November 24, 2024
নারীবাদ আলোচনাসাহিত্যফিচার ৩

বিবাহিত দাসীর জীবন ও লড়াইয়ের গল্প  

নারীবাদ বোঝা ও বোঝাপড়া: পর্ব- ০৭

শারমিন শামস্।। নারীকে শায়েস্তা করবার সবচেয়ে ভালো সিস্টেমের নাম বিবাহ। পনেরো থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত এই বিবাহের মাধ্যমে শায়েস্তাকরণ প্রক্রিয়া চলেছে রাষ্ট্রীয় আইনকে সঙ্গে নিয়ে, সামাজিক রীতিনীতির দোহাই দিয়ে এবং অবশ্যই পারিবারিকভাবে। সে সময় সারাবিশ্বেই নারী অপমানিত, অপদস্ত, নির্যাতিত এবং নিপীড়িত হয়েছে বিয়ে নামক প্রথায়। এমনকি বিয়ে করার পর স্বামী নামক প্রভুর মৃত্যু হলেও সে রক্ষা পায়নি। সতীদাহ নামের কুৎসিত এক আচারে বেঁধে তাকে হত্যা করা হয়েছে।

নারীর কিছুই ছিল না। এমনকি মানুষের পরিচয়টুকুও। প্রথম তরঙ্গের নারীবাদের লড়াই তাই এমন সব ইতিহাস তুলে ধরে, যা মাঝে মাঝে অবিশ্বাস্য মনে হয়। সে সময় পৃথিবীর কোন দেশেই বিয়ে আসলে পরস্পরকে সঙ্গী ভেবে দুটি মানুষের একত্রবাসের চুক্তি ছিল না। ছিল পুরুষের প্রভুত্বে নারীর দাসত্ব কিনে নেবার পদ্ধতি। স্বামী স্ত্রীকে যেভাবে ইচ্ছে ব্যবহার করত।

আঠারো শতকে যুক্তরাষ্ট্রের মত ইউরোপেও বিবাহিত নারী ছিল তার স্বামীর সম্পত্তি। একটি আইন করে এই বিষয়টা সিদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল। Coverture নামে পরিচিত রীতি, যার অর্থ আইনের সেই অবস্থান যা নারীকে তার স্বামীর নিয়ন্ত্রণে রাখে। এর উদ্ভব সেই এগারো শতকে। আইন অনুসারে স্ত্রীর উপর পূর্ণ অধিকার স্থাপন ও তাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য স্বামী স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতে পারবে। অর্থাৎ মারতে পারবে, আবার ঘরেও আটকে রাখতে পারবে। ঘরের ভেতর স্বামীর যেকোন প্রয়োজন মেটাতে স্ত্রীকে সর্বক্ষণ বাধ্য থাকতে হবে। বলাবাহল্য এই ‘প্রয়োজন’ এর মধ্যে যৌনচাহিদা মেটানোর কথা স্পষ্ট করে বলা থাকত।

স্বামী স্ত্রীর যেসব সন্তান হত, তার একমাত্র অভিভাবকত্ব স্বামীর। এই সন্তানদের তাদের পিতা প্রহার করতে পারত, মায়ের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারত এবং ইচ্ছে হলে অন্য কারু কাছে পাঠিয়েও দিতে পারত লালন পালনের জন্য। স্ত্রীর সম্পত্তিতে স্বামী ভাগ বসাতে পারত। বিয়ে করে বিবাহিত দম্পতি একজন মানুষে পরিনত হত এবং একজন নারী বিয়ের আগে যতটুকু মানুষের অধিকার পেতেন, বিয়ের পর তিনি সব ধরণের অধিকার হারিয়ে ফেলতেন। স্ত্রীর যাবতীয় কর্মকাণ্ডের দায় বর্তাতো স্বামীর ওপর এবং স্বামীই তাকে রক্ষা করত। কারণ স্বামী ছিল স্ত্রীর মালিক। অর্থাৎ বিয়ে করে এক একজন স্বামী এক একটি দাসী কিনে নিয়ে আসতেন। ইচ্ছে হলে এই দাসীকে হত্যা করতেও খুব বেশি বেগ পেতে হত না স্বামীদের।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটেনের মধ্যবিত্ত নারীদের ওপর স্ত্রী ও মা হিসেবে কিছু গেরস্থালী দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। এইটাকে ভিক্টোরিয়ান সমাজের আদর্শ বলে প্রচার করা হত। নারী পুরুষের সমান শিক্ষাদীক্ষা পাবার অধিকার পেত না। ফলে পেশাগত ক্ষেত্রেও সে পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে ছিল। অন্যদিকে নিম্নবিত্ত শ্রেণির ভেতরে নারীকে সংসার চালাতে হত,  পরিবারের ভরনপোষণ, সন্তান লালন সবই ছিল নারীর দায়। তাকে নামমাত্র মজুরিতে কৃষিকাজ করতে হত। শিল্পকারখানা, ব্যবসা বানিজ্যে শ্রম দিতে হত স্বল্প অর্থের বিনিময়ে। গর্ভবতী হলে, যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রসব ব্যথা উঠছে, তাকে মাঠে, ক্ষেতে, কারখানায় কাজ করতে হত।

আশ্চর্য ব্যপার হল, কোন শ্রেণির বিবাহিত নারীই তার রোজগার করা অর্থ নিজের কাছে রাখতে পারত না। নারীর সব আয় ও সম্পত্তির মালিক ছিল তার স্বামী। এই পরিস্থিতি পুরো যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বেশিরভাগ দেশেই ছিল।

আইরিশ নারীবাদি লেখক অ্যানা উইলার স্বামীকে ছেড়ে এসেছিলেন। একজন লেখক ও অনুবাদক হিসেবে  জীবিকা নির্বাহ করতেন। তিনি নারীর রাজনৈতিক ও শিক্ষাগত সমঅধিকারের জন্য কাজ করছিলেন। অ্যানা মনে করতেন, সামাজিক উৎপাদনে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে কখনোই লৈঙ্গিক সমতা অর্জন হবে না। ব্রিটিশ লেখক হ্যরিয়েট মারটিনোও এনিয়ে কাজ করেছেন। অন্যদিকে হ্যারিয়েট টেইলর মিলও প্রচুর লেখালেখি করতে শুরু করেন বিবাহিত মেয়েদের অধিকার নিয়ে। তিনি মনে করতেন, শিক্ষিত স্ত্রী, যিনি ভাল রোজগার করেন এবং পরিবারের জন্য তার আয় যখন ভূমিকা রাখে, তখন তিনি সংসারে সম্মানজনক অবস্থান পান।  স্বামীটিও তখন স্ত্রীকে প্রকৃত অর্থে একজন সঙ্গীনি হিসেবে মানেন। হ্যারিয়ট মিল মনে করতেন, এতে শুধু নারীই লাভবান হয় না, পুরো সমাজ উপকৃত হয়। মেয়েদের সমান ভূমিকা নিশ্চিত করতে তিনি উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কথাও বারবার উল্লেখ করেছেন।

বিয়ে দিয়ে নারীকে বেঁধে ফেলার নিয়ম ছিল। এই বিয়ে ছিল চিরকালের দাসত্ব। বিবাহিত জীবন থেকে মুক্তির সহজ কোন পথ নারীর সামনে খোলা ছিল না। পুরুষ যত সহজে ডিভোর্স দিতে পারত, নারীর জন্য ছিল তা ততটাই কঠিন। নারীর দাসত্ব ছিল রাষ্ট্র অনুমোদিত। সারা পৃথিবীজুড়েই। তখন আইন করে স্ত্রীকে ধর্ষণের অধিকারও দেয়া হয় স্বামীকে। ১৭৩৬ সালে ইউরোপে নিয়ম জারি হয়, বিবাহিত স্ত্রীকে ধর্ষণের দায়ে কোন স্বামীকে জরিমানা করা যাবে না। কারণ চাহিবামাত্র স্বামীর বিছানায় হাজির হতে স্ত্রী বাধ্য। ধর্মীয় কিতাবগুলোর সাথে এর মিল পাওয়া যায়। যেখানে স্বামীর শয্যায় স্ত্রীকে অনুগত থাকার আদেশ জারি হয়েছে এবং স্ত্রী হল সেই শস্যক্ষেত্র যেখানে স্বামী যেকোন উপায়ে প্রবেশ করতে পারে।

তো, ডিভোর্স খুব কঠিন ছিল নারীর জন্য। সহজে মিলত না। কেবলমাত্র অত্যন্ত বেশি নিষ্ঠুরতার শিকার হলে, কিংবা স্বামী যদি অজাচার করতেন কিংবা আরেকটি বিয়ে করতেন তাহলেই কেবলমাত্র স্ত্রী তালাকের আবেদন করতে পারতেন। আইনগতভাবে বিচ্ছেদ সম্ভব ছিল, কিন্তু ভীষণ ব্যয়বহুল। এদিকে স্ত্রীর সাথে কোন ব্যাক্তির সম্পর্ক আছে এমন সন্দেহ হলেই স্বামীটি যেকোন পুরুষকে অভিযুক্ত করে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারত। এই অভিযোগের আবার একটা নাম ছিল। একে বলা হত- ক্রিমিনাল কনভারসেশন।

ক্যারোলিন নরটন

উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে ক্যারোলিন। পরিচিত ছিলেন বহু শিল্পী, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবকের সাথে। নিজে আয় করতেন লেখক ও পত্রিকা সম্পাদক হিসেবে।

১৮৩৫ এর কোন এক সময় ক্যারোলিনের স্বামী জর্জ নরটন তাকে এত শারিরীক নির্যাতন করেন যে গর্ভপাত হয়ে যায় তার। পালিয়ে মায়ের বাসায় চলে যান ক্যারোলিন। ফিরে এসে দেখেন জর্জ তাকে তালাক দিয়েছেন, তাকে ঘর থেকে বের করে দেবার ব্যবস্থা করে রেখেছেন এবং তার তিন পুত্র সন্তানকে দূরে কোথায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটটার বয়স তখন মাত্র দুই বছর। জর্জ সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী লর্ড মেলবোর্নের বিরুদ্ধে ক্যারোলিনের সাথে ক্রিমিনাল কনভারসেশনের অভিযোগ দায়েরও করলেন।

আদালত যদিও মেলবোর্নকে নির্দোষ ঘোষণা করেছিল। কিন্তু নারীর অপরাধ তো আগেই প্রমাণ করে ফেলে সমাজ। ফলে সমাজের চোখে ক্যারেলিনের তথাকথিত ভাবমূর্তি প্রায় নষ্ট হল। জর্জ সন্তানদের পাঠিয়ে দিল দূরে, মায়ের সাথে তেমন যোগাযোগের সুযোগ রইল না। ছয় বছর পর সবচেয়ে ছোট ছেলেটি মারা গেল দুর্ঘটনায়।

ক্যারোলিন আত্মীয়দের সাথে থাকতেন। জর্জ তার সব টাকা পয়সা নিয়ে গিয়েছিলেন, যা কিছু ক্যারোলিন আয় করেছিলেন এবং যা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন- সব। ক্যারোলিনকে যে টাকা মাসিকভিত্তিতে দেবার কথা ছিল, বেশিরভাগ সময়ই জর্জ তা দিতেন না।

ক্যারোলিন নিজে অন্যায়ের শিকার হয়েছিলেন বলেই হয়তো নারীকে বিয়ের মাধ্যমে অত্যাচার নির্যাতনের বিষয়গুলো মর্মে মর্মে উপলব্দি করতে পেরেছিলেন। ১৮৩৭ সালে ক্যারোলিন ক্যাম্পেইন শুরু করলেন, সন্তানের কাস্টডি বা হেফাজত নিয়ে মায়ের অধিকার বিষয়ে। তিনি আইন পরিবর্তনের কথা বলতে শুরু করলেন। দাবি তুললেন, সাত বছরের নিচের সন্তানকে মায়ের হেফাজতে রাখতে দিতে হবে এবং এর চেয়ে বড় সন্তানের সাথে মায়ের যোগাযোগ রাখার সুযোগ থাকতে হবে। তিনি গোপনে কিছু ছোট বই মত তৈরি করলেন এবং প্রচার করতে লাগলেন, যার মূল বক্তব্য ছিল, সন্তানের দাবিতে মা আদালতে যেতে পারেন না, কারণ আইনে মায়ের জন্য কোন জায়গাই নেই।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একজন এমপি রাজি হলেন বিষয়টি ‍বিল আকারে তুলতে। কিন্তু হাউজ অব লর্ডস বাতিল করে দিল। ক্যারোলিন একটি চিঠি লিখে সব পার্লামেন্ট সদস্যের সাহায্য প্রার্থণা করলেন। পরে সেই বছরই (১৮৩৯) সন্তানের কাস্টডি সংক্রান্ত আইনে পরিবর্তন আসলো। কিন্তু ক্যারোলিনের দুর্ভাগ্য ততদিনে তার সন্তানদের নিয়ে তার প্রাক্তন স্বামী চলে গেছেন স্কটল্যান্ডে, যেখানে এই আইন কার্যকর হবে না।

ক্যারোলিন থেমে গেলেন না।  ক্ষমতাবানদের বরাবর একের পর এক চিঠি লিখতে লাগলেন।  বিয়ে এবং তালাক সংক্রান্ত ইস্যুতে নারীর অধিকার বিষয়ে তিনি প্রচারণা চালাতে লাগলেন।

ক্যারোলিনের সব লেখা ও প্রচারণার মূল উদ্দেশ্য ছিল নিরাপত্তা ও সহানুভূতি প্রাপ্তি। তিনি কখনও নারী ও পুরুষের সমতার কথা বলেননি। ‍সমতাকে তিনি বলতেন “absurd” বা অসম্ভব। বরং তিনি মনে করতেন, পুরুষের পবিত্র দায়িত্ব নারীকে রক্ষা করা। নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া হয়রাণি থেকে মুক্তির জন্য তিনি কাজ করেছেন নির্দিষ্ট ইস্যুতে। সেই অর্থে তিনি ফেমিনিস্ট ছিলেন না। কিন্তু তার নিরলস পরিশ্রম ও ত্যাগ নারীবাদ আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছিল।

Barbara Leigh Smith Bodichon ছিলেন নারী অধিকার কর্মী। কাজ করতেন নারীশিক্ষার অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, বৃটিশ আইন কীভাবে নারীর অধিকার খর্ব করে।

১৮৫০ এর দিকে যুক্তরাজ্যের প্রথম নারীবাদী দল তৈরি হয় যারা মূলত শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে এসেছেন। তাদের সাথেই বারবারা বিবাহিত নারীর প্রতি বিদ্যমান আইনের ‍সংশোধনী দাবি করে একটি পেটিশন দাখিল করেন। প্রায় ২৬ হাজার স্বাক্ষরসহ পেটিশনটি হাউজ অব কমনসে পাঠানো হয়। পাশাপাশি চলতে থাকে ক্যারোলিন এবং বারবারার লবিং।  অবশেষে ১৮৫৭ সালে পাশ হয় Matrimonial Causes Act। এই আইনের কারণেই ব্রিটেনের প্রথম ডিভোর্স আদালতও গঠিত হয়। এর মধ্য দিয়ে ইংল্যান্ডের বিবাহিত নারীদের প্রতি অবিচারমূলক আইনগুলোর অবসানের পথ তৈরি হয়।

১৮৫৭ তে Barbara Leigh Smith একটি বই লেখেন যার প্রতিপাদ্য ছিল বিবাহিত মেয়েদের আর্থিকভাবে স্বামীর ওপর নির্ভরশীলতা। তিনি লেখেন, নারীর নিজের রোজগার করবার স্বাধীনতা থাকা উচিত। কয়েকজন বন্ধুকে সাথে নিয়ে “The English Woman’s Journal” প্রকাশ করতে শুরু করেন। চলতে থাকে নারী অধিকারের বিভিন্ন ইস্যুতে লেখালেখি ও প্রচারণা। নারীশিক্ষা ও ভোটাধিকারও এসবের মধ্যে ছিল। তাদের নিরলস প্রচেষ্টায় ১৮৭০ সালে Married Women’s Property Act পাশ হয়। এর ফলে বিবাহিত নারী নিজের রোজগারের অর্থ, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তি নিজের অধিকারে রাখার ক্ষমতা পায়।

১৮৮২ পর্যন্ত আইনটি বিবাহিত মেয়েদের মোটামুটি এক ধরণের নিরাপত্তা দেয়। যদিও তখন পর্যন্ত একজন অবিবাহিত মেয়ের তুলনায় তা ছিল যৎসামান্য। ১৮৮২তে আইনটি সংস্কার করে বিবাহিত নারীর অধিকারের পরিধি বাড়ানো হয়।

আঠারো শতকের শেষের দিকে যখন পশ্চিমে বিবাহিত মেয়েরা নিজেদের লড়াই জারি করে অধিকার আদায়ের পথে হেঁটে চলেছে, তখন এই ভারতীয় উপমহাদেশে বিবাহিত মেয়েদের স্বামীর মৃত্যু হলে সদ্য বিবধাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার উৎসব চলছে। পনেরো থেকে আঠারো শতক পর্যন্ত হাজার হাজার নারীকে আগুনে ঠেলে দিয়ে হত্যা করা হয় ধর্মের দোহাই দিয়ে। সে এক নির্মম ইতিহাস।

(চলবে)