর্বহারা শ্রেণি সবসময় পুরুষদের নিয়েই গঠিত। পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলো এখানেও একেবারেই অক্ষত রূপে বিরাজ করে। এবং এই যে নারীদের মধ্যে চেতনা আসলো,- ‘শ্রেণি সংগ্রাম লিঙ্গ সংগ্রামকে ধারণ করে না’, এটা একটি নতুন চেতনা। এই সংগ্রামে লিপ্ত বেশিরভাগ নারীই এখন তা বোঝেন, এটাই এই নারীবাদি আন্দোলনের সবচেয়ে বড় অর্জন। এটি এমন একটি বিষয় যা আগামী বছরগুলোর গতি পালটে দেবে।

জেরাসি: কিন্তু এমন চেতনা তো কেবল বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নারীদের মধ্যে জাগ্রত হয়েছে, অর্থাৎ যারা গোটা সমাজের পুনর্নির্মাণ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন শুধু তাদের।

বোভোয়ার: হ্যাঁ, অবশ্যই, যেহেতু বাকিরা রক্ষণশীল। বাকিরা যা ছিল তা আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। আর ডানপন্থী নারীরা তো বিপ্লবই চায় না। তারা মা ও স্ত্রী হিসেবে তাদের পুরুষের প্রতি নিবেদিত। এবং যদি তারা আন্দোলনকারী বনে যায়, তবে তখন তারা কেকের বড় টুকরাটাই চায়। তারা বেশি উপার্জন করতে চায়, সংসদে বেশি নারী চায়, একজন নারীকে প্রেসিডেন্টের পদে দেখতে চায় ইত্যাদি। তবে তারা মূলত অসমতায় বিশ্বাস করে, কেবল তারা সমাজের নিচের স্তরে না থেকে উপরের স্তরে উঠতে চায় এই যা। তারা যেমন সমাজ চলছে সেখানেই খাপ খাইয়ে নিতে পারে অথবা তাদের চাহিদা পূরণে কিছুটা পরিবর্তন করতে চায় আরকি। দেখুন, নারীদের সেনাবাহিনী বা পুলিশে যোগ দিতে পুঁজিবাদের কোন আপত্তি নেই। পুঁজিবাদ নিশ্চিতভাবেই নারীকে সরকারে যোগ দেওয়ার সুযোগ দেওয়ার মতো যথেষ্ট চালাক। ছদ্মসমাজতন্ত্র নিশ্চিতভাবেই একজন নারীকে তার পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি পদটি দিতে কোন আপত্তি করবে না। এগুলো হলো শুধু কিছু সংস্কার— যেমন, সামাজিক নিরাপত্তা ও সবেতনে ছুটির মতো বিষয়।  সবেতনে ছুটির নিয়ম শুরু হওয়ায় কি পুঁজিবাদের বৈষম্যে কোন শিথিলতা এসেছে? কারখানায় সমান মজুরি প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় কি চেক প্রজাতন্ত্রে পুরুষকেন্দ্রিক সমাজের অবসান হয়েছিল? প্রকৃতপক্ষে সমাজের বিদ্যমান মূল্যবোধের আমূল পরিবর্তন করতে হলে ‘মাতৃত্ব’ নিয়ে যে ধারণা আছে তা ধ্বংস করতে হবে— যা একটি বিপ্লবী ব্যাপার।

একজন নারীবাদি সে নিজেকে বামপন্থী বলে স্বীকার করুক বা না করুক, সে সংজ্ঞাগত দিক থেকে একজন বামপন্থী। সে সমতার আন্দোলনে পুরুষের মতোই সামগ্রিক সমতার জন্য সংগ্রাম করছে। সুতরাং লিঙ্গ সমতার জন্য তার সংগ্রাম মূলত শ্রেণি সংগ্রামেরই একটি দিক। বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বুঝতে এমন একটি সমাজ ধরুন যেখানে একজন পুরুষ মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন, সেখানে মূল্যবোধের উপর যদি বিতর্কগুলো করা হয়, যেখানে শক্ত ও কঠোর হওয়ার চেয়ে নরম ও ভদ্র হওয়া জরুরি। অন্য কথায় যে সমাজে প্রত্যেক ব্যক্তির অভিজ্ঞতা অন্য ব্যক্তির অভিজ্ঞতার মতোই একই— এমন একটি সমাজে আপনি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। এর মধ্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকসহ আরও অন্যান্য ক্ষেত্রের সমতাও রয়েছে।

সুতরাং লিঙ্গ সমতার সংগ্রাম মূলত শ্রেণি সংগ্রামকেই যথার্থ করে তোলে। কিন্তু শ্রেণি সংগ্রাম লিঙ্গ সংগ্রামকে ধারণ করে না। লিঙ্গ সংগ্রামই শ্রেণি সংগ্রামকে ধারণ করে। নারীবাদীরা তাই প্রকৃত বামপন্থী। বস্তুত, এখন যেটাকে আমরা রাজনৈতিক বামপন্থা বলছি নারীবাদীরা সেটার চেয়েও বেশি বামপন্থী।

জেরাসি: তাহলে কেবল লিঙ্গ সমতার সংগ্রামকে বামপন্থার মধ্যে পরিচালিত করে, যেমনটি আপনি বলছিলেন, লিঙ্গ সংগ্রাম সাময়িক সময়ের জন্য হলেও অন্যান্য রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক— নারীবাদীরা কি বামপন্থাকে দুর্বল করছে না? যারা দরিদ্র ও নারী উভয়কেই শোষণ করছে তাদের শক্তিশালী করছে না?

বোভোয়ার: না, বরং দীর্ঘমেয়াদে এটি কেবল বামপন্থাকেই শক্তিশালী করে। বামপন্থী হিসেবে কেউ নিজেকে পরিচয় দিতে হলে মূলত তাকে যেকোনো ধরণের শোষণের বিরোধী হিসেবে দাঁড়াতে হবে। বামপন্থী পুরুষরা আস্তে আস্তে পরিবর্তন হচ্ছে। বেশি বেশি বামপন্থী গ্রুপ তাদের মাচো পুরুষতান্ত্রিক নেতাকে তদারকির মধ্যে রাখছে। এটাই উন্নতি। এখানে আমাদের লিবারেশন পত্রিকাটিতে পুরুষকেন্দ্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠরাও একজন নারীকে এটির পরিচালক হতে দিতে বাধ্যবাধকতা অনুভব করছে। এটাই উন্নতি, বামপন্থী পুরুষরা তাদের ভাষা সংযত রাখতে শুরু করেছে।

জেরাসি: কিন্তু এটি কি বাস্তব? আমি বোঝাতে চাচ্ছি, যেমন আমি শিখেছি, কখনও ‘চিক’ (Chick) শব্দটি ব্যবহার না করতে। কোন গ্রুপ আলোচনায় নারীদের বক্তব্যকে সমান গুরুত্ব দিতে। থালাবাসন- বাড়িঘর পরিষ্কার করার কাজ করা, বাজার করা ইত্যাদি। কিন্তু আমি কি তবুও আমার ভাবনায় কোনভাবে কম সেক্সিস্ট? আমি কি পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোকে পরিহার করেছি ?

বোভোয়ার:  আপনি বোঝাতে চাইছেন আপনার ভিতরের আপনি? স্থূলভাবে বলতে গেলে, এতে কার কী আসে যায়? এক মিনিট চিন্তা করুণ। আপনি একজন বর্ণবাদীকে চেনেন। আপনি জানেন তিনি বর্ণবাদী কারণ সারাজীবন ধরে তাকে চেনেন আপনি। কিন্তু তিনি এখন আর ‘নিগার’ (Nigger) বলেন না। তিনি সমস্ত কৃষ্ণাঙ্গদের অভিযোগ শোনেন এবং তা মোকাবিলায় যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। তিনি অন্যান্য বর্নবাদীদের দমন করেন। কৃষ্ণাঙ্গ বাচ্চাদের শিক্ষা পাওয়ার অধিকারের পক্ষে তার কণ্ঠ জোরালো। তিনি কোন কৃষ্ণাঙ্গের ঋণ নেওয়ার ফরমে নিজে রেফারেন্স হয়ে সাহায্য করেন। তিনি তার এলাকায় নির্বাচনে কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিনিধিকে টাকা ও ভোট দিয়ে সমর্থন করেন। আপনি কি মনে করেন তিনি মনে মনে কতটুকু বর্নবাদী এ নিয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে কোন ভাবনা আছে? বেশিরভাগ শোষণই হয় শুধুই অভ্যাসগত কারণে। আপনি যদি আপনার অভ্যাসকে তদারকি করতে পারেন, যদি আপনার অভ্যাসকে বিপরীত দিকে পরিবর্তন করে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে তুলতে পারেন, তবে এটাই এক বড় পদক্ষেপ। আপনি যদি থালাবাসন পরিষ্কার করেন, বাড়িঘর মুছেন এবং যদি মনে করনে এসব আপনাকে কোনো পুরুষের চেয়ে কম পুরুষ করে তোলে না, তবেই আপনি একটি নতুন অভ্যাস তৈরিতে সাহায্য করলেন। কয়েকটি প্রজন্ম যদি ভাবে তাদের সবসময় বর্ণবাদবিরোধী আচরণ করতে হবে, তবে এর পরের প্রজন্মগুলো বর্ণবাদবিরোধী হিসেবে বেড়ে উঠবে। তাই বর্ণবাদবিরোধী হওয়ার এমন আচরণ চালিয়ে যান। এটাকে একটি খেলা ভাবুন। আপনার ব্যক্তিগত চিন্তায়, নিজেকে নারীদের চেয়ে উচ্চতর ভেবে যান- কিন্তু যতক্ষণ আপনি এমন আচরণ করছেন অর্থাৎ, যেমন আপনি থালাবাসন পরিষ্কার করছেন, বাজার করছেন, ঘর মুছছেন, বাচ্চাদের যত্ন নিচ্ছেন— আপনি মূলত নজির স্থাপন করছেন। বিশেষ করে আপনার মতো পুরুষ যাদের নিশ্চিত মাচো ভঙ্গি রয়েছে। কিন্তু এখানে আরেকটা মুশকিল হলো- আমি আসলে তা বিশ্বাস করি না। আমি মনেকরি না আপনি ঘরের কাজের ব্যাপারে যা বলছেন তা সবসময়ই করেন। মাঝে মাঝে থালাবাসন পরিষ্কার করা এক বিষয় আর দিনের পর দিন বাচ্চার ডায়াপার পরিবর্তন করা অন্য বিষয়।

জেরাসি: অহ, আসলে আমার কোন বাচ্চা নেই…

বোভোয়ার: কেন নেই? কারণ আপনি নিতে চাননি। আপনি কি ভাবেন যেসব মায়েদের আপনি চেনেন তাদের সবাই নিজের ইচ্ছায় বাচ্চা নিয়েছে? নাকি তাদের ভয় দেখানো হয়? আরও সূক্ষ্মভাবে বলতে গেলে, তারা কি এমনভাবে বড় হয়েছে যেখানে ভাবা হয়, সন্তান নেওয়াই নারীত্ব ও নিয়তি তাই তারা সন্তান নেয়? কিন্তু এমন পছন্দ তাদের জন্য কে ঠিক করে দিয়েছে? এসব বোধকে অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে।

জেরাসি: বুঝতে পেরেছি, এজন্যই বহু নারীবাদী বিচ্ছন্নতাবাদি হতে জোর দেন। কিন্তু বিপ্লবের ক্ষেত্রে, আমার ক্ষেত্রেও, আমরা যদি সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন একটু গ্রুপ হয়ে যাই তবে কি জিততে পারব ? যদি পুরুষদের পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয় তবে নারীবাদী আন্দোলন কি শেষ পর্যন্ত কিছু অর্জন করতে পারবে? যেমন ফ্রান্সে আজকের দিনের নারীবাদী আন্দোলনের প্রভাবশালী অংশই মূলত বিচ্ছিন্নতাপন্থী। এ কথা আমেরিকার ক্ষেত্রেও সত্য।

বোভোয়ার:  এক মিনিট। আমাদের আগে তদন্ত করে দেখতে হবে, কেন তারা বিচ্ছিন্নতাপন্থী। আমি আমেরিকার কথা বলতে পারব না, কিন্তু এই ফ্রান্সে অনেক গ্রুপ আছে যারা পুরুষদের বাদ দিয়েছে কারণ তারা বুঝতে পেরেছে, নারী হিসেবে নিজেকে বোঝার জন্য তাদের নারী পরিচয়টি নতুনভাবে আবিষ্কার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা কেবল নিজেদের মধ্যে আরও বেশি আলোচনার মাধ্যমে এটা করতে পারবে। এমন আলোচনা তারা করবে যা সাধারণত তাদের স্বামী, প্রেমিক, ভাই, বাবা বা অন্য কোনো পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার প্রতিনিধির সামনে করতে পারবে না। গভীরতা ও সততার সঙ্গে তাদের কথা বলার প্রয়োজনীয়তা কেবল এভাবেই পূরণ করা যায়। এবং এভাবে তারা সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে একটি গভীরতা তৈরি করতে পেরেছে যা আমার ২৫ বছর বয়েসে সম্ভবও ছিল না, কল্পনাও করা যেত না। তখন যখন আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ নারী বন্ধুর সঙ্গে মিশতাম, সত্যিকার অর্থে নারী সংক্রান্ত সমস্যাগুলো আলোচনা আমরা করতাম না। তবে এখন, প্রথমবারের মতো এসব কনশাস গ্রুপের নারী সংক্রান্ত সমস্যার মুখোমুখি নারীদের গ্রুপের মধ্যে হওয়ার কঠোর প্রবণতার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে। নারীদের মধ্যে প্রকৃত বন্ধুত্ব গড়ে উঠছে। আমি বলতে চাচ্ছি, অতীতে আমাদের বয়স যখন কম ছিল, তখন দেখতাম নারীর সঙ্গে নারীর প্রকৃত বন্ধুত্ব গড়ে উঠত না। সাম্প্রতিক সময়ে তারা বন্ধু হয়ে উঠছে। আগে তারা একে অন্যকে বিরোধী বা শক্র হিসেবে দেখত। কমপক্ষে তারা অন্য নারীকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করত। এখন এসব কনশাস গ্রুপের কারণে, নারীরা শুধু সত্যিকারের বন্ধু হতেই শেখেনি, এছাড়া তারা একে অপরের সঙ্গে উষ্ণ, উন্মুক্ত ও গভীর কোমল হতে শিখেছে: তারা বোনের সম্পর্ক ও সিস্টারহুডকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে, এরকম সম্পর্ক লেসবিয়ান যৌনতায় না জড়িয়েও তৈরি হচ্ছে। অবশ্যই এখানে অনেক লড়াই আছে, এমনকি সামাজিক প্রভাবের সঙ্গে কঠোরভাবে সম্পর্কিত নারীবাদি সংগ্রামেও নারীরা পুরুষদের যোগদানের প্রত্যাশা করে এবং অনেক পুরুষ আছেও। যেমন আমি ফ্রান্সে গর্ভপাতকে বৈধ করার জন্য আন্দোলনের কথা ভাবছি। তিন বা চার বছর আগে, যখন আমরা প্রথম বিশাল একটি বিক্ষোভ করেছিলাম, আমার মনে আছে বিশাল সংখ্যক পুরুষও যোগ দিয়েছিল। এর মানে এই নয় যে তারা সেক্সিস্ট নন। কারো মনে ও ব্যবহারে একেবারে শিশুকাল থেকে যে ধারণার গোড়াপত্তন হয় তা সমূলে উৎপাটন করতে বছরের পর বছর লাগে, এমনকি কয়েক দশকও লেগে যায়। কিন্তু ওই পুরুষরাই কমপক্ষে তারা সমাজে সেক্সিজমের ব্যাপারে সচেতন হয়েছে ও এর বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছে। এরকম ক্ষেত্রে পুরুষরা স্বাগতম। বস্তুত, বরং উৎসাহ দেওয়া হয় যাতে তারা সংগ্রামে জড়িত হয়।

জেরাসি: কিন্তু এরকম প্রচুর গ্রুপ আছে, ফ্রান্সে ত আছেই, যারা নিজেদের গর্বিতভাবে বিচ্ছিন্নতাপন্থী হিসেবে দাবি করে ও তাদের লড়াইকে কঠোরভাবে সমকামী (Lesbian) বলে ব্যাখ্যা করে।

বোভোয়ার: চলুন ব্যাপারটি তাহলে ঠিক করি। এমএলএফ (ওম্যান্স লিবারেশন মুভমেন্ট) এর মধ্যে অনেক গ্রুপ আছে যারা নিজেদের লেসবিয়ান বলে। এমএলএফ ও কনশাস গ্রুপের কল্যাণে এখন বহু নারী খোলাখুলিভাবে বলার সামর্থ্য অর্জন করেছে, হ্যাঁ, তারা লেসবিয়ান। এ বিষয়টি দারুণ।  তবে বিষয়টি মোটেও তা ছিল না। এরকম বহু নারী আছেন যারা রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে গিয়ে লেসবিয়ান হয়ে উঠেছেন, অর্থাৎ, তারা লেসবিয়ান হওয়াকে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অংশ বলে মনে করেন— এটি বর্ণবাদী সংগ্রামের ‘ব্ল্যাক পাওয়ার’ পৃষ্ঠপোষকদের যৌন সংগ্রামের মতো। এবং এটা সত্য, এসব নারীরা তাদের সংগ্রাম থেকে পুরুষদের বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও কঠোর মত প্রকাশ করে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, তারা সর্বত্র নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইরত অসংখ্য সংগ্রামকে অগ্রাহ্য করছে। উদাহরণস্বরূপ, যখন তরুণ মাওবাদী সংগঠক পিয়েরে ওভেরনকে রেনাল্টের ফ্যাক্টরিতে একটি বিক্ষোভ ঠেকাতে গার্ডরা ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করে তখন এর প্রতিবাদে ফ্রান্সের প্রত্যেক বামপন্থী গ্রুপ প্যারিসের রাস্তায় নেমে আসে, তখন এই কথিত র‌্যাডিক্যাল লেসবিয়ান বিচ্ছিন্নতাপন্থী প্রত্যেকটি গ্রুপ বিক্ষোভে যোগ দেয় এবং কবরে ফুল দেয়। এটা অন্যদিকে আবার এটা বোঝায় না যে, শুধু ব্যক্তি পিয়েরের জন্য তারা সংহতি প্রকাশ করেছে। বরং রাষ্ট্র যে নারী ও পুরুষ সবাইকে শোষণ ও নির্যাতন করছে, তারা এই প্রতিবাদ তার বিরুদ্ধে করছে।

জেরাসি: আমেরিকান ক্যাম্পাসগুলোতে সম্প্রতি এক জরীপে দেখা গেছে, নারী মুক্তির সংগ্রামের কারণে পুরুষের অক্ষমতা বেড়েছে। বিশেষ করে সেইসব পুরুষদের অক্ষমতা বেড়েছে যারা যৌন বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার চেষ্টা করছেন।

বোভোয়ার: এটা তাদের সমস্যা। তারা তখন রোল প্লে করার চেষ্টা করছে…।

জেরাসি: কিন্তু স্পষ্টতই, ব্যাপারটি হলো তারা আগে যে ভূমিকা পালন করত সে ব্যাপারে সচেতন হয়েছে। তারা এখন বুঝতে পারছে— বরং মাচো, স্বার্থপর, পুরোষোচিত ধরণের হওয়াই সহজ, তাদের বোধ জেগেছে তারা আগে প্রায়ই ভাবতেন তারা শুধু নারীদের সঙ্গে প্রেম করতে বা শুতে চাইতেন অথবা তাদের সিডিউস করতে চেষ্টা করতেন, কেননা এটাই তাদের কাছে প্রত্যাশা করা হয়।

বোভোয়ার: তারা আগে যা করত অর্থাৎ যা তাদের জন্য সহজ ও যৌনতৃপ্তি দিত— এখন তারা তা করছে না। তারা নারীদের যৌনতৃপ্ত করতে অতিরিক্ত চাপ নিচ্ছে যা তাদের নিজেদের তৃপ্ত হতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এটা খুবই খারাপ। তারা যদি তাদের সঙ্গী নারীর প্রতি সত্যিকারে কামনা অনুভব করে এবং তাদের সম্পর্ক যদি সৎ হয় তবে তারা উভয়কেই সন্তুষ্ট করার কথা ভাববে। এখন তারা (সেক্সিজমের বিরুদ্ধে লড়াইরত পুরুষরা) যদি তাদের নারী সঙ্গীকে তৃপ্তি না দিতে পারে তবে সেক্সিস্ট হিসবে জাজ হওয়ার ভয়ে আরও বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে যায়, তাই তারা ভাল পারফর্ম করতে পারে না।  এ জাতীয় পুরুষরা অক্ষম এই কারণে যে তারা এক দ্বন্দ্বের মধ্যে বাস করে। এটা খারাপ ব্যাপার, যেসব পুরুষ সেক্সিজমের বিরুদ্ধে, তাদের মধ্যে এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এটি নারী আন্দোলনের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর ব্যাপার। যেখানে পুরুষের বড় একটা অংশ নারী আন্দোলন থেকে ফায়দা লুটছে, বেশিরভাগ পুরুষ নারী আন্দোলনের কারণে নারীদের জন্য জীবন আরও কঠিন করে তুলছে।

জেরাসি: ফায়দা?

বোভোয়ার: কিছুক্ষণ আগে এমএলএফ কীভাবে নারীদের সিস্টারহুড অর্জনে সাহায্য করেছে তা আলোচনা করেছিলাম। একে অপরের প্রতি মোহ, স্নেহ ইত্যাদি গড়ে তুলছে। এটি হয়ত আপনার এ ধারণা তৈরি করেছিল যে আমি মনে করছি নারীরা এখন অধিক সুবিধাজনক জায়গায়। আসলে তারা নয়। লড়াই মাত্র শুরু হয়েছে। এবং প্রাথমিক স্তরগুলোতে এটা জীবনকে আরও কঠিন করে তুলছে। প্রচার প্রচারণার কারণে নারী নির্যাতনের ব্যাপারে অসচেতন পুরুষদেরও মুখে মুখে আজকাল ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি লেগেই থাকে। পুরুষদের এখন স্বাভাবিক একটি দৃষ্টিভঙ্গি হলো, ‘ঠিক আছে, তুমি এখন স্বাধীন, চলো বিছানায় যাই’। অন্যকথায় পুরুষরা এখন আরও বেশি হিংস্র, অশ্লীল ও আক্রমণাত্মক। আমাদের সময়ে আমরা মন্টপার্নেসের যেকোনো ক্যাফেতে উত্যক্ত না হয়েও বসতে পারতাম। আমরা হাসাহাসি, চোখাচোখি, দৃষ্টিবিনিময় সবই করেছি। কিন্তু এখন কোনো ক্যাফেতে বসে উত্যক্ত না হয়ে কিছুক্ষণ বই পড়া কোন নারীর পক্ষে অসম্ভব। এবং কোনো নারী যদি একা থাকার ব্যাপারে দৃঢ় থাকে তবে তাকে প্রায়শই কুত্তি বা বেশ্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এখন ধর্ষণের ঘটনাও অনেক অনেক বেড়েছে। সাধারণভাবে এই শহরে এখন পুরুষের আগ্রাসন ও শত্রুভাবাপন্নতা বেড়েছে, এবং আমেরিকার শহরগুলোর ব্যাপারেও আমি তাই শুনি। অবশ্যই নারীদের ঘরে রাখার জন্য এমনটা হচ্ছে। এটাই পুরুষদের আগ্রাসনের পিছনে মূল কারণ। তারা এখন এমন আচরণ করছে, যেসব নারীরা ঘরে থাকেন তারাই শুধু পুত পবিত্র, বাকিরা সহজেই তাদের কাছে চিহ্নিত। যখন নারীরা এরকম সহজে চিহ্নিত হতে রাজি না হয় তখন পুরুষটি ব্যক্তিগতভাবে তা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়। তাদের একটাই ধারণা, ওই নারীটিকে বাগে আনো।

জেরাসি: তাহলে ওই মিথটির কী হলো? প্রতিটি ফরাসী পুরুষই যে মিথটিকে সমর্থন করে, যেটা আসলে মোটেও সত্য নয়, যে ‘প্রেম করা (Lovemaking) একটি শিল্প এবং সে এই কাজে সকল শিল্পীদের সেরা’।

বোভোয়ার: সমাজে অতি ধনী একটি পরজীবী শ্রেণি ছাড়া এই মিথটি এখন সবার কাছে মৃত। ফরাসি পুরুষরা এখন আমেরিকান বা ইতালিয়ান পুরুষদের মতো আচরণ করে। যেমনটি শুনেছি, তারা এখন শুধু স্কোর বাড়াতে চায়। এবং যারা তাদের নিজের যৌন বৈষম্যগত আচরণ দমনের চেষ্টা করে সেরকম খুব স্বল্প সংখ্যক পুরুষ বাদে বাকিরা মনে করে নারীরা যত বেশি মুক্ত ও স্বাধীন হতে চায়, পুরুষের এই জগতে যে নারী যত বেশি শারীরিক ও ক্যারিয়ারগত লড়াই করে— পুরুষরা ভাবে সেই নারীকে বিছানায় নিয়ে যাওয়া তত সহজ।

জেরাসি: নারী মুক্তির অনেক কথা আমাকে ধাঁধায় ফেলে দেয়। আমাদের সমাজে অর্থ ও ক্ষমতা দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়। প্রায় এক দশক নারী আন্দোলনের পর আজ  নারীদের কি ক্ষমতা আছে?

বোভোয়ার: আপনি যে অর্থে জিজ্ঞেস করছেন, এর উত্তর হলো ‘না’। বুদ্ধিজীবী, তরুণী নারীরা যারা প্রান্তিকরণের ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক, ধনী কন্যারা যখন তাদের পিতামাতার মূল্যবোধকে ত্যাগ করতে ইচ্ছুক ও সমর্থ, তখন হ্যাঁ, তারা আরও স্বাধীন। তারা তাদের শিক্ষা, লাইফস্টাইল অথবা আর্থিক সংস্থানের কারণে কঠোর প্রতিযোগিতামূলক সমাজ থেকে সরে আসতে পারে ও একটি নতুন কমিউনিটি বা সমাজের প্রান্তে বাস করতে পারে। যেখানে তারা তাদের সমস্যাগুলোর সঙ্গে মিল আছে এবং সমস্যা সম্পর্কে সংবেদনশীল এরকম অন্য নারী পুরুষের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক উন্নতি করতে পারে এবং নিজেকে আরও স্বাধীন ভাবতে পারে। অন্য কথায়, ব্যক্তিগতভাবে যেসব নারী এটি করতে সামর্থ্যবান তারা নিজেকে আরও বেশি স্বাধীন মনে করতে পারে। কিন্তু একটি শ্রেণি হিসেবে নারী অবশ্যই স্বাধীন নয়। ঠিক ওই কারণে, যেমনটি আপনি বলছিলেন তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা নেই। মহিলা আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, ডাক্তার, নির্বাহী, ইত্যাদির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তা প্রমাণ করার জন্য আজকাল বিভিন্ন ধরণের পরিসংখ্যান রয়েছে। কিন্তু এ ধরণের পরিসংখ্যান ভুল পথে পরিচালিত করে। ‘ক্ষমতাবান’ নারী আইনজীবী বা নির্বাহীর সংখ্যা এসব পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় না। কতজন নারী চিকিৎসক হাসপাতালের পরিচালক পদে রয়েছেন? সরকারে নারীদের অবস্থান কী ? হ্যাঁ কিছু আছে। যেমন এখন ফ্রান্সে দুই জন আছেন। একজন খুবই সিরিয়াস, কঠোর পরিশ্রম করেন, সিমন ভয়েল- তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী। আরেকজন ফ্রাঙ্কইসে জিরোদ, যিনি নারী বিষয়ক মন্ত্রী, শুধুই একজন শো পিস। যার কাজ হলো বুর্জোয়া নারীদের স্বার্থ দেখভাল করা। কিন্তু কয়জন নারী সিনেট নিয়ন্ত্রণ করেন? কতজন নারী সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় নীতিমালা নিয়ন্ত্রণ করেন? বিচারক কতজন নারী? কতজন ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট? কতজন আর্থিক উদ্যোগ নিয়ন্ত্রণ করেন? শুধুমাত্র মাঝারি স্তরে নারীর সংখ্যা দ্বারা এটি বুঝায় না যে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। এমনকি মাঝারি স্তরের এসব নারীরা কর্মক্ষেত্রে পুরুষের লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করেন। এখন এর অর্থ এই নয় যে , নারীদের অগ্রগতি হয়েছে এটা আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু অগ্রগতি জিনিসটা হলো সম্মিলিত কর্মের ফলাফল। যেমন সিমন ভয়েলের প্রস্তাবিত নতুন গর্ভপাত আইনটির ব্যাপারেই বলি। গর্ভপাত যদিও জাতীয় স্বাস্থ্য কর্মসূচীর আওতায় পড়বে না, এ কারণে এটি দরিদ্র নারীদের চেয়ে ধনী নারীদের জন্য বেশি সহজলভ্য হবে তবুও এই আইনটি অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ। সিমন ভয়েল এই আইনটির জন্য গুরুত্বের সঙ্গে লড়াই করতে পেরেছেন কেননা হাজার হাজার নারী এই আইনের জন্য সমস্ত ফ্রান্স জুড়ে আন্দোলন করেছেন, প্রকাশ্যে দাবিদাওয়া তুলেছেন। তারা প্রকাশ্যে জানিয়েছেন তাদের গর্ভপাত হয়েছে। এ জন্য সরকার চাপে পড়েছে— হয় তাদের বিচার করতে হবে নতুবা গর্ভপাতকে বৈধ করে আইন পরিবর্তন করতে হবে। যখন কিছু লোক ব্যাপারটিকে আদালতে নিয়ে যেতে চাইলো তখন বহু চিকিৎসক ও আয়া দাবি করেছেন, হ্যাঁ তারা নারীদের গর্ভপাত করিয়েছেন। এখন তাদেরও বিচার করতে হবে। আমি বলতে চাইছি যে গণআন্দোলনের মাধ্যমে নারীরা ক্ষমতা পেতে পারে। যত বেশি নারী এরকম গণআন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারবেন তত বেশি অগ্রগতি অর্জিত হবে। এবং ওই যে, যেসব নারীরা ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেন, তারা তাদের বন্ধুবান্ধব, বোনদের যত বেশি প্রভাবিত করতে পারবে তত বেশি সচেতনতা ছড়িয়ে পড়বে। যার ফলে যখন সিস্টেমের কারণে হতাশা বাড়বে তখন গণআন্দোলন উদ্বুদ্ধ হবে। অবশ্যই যত বেশি সচেতনতা ছড়িয়ে পড়বে, পুরুষরা তত বেশি আক্রমণাত্মক ও হিংস্র হয়ে উঠবে। কিন্তু পুরুষ যত বেশি আক্রমণাত্মক হবে লড়াই করার জন্য তত বেশি নারীর প্রয়োজন হবে, অর্থাৎ গণআন্দোলনের প্রয়োজন তত বেশি স্পষ্ট হবে।

জেরাসি: আপনি গত বছর আমাকে বলেছিলেন নারীদের উপর আরেকটি বই লেখার পরিকল্পনা করছেন। সেকেন্ড সেক্সের ফলোআপ ধরণের কিছু। লিখছেন কি ?

বোভোয়ার: না, প্রথমত এই ধরণের কাজ সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হতে হবে। এবং দ্বিতীয়ত, তত্ত্বের চেয়ে অনুশীলনে নিবদ্ধ হওয়া উচিত। সেকেন্ড সেক্স অন্য উপায়ে চলে গিয়েছিল। এখন আর তা প্রযোজ্য নয়। এটি এখন অনুশীলনের মধ্যে চলে এসেছে যে, কেউ চাইলে দেখতে পারে শ্রেণি সংগ্রাম ও লিঙ্গ সমতার সংগ্রামের মধ্যে কীভাবে আন্তঃসংযোগ ঘটে বা কমপক্ষে কীভাবে তারা প্রকাশিত হতে পারে। কিন্তু সকল সংগ্রামের ক্ষেত্রেই এটি সত্য, আমাদের অনুশীলন থেকে তত্ত্ব আহরণ করা উচিত। যেটা প্রয়োজন তা হলো সব ধরণের দেশ থেকে সব ধরণের নারীর অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করে একত্রিত করা এবং এসব নমুনা থেকে সবার অভিজ্ঞতা অর্জন করা। নারীরা কোন জায়গায় কী জাতীয় সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তা জানা দরকার। এ ধরণের তথ্য সব শ্রেণির নারীর কাছ থেকে সংগ্রহ করা উচিত। এটি অবশ্যই শক্ত কাজ। সর্বোপরি, আজ যারা নারী মুক্তির জন্য সংগ্রাম করছে তারা সবাই বুর্জোয়া শ্রেণির বুদ্ধিজীবী নারী। বিপরীতে বেশিরভাগ শ্রমজীবী নারী মূলত মধ্যবিত্ত মূল্যবোধে বিশ্বাস করেন। উদাহরণস্বরূপ, পতিতাদের অধিকারের ব্যাপারে নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে দেখুন। ধারণাটি বেশিরভাগ শ্রমজীবী নারীকে বিস্মিত ও মর্মাহত করবে। এরকম নারী শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো খুব ধীর প্রক্রিয়া। এখানে আসলে বিশাল কৌশলের প্রয়োজন। আমি জানি এমএলএফ- এর কিছু চরমপন্থী এক্টিভিস্ট আছেন যারা শ্রমজীবী মহিলাদের নির্যাতনকারী স্বামীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করানোর চেষ্টা করেন। আমি মনে করি এটি একটি ভুল। যেমন এখানে, ফ্রান্সে, একজন শ্রমিকের স্ত্রী সহজেই উত্তর দেবে, ‘আমার শক্রু আমার স্বামী নয়, আমার বস’। কারখানায় পুরো দিন কাজ করে এসে যদি স্বামীর মোজা ধুয়ে দিতে হয় বা স্বামীর জন্য রান্না করতে হয়, তবুও শ্রমজীবী নারীটি এরকম জবাবই দেবে। আমেরিকায়ও একই ব্যাপার। সেখানে তো কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা সাদা চামড়ার নারীদের আন্দোলনে যোগই দেয়নি। এ ধরণের কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা শোষিত হওয়া সত্ত্বেও তাদের কৃষ্ণাঙ্গ স্বামীর সমর্থক ছিলেন। তারা নির্যাতক স্বামীকে সমর্থন দিত শুধুমাত্র এই কারণে— যে নারী তাদের শোষণের বিরুদ্ধে সচেতন করতে চাইছে তার গায়ের চামড়া সাদা। তবে আস্তে আস্তে বুর্জোয়া নারীবাদীরা শ্রমজীবী নারীদের জীবনে ঢুকতে পেরেছেন। এখন আমেরিকায় অল্প সংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ নারীও বলছেন— ‘না, আমাদের পুরুষ সঙ্গীটির শুধুমাত্র গায়ের চামড়া কালো বলে তার শোষণের ইচ্ছার কাছে আমরা নিজেকে সমর্পণ করতে পারি না। আমরা কালো চামড়ার সবাই মিলে সাদা চামড়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করব এটি হতে পারে না। আমাদের স্বামীরা কৃষ্ণাঙ্গ বলে তারা চাইলেই আমাদের নির্যাতন করতে পারে না।’

আসলে কিছু দৃঢ় পন্থায়, শ্রেণি সংগ্রাম যৌন সমতার সংগ্রামকে উৎসাহিত ও বিকশিত করছে।  উদাহরণস্বরূপ, গত কয়েকবছর ফ্রান্সের কারখানায় এমন অনেক আন্দোলন হয়েছে যেখানে আন্দোলনকারীদের প্রায় সবাই নারী। এমন প্রত্যেকটি আন্দোলনে নারীরা শুধু নতুন চেতনাই লাভ করেনি বরং তাদের শক্তি ও ক্ষমতার ব্যাপারে নতুন বিশ্বাস জেগেছে তাদের মধ্যে। এতে তারা বাড়িতেও পুরুষ নির্যাতকদের বিরুদ্ধে লড়ার সাহস পাচ্ছে।

যেমন লিপে যে আন্দোলনটি হলো। সেখানে পুলিশের হুমকি সত্ত্বেও তাদের দাবি আদায়ে নারীরা কারখানাটি অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। প্রথমে আন্দোলনকারী এসব নারীদের স্বামীরা তাদের সংগ্রামী যোদ্ধা স্ত্রীদের জন্য খুবই গর্বিত হয়ে উঠলো। তারা সংগ্রামরত স্ত্রীদের জন্য খাবারদাবার এনে দিতে লাগল। তারা পাহারায় বিভিন্ন চিহ্ন তৈরি করার কাজে সাহায্য করতে লাগল ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যখন সংগ্রামী নারীরা লিপে কাজ করা কিছু পুরুষের সমান হতে চাইলো- এসব পুরুষরা আবার আন্দোলনেও জড়িত ছিল- তখনই পুরুষরা বেঁকে বসলো। পুরুষদের সমস্যা শুরু হলো।

জেরাসি: আপনি কি আশাবাদী? আপনি কি মনে করেন যে পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করছেন তা ঘটবে?

বোভোয়ার: আমি জানি না। আমার জীবদ্দশায় কোনভাবেই নয়। হয়ত আরও চার প্রজন্ম পরে হতে পারে। আমি বিপ্লবের ব্যাপারে জানি না। কিন্তু নারীরা যে পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করছে, হ্যাঁ আমি নিশ্চিত, দীর্ঘমেয়াদে নারীদের জয় হবেই।