ভাগ্য বদলাতে গিয়ে মেয়েকে দুর্ভাগ্যে সঁপে দিচ্ছেন না তো?
মালেকা আক্তার।। আমাদের সমাজে নারীরাই পুরুষকে উচ্চাসনে বসিয়েছে। পুরুষকে প্রভু ভেবে প্রভুভক্তির মানসিকতা ভেতরে ধারণ করে নারী। এর মূল কারণ ধর্মের অপব্যাখ্যা। যদি ইসলামের কথা বলি, এর মূল ধর্মগ্রন্থ আরবিতে লেখা। এই আরবি থেকে কোরআনের বিশ্লেষণ করে গ্রামের অশিক্ষিত ও নামমাত্র শিক্ষিত মৌলভী হুজুররা। তাদের কাছ থেকে মানুষ সত্য ও সঠিকভাবে কিছুই জানতে পারে না। হুজুররা তাদের ইচ্ছেমত ব্যাখ্যা দেন, বলা বাহুল্য এইসব ব্যাখ্যার সবই নারীকে দমন পীড়ন করার নানা কৌশল। কারণ এই হুজুররা পুরুষতান্ত্রিক সমাজেরই প্রতিনিধিত্ব করেন।
সৃষ্টির আদিকাল থেকে নারী নানাভাবে পুরুষের উপর নির্ভরশীল। আর পুরুষ নারীকে ব্যবহার করছে তাদের প্রয়োজনে। আগে রাজা বাদশাদের অনেক স্ত্রী থাকত। আবার তাদের রংমহলে অনেক বাইজীও থাকত। স্ত্রীদের সন্তান বিশেষ মর্যাদা নিয়ে বড় হত। আর বাইজীর ঘরেও এই সব পুরুষদের সন্তানের জন্ম হত। এরা মর্যাদাহীন হয়ে অবহেলায় বেড়ে উঠত। এ সবকিছুই তখন নারীরা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিত। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর বিরোধীতা যে হয়নি, তা নয়। তখন সেই সব নারীদের গুম হত্যা করা হত।
এইসব রাজা বাদশাহী এখন নাই। কিন্তু পুরুষচরিত্র তেমনি রয়ে গেছে। সুনীল গঙ্গোপাধায়ের সেই সময় উপন্যাসে সে আমলের হিন্দু বিধবাদের র্নিমম জীবনচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। মেয়েকে রজঃফলা হওয়ার আগেই বিয়ে দেওয়া হত। বিয়ে কী, সেটা বোঝার আগেই স্বামী মারা যেত কত মেয়ের। সে যেন নষ্ট না হয়ে যায়, ধর্মে যাতে তার মন থাকে, সেজন্য বিধবাকে হিন্দুদের র্তীথস্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হত। ওখানের পুরুতদের সেবাদাসী হিসাবে। বিধবা বিবাহের উপর ছিল কঠোর নিষেধাজ্ঞা। ফলশ্রুতিতে এই পুরুহিত পণ্ডিতরা এই বিধবাদের ভোগ করত। এই নারীরা গর্ভধারন করত। ওরা হত কলঙ্কিনী। গর্ভ নষ্ট করতে গিয়ে অনেকেই মারা যেত আর কিছু মেয়ে আত্মহত্যা করত।
কি নিষ্ঠুর এই পুরুষ! পনের ষোল বছর বয়সের মেয়ের শ্বশুড়বাড়িতে জায়গা হত না। এমনকি বাপের বাড়িতেও না। এই নিষ্ঠুর নিয়মের বেড়াজালে এই নারী সমাজ।
বর্তমানে এইসব নিয়ম শিথিল হয়েছে কিছু। কিন্তু নারী কি মুক্তি পেয়েছে ওদের এই ঘৃণ্য পাশবিকতা থেকে? পরিবারের সদস্যদের দ্বারা মেয়েরা প্রতিনিয়তই নীগৃহিত হচ্ছে। মেয়েকে কীভাবে বিয়ে দিয়ে নিজেরা দায়মুক্ত হবে সে চিন্তায় অস্থির। তাদের যা করা উচিৎ অন্যের উপর দায় না চাপিয়ে মেয়েকে লেখাপড়া করতে উৎসাহ দেওয়া ও তাকে সাবলম্বী করে বড় করে তোলা। তাকে মেয়ে হিসাবে না দেখে মানুষ হিসাবে দেখা মা বাবার কর্তব্য।
গ্রামীণ সমাজে কিছু গরিব ঘরের মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ দেওয়া হলেও তা খুব বেশি হলে প্রাইমারি অবধি। তাও সেটা ভাল বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছায়, ভাল পাত্র পাওয়ার সুবিধার্থে। বারো কি তের বছর বয়সে এরা মনে করে এখনই বিয়ে দেওয়ার উপযুক্ত সময়। তবে সরকারিভাবে বাল্যবিবাহ দণ্ডনীয় অপরাধ। এখন সবচেয়ে চাহিদা বেশি ইন্টারমিডিয়েট পাস মেয়ে। কারণ হিসাবে বলে, এইসব মেয়েদের কথা শুনানো যায়। বুদ্ধি তখনো পরিপক্ব হয় না, তাই এদের যেমন খুশি তেমনি চালাতে পারবে। কি নিদারুন বাস্তবতা। নারীকে নিয়ন্ত্রণের কত রকম ফন্দিফিকির বের করে এই সমাজ।
আমি মাঝে মাঝে গ্রামে যাই। সেখানে থেকে আসি বেশ কিছু দিন। পরিচিত একটি মেয়ে টিউশনি করে। ওর এক ছাত্রী নাইনে পড়ে। গত মাসে ওর বিয়ে হয়ে গেল। ফোনে আমি জানতে পারলাম। আমার পরিচিত মেয়েটি, ওর নাম সোমা। একদিন ওর মামাতো বোনটাকে বেড়াতে নিয়ে আসল আমার বাড়িতে, মেয়েটির নাম সাথী। ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। দেখতে বেশ মিষ্টি। সাথীকে বললাম, পড়াশোনা চালিয়ে যেও, অন্তত ডিগ্রীটা পাস কর। সোমা বলল, ওর বিয়ের কথা চলছে। ওর এরপর কী হতে পারে ভেবে একটু চুপ থাকলাম।
এদের পরিবারটা মোটামুটি সচ্ছল। তারা ইচ্ছা করলে মেয়েকে শিক্ষিত করে বিয়ে দিতে পারতো। মেয়েটি সাবলম্বী হলে ওর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যেত। সে যে কারো মুখাপেক্ষী নয়, এই বোধ ওর মধ্যে জন্ম নিতে পারত। এইভাবে একটি মেয়ে পরিবারকে, সমাজকে, দেশকে একটা গোটা বিশ্বকে অনেক কিছু দিতে পারে তার যোগ্যতা, তার সৃজনশীলতা দিয়ে। কিন্তু অঙ্কুরেই তাকে বিনষ্ট করা হয়। বিয়ে নামক একটি শব্দের সাথে জুড়ে দিয়ে।
তারপর যা হবার তাই হল। সোমাকে একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, সাথী কেমন আছে। ও বলল, সাথীর একটি ছেলে হয়েছে।
কোথায় আছে? বাবার বাড়িতে?
না, শ্বশুড়বাড়িতে। বিয়ের পর ওকে ওরা আর বাবার বাড়িতে আসতে দেয়নি। কারণ হিসাবে যা বলল, তা সেই আদিম বর্বরতা। বিয়ের সময় কানের গলার গহনা দিতে পেরেছিল, কিন্তু হাতেরটা তখন দিতে পারে নাই। এইবার আখ উঠলে তা বিক্রি করে মেয়ের হাতের গহনা তৈরি করে দেবে। তারপর যদি এই অভাগিনী বাবার বাড়ি আসতে পারে!
মা বাবার ভুল সিদ্ধান্ত, অমনোযোগিতা তার প্রিয় সন্তানটিকে দুঃখ ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেয়। এ কি ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা? নাকি জেনে শুনে দুর্ভাগ্যের হাতে সঁপে দেওয়া? কোনটা?
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]