এতো প্যাড ফেলবো কোথায়?
শাশ্বতী বিপ্লব।। স্যানিটারি প্যাডের সাথে আমাদের পরিচয় বেশিদিনের নয়। আমার নিজের কিশোরীবেলাটাও শুরু হয়েছিলো সুতি কাপড়ের টুকরো দিয়ে। সম্ভবত স্কুল জীবনের শেষের দিকে এসে আমার সেনোরার সাথে পরিচয় ঘটে। তারপর একে একে কতোরকম ব্র্যান্ড এসে গেলো বাজারে। তবুও গ্রামে গঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে, এমনকি খোদ ঢাকা শহরে নিম্ন আয়ের নারীর জন্য স্যানিটারি প্যাড এক বিলাসিতার নাম। স্যানিটারি প্যাডসহ অন্যান্য মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা পণ্য সহজলভ্য করা এখন সময়ের দাবি।
গত দুইদিন যাবৎ এইসব নিয়ে বেশ কিছু লেখা পড়ে, আলোচনা শুনে আমার ভিন্ন একটি অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেলো। প্যাডের ব্যবস্থা না হয় হল, কিন্তু ব্যবহৃত প্যাডগুলোর ডিসপোজাল অধিকাংশ নারীর (যারা ব্যবহার করতে সক্ষম) জন্যই এক বিরাট সমস্যা। স্যানিটারি প্যাড ধোয়া যায় না, কমোডে ফেলা যায় না, আবার অধিকাংশ স্যানিটারি প্যাড কমপোস্টেবল কিংবা বায়োডিগ্রেডেবলও না। শহরে নারীরা গৃহস্থালীর ময়লার সাথে প্যাড ফেলতে পারলেও, সেগুলো কোথাও না কোথাও গিয়ে পাইল হয়ে থাকে। আর গ্রামেও স্যানিটারি ন্যাপকিন ফেলার কোন সুব্যবস্থা নাই।
এই স্যানিটারি প্যাড ডিসপোজাল নিয়ে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটা নিদারুণ অভিজ্ঞতা আছে। সময়টা সম্ভবত ১৯৯৭ সাল। সদলবলে শিক্ষা সফরে ৩০/৩৫ জন ছেলেমেয়ে এসেছি মিরসরাইয়ে। মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা হলো মিরসরাই উপজেলা পরিষদে আর ছেলেদের মিলনায়তনে। উপজেলা পরিষদের অবস্থা খুবই শোচনীয়, কোন রকমে সবাই মেঝেতে চাদর বিছিয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু উপজেলা পরিষদের একমাত্র টয়লেটটার অবস্থা আরো শোচনীয়। ১৫/১৬ জন মেয়ে এবং একটা ময়লা টয়লেট, যেখানে কিনা আবার গোসলের কাজটাও সারতে হবে, ভাবা যায়! উপায়ন্তর না দেখে, আমরা নিজেদের মধ্যে সিরিয়াল মেইনটেইন করে কোনরকমে সেটা ম্যানেজ করে ফেললাম। কিন্তু মুশকিল দেখা দিলো যাদের পিরিয়ড চলছিল তাদের নিয়ে।
অনেকে যাওয়ার সময়, অনেকের যাওয়ার পরে মাসিক শুরু হলো, হওয়ারই কথা। কিন্তু ব্যবহৃত প্যাডগুলো ফেলার কোন জায়গা নাই। আমরা ওই টয়লেটেরই এককোনায় সেগুলো জমিয়ে রাখতে লাগলাম। শিক্ষা সফরের পাঁচদিন শেষে মোটামুটি একবস্তা ব্যবহৃত প্যাড জমে গেলো এবং দূর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করলো।
আমাদের ফিরে আসার দিন সেগুলো নিয়ে আমরা মহা বিপদে পড়লাম। প্যাডগুলো ওইভাবে ফেলে আসতে রাজি না কেউ। এমনিতেই স্থানীয় লোকেরা ছেলে আর মেয়েদের একসাথে ঘোরাফেরা এবং মেয়েদের এইভাবে থাকা পছন্দ করছিল না। এক দুইবার ছেলে সহপাঠীদের পাকড়াও করে হুমকিও দিয়েছে। তার উপর সাথে কোন নারী শিক্ষক না থাকায় আমরা কারো সাথে আলোচনাও করতে পারছিলাম না। আমরা কেউ কেউ স্যারদের সাথে আলোচনা করতে চাইলেও বেশিরভাগ মেয়েরা অমত করছিল। অবশ্য করলেও খুব একটা লাভ হতো বলে মনে হয় না। এখন ভাবলে অবাক লাগে, যে শিক্ষকরা আমাদের শিক্ষাসফরে নিয়ে গিয়েছিলেন, তারা একটি বারের জন্যও ছাত্রীদের এই সমস্যাটার কথা ভাবেন নাই!
সবশেষে, আমাদের সাথে থাকা কিছু পুরানো পত্রিকা দিয়ে সেগুলোকে মুড়ে তারপর দড়ি দিয়ে বেঁধে ঢাকা পর্যন্ত নিয়ে আসি। বলা যায় আনতে বাধ্য হই। আমাদের ছেলে সহপাঠিরা যখন মালামাল বাসের ছাদে তুলছিলো, তখন ওই পোটলাটাও ছাদে পাঠিয়ে দেই। ওরা অবাক হয়ে এটা কি জানতে চাইলেও বলা হয় নাই। আজকালকার মেয়েরা নিশ্চয়ই এতাটা ইতস্তত করবে না, কিন্তু আমরা করেছিলাম।
স্যানিটারি প্যাড ডিসপোজাল বা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটা সামাজিক এবং পরিবেশগত সমস্যা। স্যানিটারি প্যাডকে প্রমোট করার পাশাপাশি এর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়েও ভাবা দরকার। এখনও কোন কোন গ্রামের দিকে গেলে ব্যবহৃত প্যাডগুলো পলিথিনে মুড়ে বাসা পর্যন্ত নিয়ে আসতে হয়। অবশ্য মেনস্ট্রুয়াল কাপ এই সমস্যার একটা বড় সমাধান নিঃসন্দেহে। একটা কাপ অনেকদিন ব্যবহার করা যায় এবং ডিসপোজালের ঝামেলা নাই। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে পরিস্কার সুতি কাপড় ব্যবহার করাও আমার কাছে সহজ মনে হয়। মেয়েরা যদি সেই কাপড়গুলো ধুয়ে লুকিয়ে শুকাতে বাধ্য না হয়, যদি রোদে ভালোভাবে শুকানোর সুযোগ পায়, তবে ডিসপোজালের সমস্যা অনেকটাই কমে যায়। আবার স্যাঁতস্যাঁতে কাপড় ব্যবহারের যে স্বাস্থ্য ঝুঁকি, তাও কমে যায়। আর সবাই যদি প্যাড ব্যবহারের সুযোগ পায় এবং সেগুলো ফেলারও কোন অসুবিধা না থাকে, তাহলে তো কোন কথাই নাই।
নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফোরাম ৭ দফা দাবি জানিয়েছে, সেখানে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় বাজেট বরাদ্দ থেকে শুরু করে স্যানিটারি প্যাডসহ অন্যান্য মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা পণ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছে। এই ৭ দফা দাবির সাথে স্যানিটারি প্যাডের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দাবিটাও যোগ করে দিলে আরো ভালো হত বলে আমি মনে করি।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব মতামত]