মাসিক! লজ্জা নাই?
ইশরাত বিনতে রউফ।। মাসিক, পিরিয়ড, ঋতুস্রাব – শব্দগুলি মাতৃত্ব, প্রকৃতি আর আমার আপনার মতই অতীব স্বাভাবিক। তবুও এই প্রাকৃতিক বিষয়টি অনেকের কাছেই অশ্রাব্য। ওষুধের দোকানেও স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনা ও দোকানদারের গুপ্তধনের মতন কাগজে মুড়িয়ে বেচাকেনা – মহিলা ক্রেতাদের আরো বেশি ইতস্তত করে।
মে আটাশ- বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্যবিধি দিবস গেল। ঋতুচক্রের আটাশ দিনের সাথে মিল রেখে এই দিনটি পালন করা হয়। ইউনিসেফ বাংলাদেশের এ সংক্রান্ত পোস্টে নজর দিতেই দেখলাম প্রায় দুই হাজার মন্তব্য – যার নব্বই শতাংশই নেতিবাচক। আমি আধা ঘন্টা সময় দিলাম তাদের মানসিকতা বুঝতে। কিছু মন্তব্য উল্লেখ না করলেই না (মন্তব্যগুলো মন্তব্যদাতার লেখা বানানসহ হুবহু তুলে দিলাম)-
– একটা ব্যবস্থা নেয়া হোক এ সমস্ত ফাজলামি বাদ দিতে হবে এ বিষয়টি আপলোড দেওয়ার আগে একবার ভাবা দরকার ছিল
– এগুলা কোন দরনের ফাজলামো দিবস পালন করেন আপনারা
– এই মা*র পুলারাতদের কি মা বোন নেই
– লজ্জাস্থানের হেফাজত করতে শিখুন। সবকিছু সবার কাছে বলা উচিৎ নয়
– মাসিকের জন্য দরদ উতলে পড়ছে আবার উলঙ্গ করে মজাও নিচ্ছে, বাটপারেরা
– আমার মনে হয় মানুষের বিবেক বুদ্ধি হারিয়ে গেছে
– বা*র দিবস বানাইছে
– ভিভিন্নো টিবি চেনেলে নাটকের, ছবির মাঝখানে বিরতিতে এডভেটাস দেয় সেনোরার, কনডমের কারণ কি, আগে তো এসব ছিলো না, এখন কেনো, পরিবারের সঙ্গে এখন একসাথে টিভি দেখা যায়না, এসব কিছু সোসালমিডিয়ার কারনে দেশ থেকে লজ্জা সরম উঠে গেছে।
এসব মন্তব্য থেকে তিনটা বিষয় স্পষ্ট –
এক. তারা এই দিবস এর কারণ সম্পর্কে অবহিত নয় – অর্থাৎ জ্ঞানের অভাব
দুই. ভুল ধর্মীয় ব্যাখ্যা জেনে ধর্ম চর্চা এবং গোঁড়ামি ۔
তিন. সামাজিকভাবেই নারী ও নারীত্বকে অবজ্ঞা ও অবহেলা
মাসিক স্বাস্থ্যবিধি দিবস একটি সচেতনতা দিবস যার উদ্দেশ্য নারী স্বাস্থ্য ও মাসিককালীন পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে বিশ্বের নারী ও পুরুষকে অবহিত করা। ২০১৪ সালে জার্মান এনজিও ওয়াশ ইউনাইটেড এর সূচনা করে।
নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ঋতুস্রাব ব্যাপারটি অবহেলিত। এর সাথে সম্পৃক্ত হল মাসিককালীন ন্যাপকিন, ব্যথাজনিত ওষুধ ও দুর্বলতা প্রতিরোধকারী ভিটামিনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব, সাধ্যের বাইরে ওষুধ ও প্যাডের মূল্য, অপ্রাপ্যতা, আর সামাজিক ট্যাবু তো আছেই। দরিদ্র শ্রেণির নারীরা অনেকে জানেনই না প্যাড কি! বিবিসির জরিপ অনুযায়ী স্যানিটারি প্যাডের দাম ৪০% কমানো যাবে। ঋতুকালীন স্যানিটারি প্যাডের অপ্রতুলতার কারণে মেয়ে শিক্ষার্থীরা স্কুল কলেজে যায়না প্রায়ই।মাসিক ও নারী স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য ও সেবা জনসাধারণের নাগালে আনার প্রয়াস চলছে। সকল বাধা পার হতেই যে আন্দোলন তার উদ্দেশ্যেই এই মাসিক স্বাস্থ্যবিধি দিবস।
নবম দশম শ্রেণিতে উপন্যাস “হাজার বছর ধরে” পড়তে গিয়ে প্রথম জানতে পারি আঁতুরঘর সম্পর্কে। সন্তান হবার পর অনেকদিন নারীকে পাক নাপাকের দোহাই দিয়ে বাসার বাইরে রাখা হত। মাসিকের সময়েও। অথচ এই সময়ে তার আরো যত্ন , পরিচ্ছন্নতা ও পুষ্টিকর খাদ্য প্রয়োজন; তাকে একা করে ফেলা কোন্ ধরণের সামাজিক/মানবসৃষ্ট নিয়ম তার উত্তর জানা নেই।
আমার ঋতুস্রাব হয় আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি। শিক্ষিত সচ্ছল পরিবারের মেয়ে বলে হয়ত আমার এ সম্পর্কে জানতে বুঝতে ও প্রয়োজনীয় জিনিসের যোগান পেতে কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু আমার পরিচিত অনেকেই ছিল যারা কাপড় আর তুলোর ওপর নির্ভর করতো। স্কুল মিস গেলেই বুঝতাম যে তাদের অনুপস্থিতির কারণ হল ঋতুস্রাব। কাপড় তুলার প্যাড ভারি প্রবাহ আটকাতে পারে না। দাগ লেগে যায়। এই দাগ হলো আরেকটা প্রতিবন্ধকতা।
অপরিষ্কার ন্যাপকিন, এক ন্যাপকিন দীর্ঘসময় পরে থাকার ফলে ফাঙ্গাল ইনফেকশন, প্রজননতন্ত্র ইনফেকশন, ইউরিন ইনফেকশন হয় এবং নারীর ফার্টিলিটি মানে প্রজনন ক্ষমতাও নষ্ট করে দিতে পারে। বিবিসি বাংলা মতে, স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারের সংখ্যা শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ। এবং সারাদেশে ১২ থেকে ১৫%। ৮৬ ভাগ নারী ব্যবহার করেন পুরনো কাপড় বা ন্যাকড়া, যা থেকে ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। প্যাডের কাঁচামালের উপর ১৫% ভ্যাট। উচ্চমূল্য। অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না কেনা। বাংলাদেশের পাবলিক টয়লেট নারীবান্ধব নয়। দেশের সব বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজে বিনামূল্যে স্যানিটারি প্যাড দেয়া জরুরি।
বৈশ্বিক মহামারীতে নারীর মাসিককালীন স্বাস্থ্য আরো বেশি বিপর্যয়ের সম্মুখীন। প্যাড উৎপাদন ও যোগান কম। নারী চিকিৎসকরা পিরিয়ডকালীন নানা ঝামেলা মেনে নিয়ে সেবা দিচ্ছেন। পুরুষ জনগোষ্ঠী এই ত্যাগ ও কষ্ট উপলব্ধি করবে তা আশা করি না।
আমি নিজেই কয়েকদিন আগেও জানতাম না ঋতুকালীন/পরবর্তী ইনফেকশনের ঘরোয়া উপশম কি? লবন মিশ্রিত কুসুম গরম পানির ব্যবহারই এর সহজ সমাধান হতে পারে, ফাঙ্গাল ইনফেকশনে আরো বেশি সমস্যা হতে পারে, এজন্যে লজ্জা ভেঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরি।
পত্রিকায় মাসিক সংক্রান্ত লেখার নিচে থাকা হাজার মন্তব্যের মূল মনোভাবটি হল-
“নারী মায়ের জাত, তাকে সন্মান করুন, এসব আজে বাজে পোস্ট দেবেন না”।
ভাই ও বোনেরা, এই মাতৃত্বের স্বাদ ঋতুবতী না হলে পাওয়া যায় না। আর প্রকৃত সন্মান ও যত্ন আসে তার সুবিধা অসুবিধা বোঝার মধ্যে দিয়ে। অপবিত্র মনে করে আজেবাজে কথা বলে নয়।
আপনারা যারা মেয়েদেরকে ছোট করা হচ্ছে বলে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, আশা রাখি বাস্তব জীবনে আপনাদের দ্বারা কোন মেয়ে বৈষম্য, সহিংসতার শিকার হলে প্রতিরোধ করবেন, পরিবারে মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেদেরও পিরিয়ড বিষয়ে অবহিত করে বড় করে তুলবেন। আপনাদের মেয়েদের সুরক্ষা দেবেন, ভালভাবে বাঁচার সুযোগ দেবেন, বিয়ের পর বউ হিসেবে যে আপনাদের পরিবারে আসবে তাকে সহানুভূতির সাথে গ্রহণ করবেন। দেশের কোন নারীই এই প্রয়োজনীয় সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হোক।
“হঠাৎ দেখি জামার পিছে লাল দাগ- সবাই দেখছে, মানুষ হাসছে”- এই দুঃস্বপ্ন হয়তো প্রত্যেকটা মেয়েই দেখেছে, আতংকিত হয়েছে, এ যেন এক অমার্জনীয় অপরাধ! যেন এর চেয়ে মরে যাওয়া ভাল। কতটা মানসিক চাপ নিয়ে আমরা মেয়েরা বড় হই, তাও এ নিয়ে কথা বলা যায়না! আমার আম্মুদের বেলায়ও যেত না! আমার স্কুলে পড়ার সময়েও না।
কিন্তু এখন সময় এসেছে, কথা বলতে হবে মাসিক নিয়ে, সমস্যা নিয়ে, প্রয়োজনীয় ন্যাপকিন ও ওষুধ নিয়ে। শুধু নারী ও কন্যাসন্তান নয়, বাড়ির পুরুষদের আরো আগে বুঝতে হবে, এখনো দেশ পিতৃপ্রধান, পরিবারের প্রধান পিতা, অর্থের যোগানদাতা পুরুষ। প্যাড কিনতে গেলেও জবাবদিহিতা করতে হয়, আর এই আমরা নারীরা- আপনাদেরই মা, বোন ও প্রিয় মানুষ۔ তাহলে কেন গোপনীয়তা? কেন কোন কথা হবেনা? কেন ইউনিসেফ/জেনল্যাব / ইউএনডিপি’র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অযাচিত মন্তব্য?
এখন মৌনতা ভাঙ্গবার সময়- মাসিক স্বাস্থ্যবিধি অধিকার আদায়ের সময় ۔۔ নারীর প্রাকৃতিক ঋতুকে স্বাভাবিকভাবে দেখার সময়।
ইশরাত বিনতে রউফ: প্রভাষক, নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এবং জনসংযোগ ব্যবস্থাপক, জেন ল্যাব
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব মতামত]