ধর্ষণের শিকার নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থান এবং প্রতিবাদের রূপ
তানিয়াহ মাহমুদা তিন্নি।। বাংলাদেশ পুলিশের তথ্যমতে, গত বছর ৫ হাজার ৪০০ নারী এবং ৮১৫টি শিশু ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়। শুধু মেয়ে শিশুই নয় পুরুষ শিশুও হয়েছে এর শিকার। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা আগের থেকে বেড়েছে দ্বিগুণ। প্রথম আলোর একটি খবর জানাচ্ছে অভিযুক্তদের তালিকায় রয়েছে প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। পরিবহন শ্রমিক, স্কুল কিংবা মাদ্রাসা শিক্ষক, আইন শৃঙ্খলায় নিয়োজিত কর্মী; কে নেই এই তালিকায়? অর্থাৎ সমাজের প্রায় প্রতিটি শ্রেণির মানুষকেই ধর্ষণের সাথে জড়াতে দেখা যাচ্ছে। নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা এই সহিংসতাগুলো ঘটার জন্য দায়ী এই কথাটি বার বারই উঠে আসছে আলোচনায়। এই মানসিকতা নারীকে অধস্তন হিসেবে রাখতে পছন্দ করে, তাকে কেবল একটা “সেক্স অবজেক্ট” হিসেবে উপস্থাপন করে। ৯ মাসের কন্যাশিশু থেকে ৯০ বছরের বৃদ্ধা কেউই রেহাই পাননা ধর্ষকদের যৌন লালসা থেকে।
এছাড়াও আমাদের সমাজে রয়েছে দীর্ঘ দিনের বিচারহীনতার আবহ। সামাজিক,অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিকভাবে বেশিরভাগ সময়ই ধর্ষক পুরুষটি ধর্ষণের শিকার নারীর থেকে শক্তিশালী হয়ে থাকেন, ফলে অনেক সময় বিচার প্রক্রিয়াকে এর দ্বারা প্রভাবিত হতে দেখা যায়। কুমিল্লার কলেজ ছাত্রী তনুকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনার প্রায় তিন বছর হতে চলেছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার পরিবারের দেয়া সাক্ষাৎকার থেকে আমরা জানতে পারি বিচারের তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি, পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন চরম নিরাপত্তাহীনতায়। সেনানিবাস এলাকা থেকে তার লাশ উদ্ধার করার পর পরিবারের অভিযোগের তীর ছিল সেনাবাহিনীর দিকে। তনুর পরিবার নানাভাবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছেন যাতে সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার পান। বর্তমান বাংলাদেশের এই প্রবণতাটিও ভয়ংকর। সাধারণ মানুষ কোনভাবেই বিচারবিভাগের উপর ভরসা রাখতে পারছেন না, শরণাপন্ন হচ্ছেন রাষ্ট্রের সব থেকে ক্ষমতাধর ব্যক্তিটির কাছে। কিন্তু সেখান থেকেও কি সব সময় আশানুরূপ ফলাফল পাচ্ছেন তারা? নুসরাত হত্যাকাণ্ডে যেভাবে রাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসীন ব্যক্তিবর্গ সমালোচনা করেছেন এবং দ্রুত বিচারের নির্দেশ দিয়েছেন তনু কিংবা পারুল ধর্ষণের ঘটনায় কিন্তু তা ঘটছে না।
নুসরাত হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী একজন মাদ্রাসা শিক্ষক। যদিও তিনি বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সাথে জড়িত, কিন্তু বাংলাদেশের সব স্তরের মানুষের প্রতিবাদে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সহজ। অপরদিকে তনু হত্যাকাণ্ডে সেই প্রতিবাদ সহজ হয়নি। তেমনি বিভিন্ন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী নারীদের ধর্ষণ কিংবা যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠলেও এর কোন সুরাহা দেখা যায় না।
আরও কিছু ঘটনায় নজর দেয়া যাক। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নোয়াখালীতে পারুল নামের একজন নারী ধর্ষণের শিকার হন। পারুলের অভিযোগ ছিল নৌকা মার্কায় ভোট না দেয়ায় নৌকার সমর্থকরা তাকে ধর্ষণ করেন। যেহেতু ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা অভিযুক্ত এবং সেই নারী অর্থনৈতিকভাবে সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেন, সেহেতু উল্লেখযোগ্য তেমন কোন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়না শহুরে মধ্যবিত্ত এমনকি নারীবাদী সংগঠনগুলোকে। সরকারের উপর মহল থেকে আসেনা কোন নির্দেশনা। অন্যদিকে গত জানুয়ারীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নেয় অত্যন্ত জোরালোভাবে। অত্যন্ত দ্রুত সময়ের মধ্যেই ধর্ষক সন্দেহে আটক হতে দেখা যায় একজনকে। উল্লেখ্য আটক ব্যক্তিটি ক্ষমতা কাঠামোর বাইরের একজন। আরও একটি উদাহরণ কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও আলোচনায় আনা জরুরি বলে মনে করছি। মাসুদা ভাট্টি নামের একজন সাংবাদিককে টক শোতে রাজনৈতিক সংবাদের বিশ্লেষণ আলোচনায় ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন এর বলা- ‘আপনার দুঃসাহসের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। আপনি চরিত্রহীন বলে আমি মনে করতে চাই’ এই বক্তব্যটির জের ধরে নারী অবমাননার দায়ে বিবৃতি দিতে দেখা যায় বেশ কিছু মহলকে। অর্থাৎ ধর্ষক এবং ধর্ষিতা, নির্যাতনকারী এবং নির্যাতনের শিকার দুজনেরই আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্ববহ।
বিচারের দাবিতে মানুষ সোচ্চার হবেন কিনা সেটার সামাজিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করতে গেলে দেখতে পাব সহিংসতার শিকার নারীর পোশাক কিংবা আচার ব্যবহার, সহিংসতার মাত্রা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে সমাজের মানুষ ঠিক করেন আদৌ তারা প্রতিবাদ করবেন কি না; অথবা করলেও তা কতটুকু। উদাহরণস্বরূপ আমরা বলতে পারি তনু এবং নুসরাতের কথা। তনু সংস্কৃতি কর্মী ছিলেন, সমাজের চোখে ‘ভদ্র’ পোশাক (হিজাব) পরতেন, টিউশনি করাতে বাড়ির বাইরে বের হয়েছিলেন। একইভাবে নুসরাত বোরখা পরতেন, মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতেন, সমাজের চোখে ‘ভদ্র’। এই দুজনই সহিংসতার শিকার হয়ে মারা গিয়েছেন। তনু কিংবা নুসরাতের সাথে ঘটে যাওয়া সহিংসতার বিরুদ্ধে মধ্যবিত্ত শ্রেণি যেভাবে রাস্তায় নেমেছিলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন এর উল্টোটা ঘটতে দেখা যায় রাজধানীর রেইন ট্রি হোটেলে ঘটে যাওয়া দুই তরুণী ধর্ষণের ঘটনার ক্ষেত্রে। ধর্ষণের বিচারের দাবির থেকে বরং ধর্ষিতার বিরুদ্ধে সমালোচনা করতে দেখা গেছে বেশি। সে সময় বার বার স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে, কোন ‘ভদ্র’ নারী রাতে জন্মদিনের পার্টিতে যায় না। যার মাধ্যমে ধর্ষণের ঘটানাটিকে শুধু তুচ্ছ করাই নয় বরং এক ধরণের বৈধতা দেয়া হয়। শারীরিক নিপীড়নের পর চলতে থাকে মানসিক এবং সামাজিক নির্যাতন। এভাবে ধর্ষণের শিকার নারীর পোশাকের ধরণ, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, আর্থ-সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি অবচেতনভাবে ধর্ষণের প্রতিবাদ সংঘটনে প্রভাব রাখে।
তানিয়াহ মাহমুদা তিন্নি: প্রভাষক, সমাজতত্ত্ব এবং টেকসই উন্নয়ন বিভাগ, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]