December 23, 2024
কলামফিচার ৩

সাম্প্রদায়িকতা, নারীর লড়াই ও সিডও সনদ নিয়ে টালবাহানা

ইমতিয়াজ মাহমুদ।। আপনি যদি একটি শোষণহীন বৈষম্যহীন সুষম সমাজ বা সমাজরাষ্ট্র গড়ার পক্ষে কথা বলেন, তাইলে এই কথাটা আপনাকে বলতেই হবে যে শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে পুরুষকে যতটুকু লড়তে হয় নারীকে লড়তে হয় তার চেয়ে একটি বাড়তি লড়াই। সার্বিকভাবে সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করার লড়াইটা তো আছেই, তার সাথে নারীকে লড়তে হয় নারী ও পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যের বিরুদ্ধেও। শ্রমিকদের উদাহরণই নিই। নারী শ্রমিক ও পুরুষ শ্রমিক দুইই একটা সাধারণ লড়াই লড়েন প্রতিদিন শোষণের বিরুদ্ধে, সেই সাথে নারী শ্রমিককে আবার লড়তে হয় নারী অধিকারের জন্যও। কারণ একজন নারী শ্রমিক বৈষম্যের শিকার হয় দুইভাবে, প্রথমত শ্রমিক হিসাবে, সেই সাথে নারী হিসাবেও। সুতরাং লড়াইটাও নারীকে লড়তে হয় দুই ফ্রন্টেই। এই কথাটা সমাজ ও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সাম্প্রদায়িকতাও হচ্ছে এইরকম একটা ক্ষেত্র যেখানে নারীকে লড়তে হয় দুই ফ্রন্টে, প্রথমত সাধারণভাবে একজন নাগরিক হিসাবে সাপ্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, দ্বিতীয়ত নারী হিসাবে নারী অধিকার রক্ষার জন্যেও তাকে লড়তে হয় নারীর অধিকার রক্ষার জন্যে। কেননা সাম্প্রদায়িকতাও সমাজের অন্য সকল পচা গলা দূষিত প্রথা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির মত নারীকে একটি বাড়তি আঘাত করে।

এই কথাটা বাংলাদেশের নারীদের হাড়ে হাড়ে বোঝার কথা কেননা সাম্প্রদায়িকতার সাথে আমাদের বড় ও মূল রাজনৈতিক শক্তিগুলির আপোষের ফলে অন্য কারো কোন ক্ষতি হয় কি হয় না সেটা নিয়ে তর্ক হতে পারে, কিন্তু নারীর অধিকার আদায়ের পথটা যে একরকম সিলগালা করে রুদ্ধ করা হয়েছে সেকথা নিয়ে তর্কের কোন অবকাশই নাই।

সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের লক্ষ্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ১৯৭৯ সনে একটা কনভেনশন গৃহীত হয়। বাংলায় এটার নাম ‘নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ কনভেনশন’ ইংরেজিতে Convention on the Elimination of all forms of Discrimination against Women যেটা সাধারণভাবে CEDAW নামেই বেশি পরিচিত। এই কনভেনশনটিকে বলতে পারেন দীর্ঘ দিনের নারী অধিকার আন্দোলনের একটা ফসল। ১৯৭৫ সনে নারী দিবস পালনের সূচনায় জাতিসংঘের একটা সম্মেলন হয় মেক্সিকোতে। সেই সম্মেলনে পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে আসা প্রতিনিধিরা সম্মত হন যে এমনি এমনি বছরে একটা নারী দিবস পালন করলে তো হবে না, নারীর প্রতি সকল বৈষম্য দূর করা জন্যে আন্তর্জাতিকভাবে সর্বজনগ্রাহ্য এবং সকল রাষ্ট্রের পালনের জন্যে একটা দলিল থাকা দরকার। সেই লক্ষ্যেই এই কনভেনশনটার খসড়া তৈরি হয় এবং ১৯৭৯ সনে সেই খসড়া প্রথম সাধারণ পরিষদে উত্থাপন করা হয় এবং সেখানে সেটা গৃহীত হয়। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে চার পাঁচটা রাষ্ট্র ছাড়া বাকি সবাই ধীরে ধীরে এই কনভেনশনটা স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশও এটা স্বাক্ষর করেছে, তবে কয়েকটা বিধানের ব্যাপারে বাংলাদেশ আপত্তি জানিয়ে রেখেছে। সেই কয়েকটা বিশেষ বিধান দেখলেই আমরা বুঝতে পারব বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তিসমূহ সাম্প্রদায়িকতার সাথে আপোষ করে আর তার জন্যে বলি হয় নারীর অধিকার।

বাংলাদেশ সরকার এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করে ১৯৮৪ সনের শেষ দিকে। তখন ক্ষমতায় ছিল জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকার। সে সময়ের সরকার কনভেনশনে স্বাক্ষর তো করেছে বটে, কিন্তু সাথে একটা আপত্তিও জানিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশ সরকারের আপত্তিটা হচ্ছে, “The Government of the People’s Republic of Bangladesh does not consider as binding upon itself the provisions of articles 2, 13 (a) and 16.1 (c) and (f) as they conflict with Sharia law based on Holy Quran and Sunna.” অর্থাৎ বাংলাদেশ সরকার এই কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ২, ১৩(ক) এবং ১৬(গ) ও (১৬চ) মানবে না কারণ এইসব বিধান শরিয়া আইনের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বা সাংঘর্ষিক।

কী আছে এই কয়টা অনুচ্ছেদে? দ্বিতীয় অনুচ্ছেদটা এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই অনুচ্ছেদে কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র অঙ্গীকার করছে যে, নারীর প্রতি সকল বৈষম্য দূর করা জন্যে রাষ্ট্র নারী পুরুষের সমতার নীতি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবে, বৈষম্য নিষিদ্ধ করে আইন তৈরি করবে এবং সেইসব আইন বাস্তবায়নের জন্যে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেবে আর প্রচলিত আইনে বা সকল বিধি বিধানে যত বৈষম্য আছে সেগুলি দূর করার জন্যে বিদ্যমান আইন সংশোধন করবে এবং প্রয়োজনীয় নতুন আইন তৈরি করবে। (সংক্ষিপ্ত করেছি, কনভেনশনটা অনলাইনে ফ্রি পাওয়া যায়, পুরো টেক্সট দেখে নিতে পারেন।) পুরো কনভেনশনটা দেখলেই বুঝবেন যে এই অনুচ্ছেদটাই হচ্ছে এই কনভেনশনের হৃৎপিণ্ড- কেননা এই অনুচ্ছেদটা হচ্ছে একটা সার্বিকভাবে প্রযোজ্য বিধান এবং এইখানে রাষ্ট্র দায়িত্ব নিচ্ছে যে সর্বক্ষেত্রে সকল বৈষম্য দূর করবে এবং নারী পুরুষের সমতার বিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনে যুক্ত করে নেবে। অনুচ্ছেদ দুই যদি কার্যকর হয়, তাইলে পুরো কনভেনশনের অধিকাংশই কোন না কোনোভাবে কার্যকর হয়ে যাবে। এই অনুচ্ছেদটাতেই ওরা আপত্তি জানিয়ে রেখেছে, এটা মানবে না।

অনুচ্ছেদ ১৩(ক) হচ্ছে পারিবারিক কল্যাণের অধিকার প্রসঙ্গে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতার বিধান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে রাষ্ট্রের অঙ্গীকার। বাংলাদেশ সরকার বলে এসেছে এইটাও ওরা মানবে না, পারিবারিক কল্যাণের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতার ভিত্তিতে একই অধিকার নিশ্চিত করার জন্যে বাংলাদেশ সরকার কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না। অনুচ্ছেদ ১৬(গ) হচ্ছে বিবাহ ও বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার প্রসঙ্গে এবং ১৬(চ) হচ্ছে সন্তানের অভিভাবকত্ব ইত্যাদির ক্ষেত্রে পুরুষের অগ্রাধিকারের বিপরীতে কেবলমাত্র শিশুর কল্যাণ বিবেচনার বিধান। ১৯৮৪ সনে বাংলাদেশের সরকার এইসব বিধানেও আপত্তি জানিয়ে এসেছে, এইগুলিও নাকি ওরা মানবে না।

অনেক পর, ১৯৯৬ সনে আওয়ামী সরকার যখন ক্ষমতায় এসেছে, তার এক বছর পর ১৯৯৭ সনে গিয়ে বাংলাদেশ সরকার দুইটা বিধানের উপর থেকে আপত্তি তুলে নিয়েছে, এই দুইটা বিধান হচ্ছে অনুচ্ছেদ ১৩(ক) এবং অনুচ্ছেদ ১৬(চ)। অর্থাৎ এখন বাংলাদেশ সরকারের আপত্তি রয়ে গেছে অনুচ্ছেদ ২ আর অনুচ্ছেদ ১৬(গ) নিয়ে। আওয়ামী লীগ এসে দুইটা অনুচ্ছেদ থেকে আপত্তি তুলে নিয়েছে, একটু প্রশংসা সেজন্য যদি আপনি ১৯৯৬ সনের আওয়ামী লীগকে করতে চান, করেন। কিন্তু যে দুইটা অনুচ্ছেদ থেকে আপত্তি তুলে নিয়েছে অনুচ্ছেদ দুইয়ের তুলনায় সে দুইটার গুরুত্ব অনেক কম। ফলে আমার কাছে সে সময়ের আওয়ামী লীগ সরকারের এই পদক্ষেপটা খানিকটা লোক দেখানোই মনে হয়েছে সব সময়। আসলে প্রয়োজন ছিল দ্বিতীয় অনুচ্ছেদটার উপর থেকে আপত্তি তুলে নেওয়া এবং সেই অনুচ্ছেদটা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে কাজ করা। সেটা করলে বাকি অনুচ্ছেদগুলিও এমনিই বাস্তবায়ন হয়ে যেত।

আমাদের সরকারগুলি এইসব কাজ হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বহিঃপ্রকাশ। এবং লক্ষণীয় বিষয় যেটা, এই কনভেনশনটা আর আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িকতার পুনরুজ্জীবন- এই দুইটার সময়কাল মোটামুটি মিলে যায়। আমাদের এখানে তো অসাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মনিরপেক্ষতার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল স্বাধীনতার পরপর। যদিও সেই ১৯৭২ সনেও দেশে সরকারে ও সমাজে সাম্প্রদায়িক প্রবণতা ঠিকই দেখা গেছে , তবুও ১৯৭৫ পর্যন্ত মোটামুটি একটা আশা ছিল। সংবিধানে তখনো ধর্মনিরপেক্ষতা বর্তমান ছিল। ১৯৭৬ থেকে সেই যে সাম্প্রদায়িকতার আনুষ্ঠানিক পুনরুজ্জীবন শুরু হয়েছে, সেটা তো এখন এক রকম স্থায়ী হয়ে গেছে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত যতগুলি সরকার এসেছে, সকলেই সাম্প্রদায়িকতার সাথে আপোষ করেছে। এর ফলাফল বা বহিঃপ্রকাশই হচ্ছে এই কনভেনশনটির, যেটাকে বিশ্বব্যাপী নারীদের বিল অফ রাইট বলা হয়, সেটার মূল বিধানটিতেই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে আমাদের সরকারগুলি।

এখানে সাম্প্রদায়িকতাটা কোথায়? সেইটার জন্যে তাইলে আগে বলতে হয় সাম্প্রদায়িকতা কী। সাম্প্রদায়িকতা মানে ধার্মিকতা নয়। ধর্ম তো আছে, থাকবে, কেউ কেউ ধর্ম মানবে, কোন না কোন ধর্ম পালন করবে। সেটা যার যার ইচ্ছা। সাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে যখন কোন একটি ধর্ম বা একাধিক ধর্ম অন্য ধর্মগুলির তুলনায় নিজের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে এবং গায়ের জোরে সেটাকে সকলের উপর প্রয়োগ করতে চায়। আপনি যদি মুসলমান হয়ে থাকেন সেটাতে সাম্প্রদায়িকতার কিছু নাই। আপনি আপনার বিশ্বাস অনুযায়ী একটা ধর্ম বেছে নিয়েছেন, সেটা পালন করেন চর্চা করেন প্রচার করেন- সেগুলি আপনার অধিকার। সাম্প্রদায়িক হবেন তখন যখন আপনি আপনার ধর্মকে শ্রেষ্ঠ দাবি করে অন্যের উপর আপনার ধর্ম বা ধর্মীয় বিধি বিধান চাপাতে চেষ্টা করবেন এবং অন্যের উপর আক্রমণ করবেন। আপনি মসজিদে নামাজ পড়েন সেটা সাম্প্রদায়িকতা নয়, কিন্তু আপনি যখন অন্যের মন্দির, মূর্তি বা গির্জা ভাঙ্গতে যাবেন সেটা সাম্প্রদায়িকতা। আপনি ইসলামের বিধানাবলি মানবেন সেটা আপনার ইচ্ছা, কিন্তু আপনি যখন বলবেন যে দেশে সবাইকে শরিয়া আইন মানতে হবে এবং শরিয়া আইনের কোন ব্যাত্যয় হতে দেব না- সেটা সাম্প্রদায়িকতা।

আমাদের রাষ্ট্র বিভিন্ন সময় দখল করেছে সামরিক শাসকেরা। এরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করেছে সংখ্যাগুরু মানুষকে পক্ষে রাখার অপকৌশল হিসাবে। স্বাধীনতার পরের কয়েকটা বছর ছাড়া সেই পাকিস্তান আমল থেকে অদ্যাবধি আমাদের দেশে তো সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি এমনিই বিদ্যমান ছিল। সেইটাকেই সামরিক শাসকরা উস্কে দিয়ে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা সরিয়েছে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বানিয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা অনেকটা স্থায়ী রূপ লাভ করেছে ওদের হাতে। ফলে দেখা গেল যে, ১৯৯১ সনে সামরিক শাসকেরা বিদায় নিলেও দীর্ঘদিনের শিকড় গেঁড়ে বসা সাম্প্রদায়িকতা ঠিকই রয়ে গেছে। আপনাদের অনেকেরই মনে থাকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপি’র সাম্প্রদায়িক অপ্রচারের কথা- নৌকার ভোট দিলে আজান বন্ধ হয়ে যাবে, উলুধ্বনি হবে ইত্যাদি। এর পর থেকে তো আওয়ামী লীগও সাম্প্রদায়িক নীতিমালা গ্রহণ করেছে, এখন বলছে মদিনা সনদ ইত্যাদি।

এর যে দুইটা পক্ষ আছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, এরা দুইপক্ষই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিবর্তে ওদের সাথে আপোষ করে নিয়েছে। এখন ওরা প্রতিযোগিতায় নেমেছে কে কার চেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক। এর ফলাফল অন্যদের জন্যে যাই হোক না কেন, নারীদের জন্যে হয়েছে চূড়ান্তরকম অধিকারহরণকারী। সারা দুনিয়ার নারীরা দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের পর যে সনদটা অর্জন করেছে, যেটা মোটামুটিভাবে প্রায় সারা দুনিয়া অনিবার্য এবং অবশ্যপালনীয় হিসাবে গ্রহণ করেছে, আমাদের দেশ সেটিকে বাস্তবায়ন করবে না বলে মোটামুটি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে।

অনেকে বলবেন যে এই দুইটা অনুচ্ছেদ ছাড়া এই কনভেনশনের বাকি বিধানগুলি তো সরকার পালনের চেষ্টা করছে ইত্যাদি। কিন্তু আপনি যদি পাঠ করে দেখেন, দেখবেন এই কনভেনশনের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ বাদ দিলে এটা আর কোন অধিকারের সনদ হয়ে যায় না। এই কনভেনশনটি তখন হয়ে যায় কেবল একটি কল্যাণমূলক দলিল, অধিকারের সনদ নয়।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]