নারী কখন বদলে যায়!
নায়না শাহ্রীন চৌধুরী।। বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষে ওঠার পর থেকে দেখেছিলাম সহপাঠী মেয়েদের বিয়ের হিড়িক। বিয়ের পরই দেখতাম, মেয়েগুলো কেমন চুপসে যেত। মনে হত একটা ফুটন্ত ফুলের উপর কোন ভারি পাথর চাপানো হয়েছে। একজনকে দেখলাম পোশাকে আমূল পরিবর্তন। কেউ জিজ্ঞেস করেছিল, সে বলেছে এমনি এই পরিবর্তন। কিন্তু তখন তো আমরা শিশু নই। দুই এর সাথে দুই মিলিয়ে হিসেবটা বুঝে নিয়েছিলাম। মেয়েটি যথেষ্ট মেধাবী এবং স্মার্ট ছিল। সেই বিয়ে থেকে বেরিয়ে এসে এখন সে তার আগের নিজস্বতায় ঝলমল করছে। জীবনের সৌন্দর্যের সাথে আর আপোষ করেনি।
বয়স্ক একজন নারীকে দেখেছি তিনি মুরগি রাঁধলে পা অথবা পাখনা খান। আপনাদের কি মনে হয় এই অংশটি তিনি খান তার পছন্দ থেকে? যদিও তিনি স্বীকার করেন না, কিন্তু দীর্ঘদিনের খাদ্যবঞ্চনা অথবা মাতৃত্বসুলভ ত্যাগে, যা এই সমাজে প্রত্যাশিত, প্রশংসিত সেই জায়গা থেকে তাঁর এই অভ্যাস।
অনেক নারীকেই বলতে শুনি, বিয়ের পর আর পড়াশোনা হয়নি, গান গাইতো, গান হয়নি, চাকরি করতো, ছাড়তে হয়েছে, নিজের ইচ্ছে, আদর্শকে ত্যাগ করতে হয়েছে, যে পোশাকে কমফরটেবল তা ছেড়ে অনভ্যস্ত পোশাক বেছে নিতে হয়েছে ,যে খাবার পছন্দ তা না খেয়ে দিনের পর দিন তুলে দিয়েছেন পুরুষতন্ত্রের আগ্রাসীমুখে।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পছন্দ অপছন্দকে মূল্য দিয়ে নারীর নিজস্বতা নিভৃতে বলি হয়েছে। কিন্তু ঠিক কতজন পুরুষ বদলেছে বিয়ের পর? আমি তো হরদম দেখি ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরা মেয়ে বিয়ের কিছুদিন যেতেই হিজাব পরে হাসিমুখে বরের সাথে ছবি দেয়, সেই হাসিমুখ দিনদিন ম্রিয়মান হলেও কোন অভিযোগ শোনা যায় না। বর বাবাজি কিন্তু আগের মতই প্যান্ট পরে দাড়িহীন ভাবেই থাকে। বিয়ের পর বা বাচ্চাপালার সময় চাকরি তো বেশিরভাগ মেয়েই ছেড়ে দিতে চায়। কারন জামাই রাজী না। বরের ক্যারিয়ার অর্জন সবকিছু মহিরুহের মত বাড়তে থাকে। বেশিরভাগ নারী তাদের স্বামীর ক্যারিয়ারকে নিজের ক্যারিয়ার ভেবে আত্মতৃপ্তিতে ভাসে। অথচ তার অর্জন জিরো।
এই যে নারীকে দাবায়ে নিজের কাজ, নিজের আরাম আদায় করে নেওয়ার টেকনিক- এটা পুরুষতন্ত্রের সব পূজারি খুব ভালোভাবে জানেন। তারা এটাও জানেন, এদেশের নারীরা শিক্ষা, জ্ঞানে, বাইরের কর্মদক্ষতায় পিছিয়ে। তাদের একটু অলসতায় তুলুতুলু রাখলে, রূপচর্চা, পরচর্চায়, ভাবি মহলে (বন্ধু মহল নয় কিন্তু) ঠেলে দিলে তারা অনুগত থাকবে আর পুরুষ আরামে কাজ করবে, ঘুমাবে, খাবে, শারীরিক চাহিদা মেটাবে। নারী ঘরে আছে কী করতে!
সৃষ্টির শুরু থেকেই বোধ করি নারীর উপর, তার ব্যাক্তি স্বাতন্ত্রের উপর চাপানো হয়েছে রাজ্যের বিধি নিষেধ। তার খাবার, পোশাক, চলা ফেরা থেকে তার মেধার পথ দম আটকে মারার হাজার কৌশল পুরুষতন্ত্রের চেনা অভ্যাস। এই চেনা অথচ বৈষম্য আর অপমানের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে নারী নিজেও মনে করে এটাই স্বাভাবিক। অথচ, তাকে যাঁতাকলে পিষে নিজের সুবিধামত মাটির পাত্র বানিয়ে নিয়ে পুরুষ থাকে অপরিবর্তিত। নারীর নিজের ঘর নেই, সহায় সম্পত্তিতে পাতের অর্ধেক ডিমের মতই অর্ধেক মালিকানা, তাও মিলবে কি মিলবে না তা ঠিক করবে পুরুষ, আর এটাই বাস্তবতা। নারীর নিজের ঘর নেই, হয় বাপের বাড়ি নয় স্বামীর ঘর। এই ২০২০ সালেও অনেক মেয়ের জীবন আবর্তিত হয় স্বামী নামক পুরুষকে কেন্দ্র করেই। ভালবাসা, সহমর্মিতা, বিশ্বাস বা নিজস্ব উপলব্ধিতে নারী তার জীবন যাপনে পরিবর্তন আনতেই পারে। কিন্তু পরিবর্তন যখন হয় পুরুষতান্ত্রিক চালে চাপানো হুমকি ধামকিতে বা চালাকি করে, তখন তা নারীর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য, আত্মবিশ্বাস অথবা একান্ত অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে, নারীর সুস্থ বা স্বকীয় মানসিকতাকে করে ক্ষতিগ্রস্থ।
তবে দুঃখজনক ভাবেই নারী মেনে নিতেই শেখে, সমাজের চোখ রাঙ্গানি, পারিবারিক চাপ তার সব নিয়ন্ত্রন করে, সবটুকুই। নারী নিজের অধিকার জানে না, জানে না কী কী অন্যায় হয়েছে তার সাথে, অন্যায় হলে কী করতে হয় সেই জ্ঞানটুকু অর্জনের আগ্রহও পুরুষতন্ত্র বিনাশ করেছে। তাই সে মেনে নেয়। স্বামী যখন বলে তোমার বাইরে যাওয়া নিষেধ, তখন সে মেনে নেয়, তাকে যখন স্কুল থেকে ছাড়িয়ে বাল্য বিবাহ দেয় তখন সে সেটা মেনে নেয়, শ্বশুরবাড়ি থেকে যখন তার শরীরে বোরখা চাপিয়ে দেয় তখন সেটা সে মেনে নেয়, স্বামী যখন পরকীয়ায় ধরা খায় তখন সেটা স্বামীর দোষ নয় সেটা সে মেনে নেয়, তার পড়ালেখা, ক্যারিয়ার, বিয়ে বা সন্তান গ্রহন, সব গুলোর সিদ্ধান্তই নেয় পুরুষতন্ত্র। একটি দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী বাকি অর্ধেকের অধীনে থাকে, সহযাত্রী হয় না।
মেয়েদের এই দাবিয়ে রাখা, নিয়ন্ত্রনে রাখার প্রবনতা সঠিক বলে বিরাট একটা অংশ মনে করে। তারা এও মনে করে যে প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের মারধর করা খারাপ কিছু নয়, যদি তাদের স্ট্যান্ডার্ডে সে খারাপ বলে সাব্যস্ত হয়। কিন্তু সেই একই হিসাব কিন্তু পুরুষদের ব্যাপারে নেই। গালি দেন, সেখানেও নেই পুরুষদের গালি দেওয়ার মত গায়ে লাগা কিছু। তো, যখন এই পুরুষতন্ত্রের নেটওয়ার্ক আর শিকড় এতই বিশাল আর গভীর তখন আপনারা যারা নিজেদের স্বকয়ীয়তা বিসর্জন দিয়ে বসে আছেন তাদের খুব বেশী কিছু করার নেই হয়তো। তারপরও যদি মনে হয় উঠে দাঁড়াতে হবে, যদি নিজের নিজস্বতাকে আজো কবর না দিয়ে থাকেন তাহলে আপনার যে বিশেষত্ব তা নিয়ে আবার কিছু শুরু করুন, হতে পারে সেটা রান্না, বাচ্চাদের বা বড়োদের কোন কিছু শেখানো অথবা রূপচর্চার কিছু, অথবা এমন কিছু যা আপনার ভীষণ পছন্দ। মনে রাখবেন, সামাজিক প্রশংসা বা অর্থনৈতিক অর্জন নিজের পায়ের নীচে যে ভিত তৈরি করে তাতে পুরুষতন্ত্রের গা জ্বললেও আপনার ভালই হবে। পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ আলাদা। স্রষ্টা সবার ভিতরে কিছু না কিছু দেন। সেই বৈশিষ্ট্য নষ্ট করা অন্যায়।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব মতামত]