পুরুষতন্ত্রের চোখে নারীর লেখা
আঞ্জুমান রোজী।। নারী যখন থেকে অনুভব করেছে তার অস্তিত্বকে, তখন থেকেই সে নানাভাবে সোচ্চার হবার চেষ্টা করে আসছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বুঝতে চায় না যে নারী প্রকৃতির অংশ। তার নিজস্বতা আছে, আছে স্বাধীনতা, আছে মত প্রকাশের অধিকার। নারীকে বৈরী সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে প্রমাণ করতে হয়েছে নারীও পারে। নারীও পারে তার নিজ ব্যাক্তিত্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে।
নারী যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে অধিকাংশ সময়ে কলম ব্যবহার করেছে। লেখনীর মাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ করেছে। তুলে ধরেছে বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থাকে। কিন্তু সেইসব নারী লেখকদের লেখা কতখানি গুরুত্ব সহকারে মূল্যায়ন করা হয়েছে! যুগে যুগে অনেক নারী লেখককে এই বিরূপ সমাজে কঠিন মূল্য দিতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
জন্মেই নারী একটি নির্দিষ্ট আদলে বড় হতে থাকে। ধর্ম দিয়ে, প্রথা দিয়ে, সামাজিক বিধিব্যবস্থা দিয়ে এই আদলটি তৈরি করেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। নিয়মের আবর্তে বড় হতে হতে নারী ধরেই নেয় এটা তার জীবন। এভাবেই তাকে বাঁচতে হবে। নির্দিষ্ট গণ্ডীর ঘুরপাকে নারীর চিন্তা চেতনার রূপটিও থাকে সেই গণ্ডীর আবহের মত। বাংলার প্রথম আত্মকথার লেখিকা রাসসুন্দরী দেবী স্বামীর ঘোড়াকে দেখে ঘোমটা দিতেন। উনিশ শতকে সংসারে নারীর অবস্থানের চিত্রটি ছিল এ রকম। নারী বৃত্তে বন্দি প্রাণি, তার দৃষ্টির সীমানা সংকীর্ণ, মেধাচর্চার চাইতে ঘর গেরস্থালি, সন্তানের জন্মদান আর প্রতিপালনেই তার জীবনের সার্থকতা, পুরুষশাসিত সমাজ নারীকে এভাবেই দেখতে চায়। দীর্ঘকাল ধরে এভাবে চলে আসাতে পুরুষ তাতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। পুরুষ ধরে নেয় নারী মানেই এমন। এর ব্যতিক্রম হলে নারীর উপর চড়াও হওয়াও পুরুষের জায়েজ আছে। নারীকে অবদমনের সবরকম প্রক্রিয়াই পুরুষ প্রয়োগ করে থাকে। নারী যে প্রকৃতির মতো সহজাত স্বভাবের, তা মানতে নারাজ পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র।
নারীর প্রতি এহেন পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণেই নারীর কোন সৃষ্টিশীল মননশীল কাজ বা লেখনীকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। তুচ্ছ, তাচ্ছিল্য, অবহেলা অপমানে জর্জরিত করে, পাত্তা না দিয়ে নারীর সব কর্মকে অবমূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। একবিংশ শতকের প্রথমার্ধে পৌঁছেও পুরুষশাসিত সমাজের কতজন পুরুষ সাফল্যের শীর্ষে ওঠা নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান আর স্বীকৃতি দিতে পেরেছে? নানাভাবে নারীর সাফল্যকে তুচ্ছ, খাটো করার চেষ্টা করে থাকে পুরুষ। এরই প্রেক্ষিতে নারী লেখকদের অবমূল্যায়নের নির্মম ইতিহাসের দিকে একটু ফিরে তাকাই। যার ধারাবাহিকতায় আমরা এখনো নিমজ্জিত।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইউরোপের ইতিহাসে যে নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল, টমাস পেইন (১৭৩৭-১৮০৯) ছিলেন তার পুরোধা। তাঁর ‘দ্য এইজ অব রিজন’ (প্রথম খণ্ড ১৭৯৩, দ্বিতীয় খণ্ড ১৭৯৬) প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপ তথা সমগ্র পৃথিবীতে তুমুল আলোড়ন তোলে। তার ঢেউ এসে লেগেছিল সাতসমুদ্দুর পার হয়ে কলকাতায়। হিন্দু কলেজের ছাত্র তথা ডিরোজিয়ানদের হাতে হাতে তখন ঘুরত সে বই। সেকালে তারা আট টাকা দিয়ে বইটি কিনতেও দ্বিধা করেননি। (ক্যালকাটা ক্রিসটিয়ান অব সার্ভার, আগস্ট ১৮৩২)।
একই সময়ে ইংল্যান্ডে প্রথম নারী যিনি লেখনীর শক্তিতে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সচকিত জাগ্রত করেছিলেন, তিনি হলেন মেরি ওলস্টোনক্রাফট (১৭৫৯-৯৭)। তিনি ছিলেন নারীমুক্তির প্রথম উচ্চকণ্ঠ, স্পষ্টভাষী প্রচারক। নারী স্বাধীনতার পথপ্রদর্শক, ইংল্যান্ডে এনলাইটেনমেন্ট যুগের চিন্তানায়ক। সেই সময় তাঁর যুগান্তকারী মহাশক্তিধর একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির নাম ‘এ ভিনডিকেশন অব দ্য রাইটস অব উওম্যান’। ১৭৯১ সালে লেখা হলেও বইটির সংশোধিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৭৯২ সালে। পশ্চিমের যে উন্নত দেশে বইটি লেখা হয়েছিল অর্থাৎ সভ্যতার পীঠস্থান বলা হয় যে দেশকে, খোদ সেই ইংল্যান্ডের শিক্ষিত সমাজ বইটি প্রত্যাখ্যান করে। ৫০ বছর সময় লেগেছিল বইটির স্বীকৃতি পেতে।
একই সময়ে টমাস পেইন এবং মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের যুগান্তকারী দুটি বই প্রকাশিত হলেও মেরিকে স্বীকৃতি এবং স্বাগত জানাতে দীর্ঘ সময় নিয়েছিল পশ্চিমের বিদগ্ধ সমাজ। দুটি বইয়েই মানবতার জয়গান গাওয়া হয়েছিল, মানবজাতির সাম্য ও মানবিক অধিকারের প্রশ্নে দুজনই তাদের লেখায় সোচ্চার হয়ে ছিলেন। কিন্তু মেরি তাঁর বইয়ে বিশেষভাবে নারীজাতির কথা বলেছেন। তিনি দেখেছিলেন নিজের জীবন দিয়ে। উপলব্ধি করেছিলেন সমাজে, রাষ্ট্রে, ঘরে বাইরে নারীরাই সব থেকে বেশি শোষিত ও বঞ্চিত। (তথ্যসূত্র দীপা বন্দোপাধ্যায়ে লেখা ‘নারীর লেখা নারীর কথা’ প্রবন্ধ )
মেরির অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ বইটি সমাজ ও রাষ্ট্রের শিক্ষিত এবং বিবেকবান মানুষের কাছে কেন সমাদৃত হলো না? কেন তাঁর স্বীকৃতি পেতে ৫০ বছরেও বেশি সময় লেগে গেল? কারণ একটাই। নারীর লেখা মূল্যায়নে পুরুষতান্ত্রিক মনোভঙ্গির প্রয়োগ। আমরা নারীরা, যারা লেখালেখি করছি, তারা কি সেই সময়কে উৎরিয়ে যেতে পেরেছি? আমরা এখনো পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সেই ধারাবাহিকতার মধ্যেই আছি।
নারীর মূল্যবোধ পুরুষের তৈরি করে দেওয়া মূল্যবোধ থেকে স্বাভাবিকভাবেই আলাদা। পুরুষ যখন যুদ্ধ বিষয়ে বই লেখে, তখন সে বই সমালোচকের দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ। অন্দরমহলের নারীর আবেগ অনুভূতি নিয়ে লেখা বই স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্বহীন। অথচ এসব মূল্যবোধই তো অবধারিতভাবে সাহিত্যে প্রতিস্থাপিত হয়। মেয়েরা গল্প লিখছেন শুনে উনিশ শতকের প্রায় আশি শতাংশ পুরুষের মনোভাব ছিল ‘আরশোলার পাখি হওয়ার ইচ্ছে হয়েছে’। এমন মানসিকতার কিছুটা পরিবর্তন হলেও এখন পর্যন্ত নারীর লেখাকে নারী মনে করেই মূল্যায়ন করা হয়। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার মানুষ নারীর লেখাতে প্রথমে সুড়সুড়ি খুঁজে বেড়ায়। সেখানে কোনো সাহিত্যমান বা জীবনদর্শন খুঁজে দেখার চেষ্টা করা হয় না; মানবতা ও মানুষের কথা থাকলেও তা তাদের দৃষ্টি এড়ায়। সেইসাথে নারীর প্রতি পুষে রাখা পুরুষের বিদ্বেষ এবং বিরূপ ভাব তো আছেই। অথচ সব মানব অনুভূতিই শিল্প, সাহিত্যের মৌলিক অনুষঙ্গ।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব মতামত]