সহজ ঈদ
শাওন মাহমুদ।। আমার সহজ কিছু স্বপ্ন আছে। আমাদের সন্তানেরা হাত ধরাধরি করে বিকেলে সবুজ ঘাসে খেলতে নামছে, মায়েরা সেই ঘাসের বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে, প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াচ্ছে, পাখীরা গান গাচ্ছে, পেঁজা পেঁজা মেঘ নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে, সোনালী রোদ্দুর সবার গায়ে সোনালু আভা মাখাচ্ছে। চোখ বন্ধ করলেই আমি দেখতে পাই, সুন্দর স্বপ্নের প্রতিটা দৃশ্য, একদম স্বচ্ছ, ঝকঝকে পরিস্কার।
গত দুই মাস বাক্সবন্দী জীবন আমাদের, করোনাকাল এক অবসাদ মাখানো বাতাস হয়ে ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইতিহাসের দীর্ঘতম ছুটিতে আছে পুরো দেশ। সেই ছুটিতে আনন্দ নেই, আছে অনিশ্চয়তা। স্কুল ছুটির মহা উৎসবে মুখরিত হচ্ছে না আর শিশুরা। দীর্ঘ বাক্সবন্দী জীবন যাপনে আমাদের অনেকের মাঝে গভীর বিষন্নতা ভর করেছে। একই চক্রে ঘূর্ণায়মাণ সারাটা দিনের কাজে ক্লান্ত হচ্ছে পরিবারগুলো। টিউশনি করে পকেট খরচ চালানো ছাত্রগুলোর হাত খালি হয়ে আসছে। ঘরে বসে অফিস করবার অভ্যাস হচ্ছে অনেকের। প্রতিবেলায় খেটে খাওয়া মানুষগুলো ধীরে ধীরে নিস্তেজ হচ্ছে। মধ্যবিত্তদের সঞ্চয় শেষ হয়ে আসছে। ভীত হয়ে উঠছি আমরা, আড্ডায় মেতে থাকা মানুষগুলোকে দূরে ঠেলে দিচ্ছি। বন্ধুদের সাথে শপিং করতে যাওয়াটা, কেমন বেমানান শোনায়।
তারপরও আমি সবুজ স্বপ্ন দেখি, প্রতিদিন দেখতে থাকি, তাগিদ না থাকলে বেঁচে থাকাটা অর্থময় হয় না তাই জন্য।
একাত্তরে বাবা হারিয়ে যাওয়ার পর আমাদের বাসায় কখনই খুব বিশাল আয়োজনে ঈদ পালন হয়নি। সত্যি বলতে কোন বিশেষ দিনই আর সেভাবে পালন হয় না। ঈদের দিনেও থাকে অতি সাধারণ রান্না, ছিমছাম উপহার। সহজ ঈদ পালনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি সেই ছেলেবেলা থেকে। ক্রমশ পরিবার বড় হয়েছে, আপন ছাড়িয়ে পরেরা কাছে এসেছে। গত হওয়া বেশ কিছু বছর ধরে গুটিকয়েক মানুষ ঈদের দুপুরে আমাদের বাসায় খাওয়ার অভ্যাস করেছে। ওদের দাওয়াত দিতে হয় না। অভ্যাস মতন চলে আসে দুপুরের আগে। তাদের দুজনের ঢাকা শহরে কেউ নেই, একজনের পৃথিবীতেই কেউ নেই, আরেকজনের বাড়িতে ঈদ পালন হয় না, এই তো এমন করে আরো কয়েকজন।
গতকাল থেকে ভাবছিলাম, এবার তাদের ছাড়া আমাদের একা ঈদ পালন করতে হবে। কারো আসবার উপায় নেই। খুব সাধারণ রান্নায় সবাই মিলে একসাথে হইচই করে দুপুরে খাবো। সহজ ঈদে অভ্যস্ত ছিলাম, তাই বলে সহজ মানুষগুলোকে ছাড়া ঈদের দুপুরে খাবার টেবিলে সময় কাটাবো, এমনটা হবে, কখনও ভাবিনি আগে।
তারপরও অপেক্ষায় থাকি, একসময় আবারও আমরা একসাথে দুপুরে খেতে বসবো। আড্ডায় মাতিয়ে রাখবো চারিদিক। ওই যে, সহজ তাগিদ না থাকলে জীবনের অর্থ অসম্পূর্ণ হয়ে যায়।
গত দুইমাস ধরে বাক্সবন্দী জীবন সবার। এ ঘর থেকে ও ঘর শুধু। সতেজ খাবার কবে নিজে কিনতে গিয়েছিলাম, মনে করতে পারছি না। অনালাইনে অর্ডার করতে গিয়ে থমকে থাকি। এ কেমন বাজার! ছবি দেখে দেখে জানাতে হয় আমাদের কী প্রয়োজন! রোজা শেষে ঈদ এসেছে। বাক্সবন্দী জীবনে সন্তানেরাও আর ঈদের নতুন জামা জুতো কিনে দেয়ার বায়না ধরেনি, পরিবারের সবার সাথে সময় কাটানোর অভ্যাস করেছে।। আমি বিশ্বাস করি ওরা আমার মতন স্বপ্ন দেখে। ওদের মাঝেও তাগিদ তৈরি হয়েছে। ওরাও জানে তাগিদ না থাকলে বেড়ে ওঠার মাঝে কোন সুখকর মুহূর্ত থাকে না।
আমরা অভ্যস্ত হতে শিখেছি, করোনার সাথে তাল মিলিয়ে জীবন টেনে নিয়ে যাওয়ার অভ্যাস করতে হয়েছে, আমাদের সবার। করোনা কাল পার হবে, সবাই বিশ্বাস করছি, করতে হচ্ছে। তাগিদ না থাকলে জীবন যাপনে কোন অর্থ থাকে না। হয়তো তাই বেঁচে থাকবার জন্য মরিয়া হয়ে আছি আমরা। ঈদের মতন বিশেষ দিনটিকেও সহজ করে নেয়ার অভ্যাস করছি। তবে ধাপে ধাপে নিজেদের সহজ অবস্থান থেকে নেমে আসা জীবন যাপনের কঠিন ধাক্কাগুলো কে কতটা সামলাতে পারবে, আমাদের কারো জানা নেই।