December 23, 2024
সাহিত্যফিচার ৩প্রবন্ধ

কবি নজরুল ও নারীবাদ

রুদ্র ফারাবী।। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার সাহিত্য সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই ব্রিটিশ শাসন-শোষনের বিরোধীতাসহ সমাজের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের পক্ষে তার লেখনী পরিচালনা করেছেন। বলার অপেক্ষা রাখেনা বাঙালি সমাজে শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত ও নিগৃহীত নারীসমাজ। কবি কাজী নজরুল তাঁর সাহিত্যকর্মের শুরু থেকেই নারীর মুক্তি ও জাগরণের লক্ষ্যে কলম ধরেছিলেন। নারীর সমানাধিকার, অবরোধ প্রথার বিরোধীতা এবং নারী জাগরণের আহ্বান তাঁর বিভিন্ন রচনায় পাওয়া যায়। এই নিবন্ধে বাংলার নারীজাগরণের অনুঘটক, অনুপ্রেরক ও অন্যতম রূপকার নজরুল কীভাবে তাঁর সাহিত্যে বিশেষত কবিতাতে নারীকে মহিমান্বিত করে উজ্জীবিত করেছেন তার একটি চিত্র ছোট পরিসরে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছি।

বাংলার সামাজিক জীবনে নারীরা যেমন উপেক্ষিত ছিল, সাহিত্যেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। বিশেষত, মুসলমান নারীর অবস্থান ছিলো আরো শোচনীয়। কাজী নজরুল যখন থেকে সাহিত্য সাধনায় ব্যাপৃত হন তখন থেকেই সমাজে নারীর প্রতিষ্ঠা ও যথোচিত মর্যাদা দেয়ার জন্য যেমন তিনি প্রবন্ধ রচনা করেন, তেমনই গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও নাটকে চিত্রিত করেন অসংখ্য নারীমূর্তি। মূলত তার লেখায় নারীজীবনের বহুমুখিতা এবং মুসলিম নারীর জাগরণী মন্ত্রনা ব্যাপকভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে।

বাঙালি সমাজে নারীর পশ্চাৎপদতা ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। সমাজে নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। কাজী নজরুল যেমন নিজ জীবনে ধর্ম-বর্ণের উর্ধ্বে উঠে নারীত্বের মহিমাকে শ্রদ্ধা করেছেন তেমনিই সাহিত্যেও তাঁর নারীরা হয়ে উঠেছে মুক্ত জীবনসন্ধানী। নারীর সমানাধিকারের প্রশ্নে তাঁকে যেমন ঘোষনা করতে হয়েছে-

‘‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যানকর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’’।

তেমনই এই যুক্তির সঙ্গে নারীর  অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাদের অগ্রগামী হওয়ার আহ্বানেও তাঁর কণ্ঠ ভীষন জোড়ালো – ‘‘জাগো নারী জাগো বহ্নি শিখা’’।

সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিসরের সবদিক থেকেই নারী সমাজ আজো অবহেলিত। যুগ যুগ ধরে এ অবস্থা বিরাজমান আছে। কাজী নজরুল তাঁর জীবন ও কর্ম সাধনার মাধ্যমে অবহেলিত নারীর সামাজিক মর্যাদা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষায় তাদের অধিকার নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন নারীর অবরোধ ও অধিকার হরণের হোতা পুরুষ হলেও – নারী নিজেও এর জন্য দায়ী। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যারা শৃঙ্খলিত হয় তাদের মধ্যে যদি শৃঙ্খল দূর করার অভিলাষ না থাকে তাহলে মুক্তি আসা অসম্ভব। পুজিঁবাদী বিশ্বের নিয়ম হচ্ছে একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকা। পুঁজিবাদ সবসময়ই একে অপরকে ঠকিয়ে শোষন লিপ্সা বিস্তার করে ব্যাক্তি সাফল্য অর্জনের মন্ত্রনা দেয়। এ সমাজ ব্যবস্থায় কে বন্ধু কে শত্রু সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে কীভাবে নিজেকে টিকিয়ে রাখা যায় সেই কৌশল। তাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আমরা যাদের শৃঙ্খলিত হতে দেখি শোষন বঞ্চনায় সেই পুরুষও একই সঙ্গে বঞ্চিত নারীকে আলাদাভাবে শোষন করে। তাই সামগ্রিকভাবে শোষন শৃঙ্খল থেকে মুক্তি অর্জন করতে চাইলে নারীকেই এগিয়ে আসতে হবে বলে নজরুল মনে করেছেন। অবশ্যই এ সংগ্রাম নারীর একার নয়, পুরুষেরও দায়িত্ব রয়েছে। আবার নারীকেও মনে রাখতে হবে কেউ কাউকে স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে ছাড় বা অধিকার দেয় না। অধিকার পেতে হলে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে- যা শ্রমে, কর্মে, শিক্ষায়, নেতৃত্বে সকল ক্ষেত্রে সকল পর্যায়ে পুরুষের পাশে, হাতে হাতে – একসাথে হতে হবে ।

কবি নজরুল বুঝতে পেরেছিলেন পুরুষের অবরোধ আরোপের পথকে সুগম করেছে নারীর অশিক্ষা। সমকালীন মুসলিম নারী সমাজের বেদনা ও বিড়ম্বনা নজরুল মনে প্রানে উপলব্ধি করেছিলেন। নারীকে অবরুদ্ধ করে তাদের যেভাবে হীনমন্যতার গহ্বরে নিক্ষেপ করা হচ্ছে সেখানে অন্ধকার সহজেই বিস্তার লাভ করে থাকে। নজরুল নারী শিক্ষার গুরুত্ব যর্থাথভাবে বুঝতে পেরে লিখেছেন-

‘‘কন্যাকে পুত্রের মতই শিক্ষা দেওয়া যে আমাদের ধর্মের আদেশ তাহা মনেও করিতে পারি না। আমাদের কন্যা জায়া জননীদের শুধু অবরোধের অন্ধকারে রাখিয়াই ক্ষান্ত হই নাই, অশিক্ষার গভীরতর কূপে ফেলিয়া হতভাগিনীদের চিরবন্দিনী করিয়া রাখিয়াছি। আমাদের শত শত বর্ষের এই অত্যাচারে ইহাদের দেহ মন এমনি পঙ্গু হইয়া গিয়াছে যে, ছাড়িয়া দিলে ইহারাই র্সবপ্রথমে বাহিরে আসিতে আপত্তি করিবে। ইহাদের কীসে দুঃখ কীসের যে অভাব তাহা চিন্তা করিবার শক্তি পর্যন্ত ইহাদের উঠিয়া গিয়াছে।” (তরুনের সাধনা, নজরুল রচনাবলী, ৪র্থ খন্ড, পৃ: ৯৬)

তাই এটা স্পষ্ট যে নজরুল আন্তরিকভাবেই সমাজ প্রগতির লক্ষ্যে নারীর অবরোধ প্রথার বিলোপ এবং তাদেরকে শিক্ষার আলোকে আলোকিত করার পক্ষে ছিলেন।

নজরুল সমকালে নারী সমাজের মুক্তির লক্ষে যারা একনিষ্ঠভাবে সংগ্রামে অবর্তীন হয়েছিলেন তাদের মধ্যে অগ্রনী ছিলেন বেগম রোকেয়া। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর হিসাবে কাজ করেছিলেন মিসেস এম. রহমান, বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ, বেগম সুফিয়া কামাল প্রমুখ। নজরুল তাঁদের সঙ্গে শুধু চিন্তা চেতনাতেই একান্ত ছিলেন না, কর্ম প্রেরণায়ও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। এ কারণে ‘সাম্যবাদী’ (১৯২৫) ও ‘র্সবহারা’ (১৯২৬) প্রকাশিত হলে সেখানে তার নারীজাগরণের পূর্ণ চেতনা প্রকাশিত হয় সুস্পষ্টভাবে। ‘সাম্যবাদী’ কাব্যের ‘নারী’ কবিতায় নজরুল যে বিষয়টির প্রতি সমধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন তা হচ্ছে সমানাধিকারের প্রসঙ্গ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কখনো কখনো মৌখিকভাবে নারী পুরুষের সমানাধিকারের  ব্যাপারটি স্বীকার করা হলেও বাস্তবক্ষেত্রে অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়। তাই নজরুল ‘নারী’ কবিতায় ঘোষণা করলেন :

‘‘সাম্যের গান গাই,

আমার চক্ষে পুরুষ রমনী কোন ভেদাভেদ নাই,

বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যানকর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

বিশ্বে যা কিছু এল পাপ – তাপ বেদনা অশ্রবারি

অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।”

(নারী, ‘সাম্যবাদী’ নজরুল রচনাবলী, ১ম খন্ড, পৃ ২৪১)

নজরুল অনুধাবন করেছিলেন পৃথিবীর সকল কাজেই নারীর অংশীদারিত্ব রয়েছে। সমাজের চাকা পুরুষ একাই বহন করেনি সেখানে র্সবদা ছিল নারীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহন এবং প্রেরণা।

কোনকালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি,

প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষী নারী।’

(নারী, ‘সাম্যবাদী’ নজরুল রচনাবলী, ১ম খন্ড, পৃ ২৪২)

কিন্তু নারীর সে মহিমা স্বীকার করা হয়না। রচিত হয় না  তার যথাযোগ্য ইতিহাস-

‘‘জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান

মাতা ভগ্নী ও বধুদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।

কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে,

কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।

কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি কত বোন দিল সেবা,

বীরের স্মৃতিস্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?”

(নারী, ‘সাম্যবাদী’ নজরুল রচনাবলী, ১ম খন্ড, পৃ: ২৪২)

নারীর কাজ থেকে এত প্রেরণা, সাহর্চয, সহযোগিতা এবং জগতের জীবনধারার ছন্দ গ্রহন করেও পুরুষ যুগ যুগ ধরে তাদের নানা কায়দায় নানা কৌশলে কোনঠাসা এবং বঞ্চিত করে রেখেছে। অবরুদ্ধ করে রেখেছে তার সত্তাকে, হরণ করেছে স্বাধীনতা এবং বঞ্চিত করছে সবকিছু থেকে – ইতিহাসেও উল্লেখ নেই নারীর অবদানের কথা। এ প্রসঙ্গে নজরুলের কবিতার সাথে আমরা সাদৃশ্য খুঁজে পাই ইংরেজ উপন্যাসিক Jane Austen এ – যিনি তাঁর একটি উপন্যাসে ইতিহাস সর্ম্পকে বলেন “(History) tells me nothing that does not either vex or weary me. The quarrels of popes and kings, with wars or pestilences in every page; the men all so good for nothing, and hardly any women at all, it is very tiresome.”

(Northanger Abbey, Jane Austen) )

ইতিহাসের পাতায় শুধু পুরুষের গৌরব গাঁথা, পৌরুষ পূজা, পুরুষের দম্ভ চিৎকার – র্কম, বন্দনা, বীরত্ব, কৃতিত্ব সব তাদের; – যেন পৃথিবীটা পুরুষের একার। তাই নজরুলের কাছে মনে হয়েছে ‘পুরুষ আজ জালিম নারী আজ মজলুম।’

(নজরুল রচনাবলী, ৪র্থ খন্ড, পৃ ৯৬)

ঊনবিংশ শতাব্দীতে নারী পুরুষের সমানাধিকার প্রশ্নে বাঙালি চিন্তানায়ক বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘সাম্য’ গ্রন্থে ঘোষনা করেছিলেন-

‘‘মনুষ্যে মনুষ্যে সমানাধিকার বিশিষ্ট, স্ত্রী গণ ও মনুষ্য জাতি, এতএব স্ত্রীগণ ও পুরুষের তুল্য অধিকারশালিনী, যে যে কার্য্যে পুরুষের অধিকার আছে, স্ত্রী গণের ও সেই সেই কার্য্যে অধিকার থাকা ন্যায়সঙ্গত।”

(বঙ্কিমচন্দ্র রচনাবলী, ২য় খন্ড, ৯ম মুদ্রণ, সাহিত্য সংসদ ১৩৯২, পৃ ৩৯৯)

নারী পুরুষের কথা মানুষের এই সাম্যের কথা আমরা সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত (Gendered Lives (3rd ed. Wordsworth Publication Company, NY,1998) গ্রন্থের Julia T. Wood  এর লেখাতেও প্রতিধ্বনিত হতে শুনি যিনি নারীবাদকে ব্যাপক পরিসরে দেখেছেন :

““I define feminism as an active commitment to equality and respect for life. For me, this includes respecting all people, as well as nonhuman forms of life and the earth itself. Simply put, my feminism means I am against oppression, whether it be oppression of women, men .elderly people, children, animals or our planet. I don’t accept oppression and domination as worthy human values. I believe there are better, more humane and enriching ways to live and I am convinced we can be part of bringing these alternatives into existence.”

একই গ্রন্থের অন্য একটি প্রবন্ধে কবি ও প্রাবন্ধিক Katha Pollitt বলেন- “To me, to be a feminist is to answer ‘Are women human?’ with a yes. It is not about whether women are better than, worse than or identical with men. It’s about justice, fairness and access to the broad range of human experience. …It’s about women having intrinsic value as persons.human beings, in other words. No more, no less.”

কম ও নয়, বেশিও নয় – সমান সমান – আর ফেমিনিজম মানে পুরুষ বিদ্বেষ নয়, ফেমিনিজম হল মনুষ্যত্বের জয়। পুরুষের এ অন্যায় কতৃর্ত্বের বিরুদ্ধে লড়তে হবে সব মানুষকে তাই নজরুল নারীকে অধিকার সচেতন হবার আহ্বান জানিয়েই ক্ষান্ত হননি। এক্ষেত্রে পুরুষকে যুগ যুগান্তের বদ্ধমূল ধারণা আর নারী শাসনের মনোভাব পরিত্যাগেরও উদার্ত আহ্বান জানিয়েছেন। নারীকে দাসীরূপে ব্যবহার হয়তো পুরনো যুগের ফসল। কিন্তু বর্তমান সভ্যতার আলোকে উদ্ভাসিত পুরুষদের নারী শোষন ও দাসত্ব শৃঙ্খলযুক্ত পুরনো মনোভাব পোষন ঠিক নয়। তিনি যুক্তি দেখাচ্ছেন-

‘‘সে যুগ হয়েছে বাসি

যে যুগে পুরুষ দাস ছিল নাকো, নারীরা ছিল দাসী।

বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,

কেহ রহিবেনা বন্দী কাহার ও, উঠিছে ডন্কা বাজি।”

(”নারী”, ’সাম্যবাদী’ নজরুল রচনাবলী, ১ম খন্ড, পৃ ২৪৩)

নারীর প্রতি এই দাসত্ব মুক্তির আহবান আমরা French Feminist, Helene Cixous Gi ‘The Laugh of the Medusa  প্রবন্ধে ও অনুরণিত হতে শুনি-

‘‘Woman must write herself: must write about woman and bring woman to writing, from which they have been driven away as violently as from their bodies – for the same reasons, by the same law, with the same fatal goal.’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘Woman must write herself: must write about woman and bring woman to writing, from which they have been driven away as violently as from their bodies – for the same reasons, by the same law, with the same fatal goal.’’

‘‘I write this as a woman, toward woman. When I say ‘woman’, I’m speaking of woman in her inevitable struggle against conventional man; and of a universal woman subject who must bring women to their senses and to their meaning in history.”

আমরা দেখতে পাচ্ছি নজরুল সময়ের তুলনায় এতটাই প্রগতিশীল ছিলেন যে তিনি নারীর যে ‘struggle’ এর কথা ১৯২৫ সালে বলে গিয়েছেন তা প্রতিধ্বনিত হতে শুনি French Feminist Helene Cixous’র প্রবন্ধেও, যা লেখা হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। ওই সময়ে তিনি বলেন, পুরুষের এই নিপীড়ন নারীকে অন্ধকার জগতে ফেলে রেখেছে এবং সে অবস্থা মেনে নিতে নারীকে বাধ্য করা হয়েছে পুরুষের আপন স্বার্থে।

তাই এ শুধু আজ যুগের দাবিই নয় মানবতাবাদী দৃষ্টিতে ও বিচার করলে দেখা যাবে যে পরপীড়ন অন্যায় ও গর্হিত। পুরুষ যেভাবে নারীদের উপর অত্যাচার নিপীড়ন চালায় হয়তো কালের ধর্মে তা উল্টে গিয়ে একদিন নিজেদের ঘাড়েই পড়বে। তিনি পুরুষদের চেতনাদীপ্ত করতে লিখেছেন-

‘‘নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে

আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে !

যুগের র্ধম এই –

পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই !

শোনো মর্ত্যেয় জীব !

অন্যেরে যত করিবে পীড়ন, নিজে হবে তত ক্লিব !”

(নারী, ‘সাম্যবাদী’ নজরুল রচনাবলী, ১ম খন্ড, পৃ ২৪২)

নজরুল এও উপলব্ধি করেছেন যে পৃথিবীর সমস্ত বির্নিমানে যে নারী পুরুষের পাশাপাশি অংশ নিয়েছে তাদের উপেক্ষিত রেখে এককভাবে পুরুষের অবিমিশ্র সাফল্য আসতে পারে না। তাদের উপেক্ষা মানে এক হিসেবে দেশ ও জাতির অকল্যাণের ই নামান্তর।

শুধু নারীকে মুক্তির বারতায় উৎসাহিত করে আর পুরুষকে নারীর স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্রহরণে নিরুৎসাহিত করেই থেমে থাকেন নি নজরুল, নারীজাতির উত্থান ও বিজয় সম্পর্কে সুনিশ্চিত আশার বাণীও ঘোষনা করেছেন :

‘‘সেদিন সুদূর নয় যেদিন ধরনী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়!’’(নারী, ‘সাম্যবাদী’ নজরুল রচনাবলী, ১ম খন্ড, পৃ ২৪৩)

নারীর জয় মানে পুরুষের পরাজয় নয় – নারীর জয় মানে মনুষ্যত্বের জয় । মানবতাবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের মনুষ্যত্বের জয়গানে আহবান করেছেন বহুদিন আগেই, আমরা কি সেই মিছিলে আজো যোগ দিতে পেরেছি?

নজরুলের দেখানো পথে কি আমরা চলছি? চলছি না। তাই নজরুল পাঠ আজো সমসাময়িক- নজরুল পুরাতন হয়েও এখনো আধুনিক – এখানেই নজরুলের কৃতিত্ব।